Image description

এবারের কোরবানির ঈদে চট্টগ্রামের কাঁচা চামড়ার বাজারে শৃঙ্খলা ফিরেছে, কমেছে সড়কের ওপর যত্রতত্র চামড়ার স্তূপ। তবে এই শৃঙ্খলার আড়ালেই লুকিয়ে আছে মৌসুমী ব্যবসায়ীদের হাহাকার। সরকারের বেঁধে দেওয়া দরের ভুল হিসাব এবং আড়তদারদের ‘কারসাজির’ ফাঁদে পড়ে হাজার হাজার টাকা লোকসানের আশঙ্কায় মাথায় হাত পড়েছে তাদের। অন্যদিকে আড়তদাররা বলছেন ভিন্ন কথা, তাদের দাবি- মৌসুমি ব্যবসায়ীরা লবণযুক্ত ও কাঁচা চামড়ার সঠিক তথ্য না জানায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।

বেলাল নামে এক ব্যবসায়ী বলেন, ‘আমি গত ২০ বছর ধরে চামড়ার ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। গত বছর ১ লাখ ২৫ হাজার টাকা লোকসান করেছি। এবারও একই শঙ্কায় আছি। প্রতিটি চামড়া গড়ে ৪৫০ টাকায় কিনেছি, অথচ আড়তদাররা ৩শ থেকে ৩৫০ টাকার বেশি দিতে চাইছেন না। ভাবছিলাম এবার ভালো দাম পাব, কিন্তু বাস্তবে আড়তদারদের কাছ থেকে আশানুরূপ সাড়া মিলছে না।’

আগ্রাবাদের চৌমুহনীতে ৪১টি বড় গরুর চামড়া নিয়ে আসা কলেজছাত্র আবদুন নুর নয়ন হতাশ কণ্ঠে বলেন, “বন্ধুরা মিলে ৭শ-৮শ টাকা দরে চামড়াগুলো কিনেছি। ভেবেছিলাম প্রতিটিতে কিছু লাভ হবে। কিন্তু বিকাল গড়িয়ে গেলেও কেউ দামই বলছে না। আড়তদারদের সিন্ডিকেট ইচ্ছাকৃতভাবে দাম ফেলে দিয়েছে, যাতে আমরা লোকসান দিয়ে চলে যাই এবং পরেরবার আর এই ব্যবসায় না আসি।”

একই চিত্র ফল বিক্রেতা মো. নাছিরের। ২৫ হাজার টাকা বিনিয়োগ করে এখন তিনি দিশেহারা। তিনি বলেন, “বড় গরুর চামড়া ৩৫০ টাকা আর মাঝারি গরুর চামড়া ২৫০-৩শ টাকায় কিনেছি। কিন্তু এখন তো কোনো দামই পাচ্ছি না। গতবারও ২০ হাজার টাকার চামড়া ফেলে যেতে হয়েছে।”

তারা অভিযোগ তুলেন, আড়তদাররা ইচ্ছাকৃতভাবে দেরিতে চামড়া কিনতে আসেন। যখন চামড়া পচতে শুরু করে, তখন নামমাত্র মূল্যে সেগুলো কিনে নেওয়ার কৌশল করেন তারা।

মিরসরাইয়ের চামড়া ব্যবসায়ী নুর উদ্দিন জানান, তিনি প্রায় ৬শ চামড়া কিনেছেন। প্রতি পিস চামড়া ১শ-৩শ টাকা দরে কিনেছেন। তার সবগুলো চামড়াতে শ্রমিক দিয়ে লবণ যুক্ত করতে হবে। এতে পরিবহন খরচ ও শ্রমিকের পারিশ্রমিকের কারণে চামড়ার ক্রয়মূল্য বেড়ে যাবে।

আড়তদারদের মতে, মৌসুমি ব্যবসায়ীদের অনেকেই লবণযুক্ত চামড়ার নির্ধারিত দামের সঙ্গে কাঁচা চামড়ার দাম গুলিয়ে ফেলেন। ফলে বাজার পরিস্থিতি না বুঝেই বেশি দামে চামড়া কিনে পরে বিক্রিতে লোকসানে পড়েন।

বৃহত্তর চট্টগ্রাম কাঁচা চামড়া আড়তদার ব্যবসায়ী সমবায় সমিতির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য মাহবুবুল আলম জানান, মৌসুমি বিক্রেতাদের বারবার সতর্ক করা হয়েছে। সরকার শুধু লবণযুক্ত চামড়ার দাম নির্ধারণ করেছে, কাঁচা চামড়ার নয়। কিন্তু অনেকে এই বিষয়টা না বোঝায় নিজেরাই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।

এ বিষয়ে বৃহত্তর চট্টগ্রাম কাঁচা চামড়া আড়তদার ব্যবসায়ী সমবায় সমিতির সাবেক সভাপতি মো. মুসলিম উদ্দিন মৌসুমি বলেন, 'সরকার লবণযুক্ত চামড়ার দাম প্রতি বর্গফুট ৫৫ থেকে ৬০ টাকা (সর্বনিম্ন ১ হাজার ১৫০ টাকা) নির্ধারণ করেছে। কিন্তু মৌসুমি ব্যবসায়ীরা যে কাঁচা চামড়া সংগ্রহ করেন, সেটিকে লবণযুক্ত করতে অনেক খরচ হয়। একটি ২০ ফুট চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণ, পরিবহন ও আড়তের খরচসহ প্রায় ৫শ টাকা খরচ পড়ে। এছাড়া ট্যানারি মালিকদের প্রতি চামড়ার ২০ শতাংশ বাদ দেন।'

তিনি আরও বলেন, 'লবণ ছাড়া চামড়া বেশি দামে কেনার সুযোগ নেই। মৌসুমি ব্যবসায়ীদের এ বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে।'

 এ বিষয়ে সমিতির সাবেক সভাপতি মো. মুসলিম উদ্দিন বলেন, ‘সরকার প্রতি বর্গফুট লবণযুক্ত চামড়ার দাম ৫৫ থেকে ৬০ টাকা (সর্বনিম্ন ১ হাজার ১৫০ টাকা) নির্ধারণ করেছে। কিন্তু মৌসুমি ব্যবসায়ীরা যেসব কাঁচা চামড়া সংগ্রহ করেন, সেগুলো লবণ দিয়ে সংরক্ষণ করতে প্রক্রিয়াজাতকরণ, পরিবহন ও আড়তের খরচসহ প্রায় ৫শ টাকা খরচ পড়ে প্রতিটি ২০ ফুটের চামড়ায়। তাছাড়া ট্যানারি মালিকরা প্রতিটি চামড়ার ২০ শতাংশ বাদ দিয়ে দেন।’

তিনি আরও বলেন, ‘লবণ ছাড়া কাঁচা চামড়া বেশি দামে কেনার সুযোগ নেই। মৌসুমি ব্যবসায়ীদের অবশ্যই এ বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে।’

লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী সংগ্রহের অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চাইলে মো. মুসলিম উদ্দিন বলেন, ‘এবার আমরা তিন লাখ চামড়া সংগ্রহের প্রস্তুতি নিয়েছি। এখন পর্যন্ত প্রায় ৮০ শতাংশ সংগ্রহ হয়ে গেছে। এখনও কিছু জায়গা থেকে চামড়া আসছে। আশা করছি, পুরোপুরি না হলেও সন্তোষজনক পরিমাণে সংগ্রহ করতে পারবো।’

চট্টগ্রাম জেলা প্রাণিসম্পদ কার্যালয়ের তথ্যমতে, এবার চট্টগ্রামে প্রায় ৮ লাখ ৯৬ হাজার পশু কোরবানি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আড়তদাররা প্রায় সাড়ে চার লাখ চামড়া সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করলেও গতবারের তুলনায় কিছুটা ধীরগতি দেখা গেছে।