Image description

উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল ও টানা ভারী বর্ষণের কারণে তিস্তা ও দুধকুমার নদীর পানি বিপৎসীমা অতিক্রম করেছে। ফলে নীলফামারী, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম ও গাইবান্ধা জেলার নিম্নাঞ্চল ও চরাঞ্চল প্লাবিত হয়ে লাখো মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। ধানের চারা, সবজিখেত, মাছের পুকুর ও কাঁচা সড়ক পানিতে তলিয়ে গেছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে তিস্তা ব্যারাজের ৪৪টি জলকপাট খুলে দিয়েছে।

নীলফামারী ও লালমনিরহাটে তিস্তার পানি বিপৎসীমার ওপরে

নীলফামারীতে তিস্তা নদীর পানি বিপৎসীমার ৪ সেন্টিমিটার ওপরে প্রবাহিত হচ্ছে। ডালিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপসহকারী প্রকৌশলী তহিদুল ইসলাম জানান, বুধবার সকালে পানি বিপৎসীমার ৪-৭ সেন্টিমিটার ওপরে উঠেছিল। বৃহস্পতিবার দুপুরে লালমনিরহাটের হাতীবান্ধা উপজেলার তিস্তা ব্যারেজ পয়েন্টে পানি বিপৎসীমার ১৮ সেন্টিমিটার ওপরে রেকর্ড করা হয়।

ডালিয়া ডিভিশনের নির্বাহী প্রকৌশলী অমিতাভ চৌধুরী বলেন, “পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ব্যারাজের সব স্লুইসগেট খোলা হয়েছে। বৃষ্টি ও ঢল অব্যাহত থাকলে সন্ধ্যার মধ্যে পানি আরও বাড়তে পারে।”

নীলফামারীর ডিমলা ও জলঢাকা উপজেলার খগাগড়িবাড়ী, খালিশা চাপানি, পূর্ব ছাতনাই, টেপাখড়িবাড়ী, ঝুনাগাছ চাপানী, গড়াবাড়ী, গোলমুন্ডা, শেলাইমারী ও কৈইমারী ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। লালমনিরহাটের সদর, পাটগ্রাম, হাতীবান্ধা, কালীগঞ্জ ও আদিতমারী উপজেলার দহগ্রাম, গড্ডিমারী, দোয়ানী, ছয়আনী, সিন্দুর্না, হলদিবাড়ী, ডাউয়াবাড়ী, ভোটমারী, শৈলমারী, নোহালী, মহিষখোচা, গোবর্ধন, বাহাদুরপাড়া, পলাশী, খুনিয়াগাছ, কুলাঘাট, মোগলহাট, রাজপুর ও গোকুন্ডা ইউনিয়নের নিচু এলাকাগুলো পানিতে তলিয়ে গেছে।

হাতীবান্ধার হলদিবাড়ি চরের বাসিন্দা আব্দুল মতিন বলেন, “রাত থেকে পানিবন্দি, পানি ক্রমেই বাড়ছে। মাচাংয়ের ওপর বসে নির্ঘুম রাত কাটাতে হচ্ছে।”

আদিতমারীর চর গোবর্ধনের আজিজুল ইসলাম জানান, “ফসলের ক্ষেত, রাস্তাঘাট ও পুকুর ডুবে গেছে। নৌকা ছাড়া যোগাযোগ সম্ভব হচ্ছে না।”

ডাউয়াবাড়ি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট মশিউর রহমান জানান, তাঁর ইউনিয়নে দেড় হাজারের বেশি পরিবার পানিবন্দি।

কুড়িগ্রামে তিস্তা ও দুধকুমার নদীর পানি বিপৎসীমা অতিক্রম

কুড়িগ্রামে তিস্তা, ধরলা, দুধকুমার, গঙ্গাধার ও ব্রহ্মপুত্র নদীর পানি বিপৎসীমা ছাড়িয়েছে। বৃহস্পতিবার সকাল ৯টায় তিস্তার ডালিয়া পয়েন্টে পানি বিপৎসীমার ৭ সেন্টিমিটার ওপরে এবং হাতীবান্ধা তিস্তা ব্যারেজ পয়েন্টে ১৫ সেন্টিমিটার ওপরে প্রবাহিত হয়েছে। ভূরুঙ্গামারী উপজেলার পাটেশ্বরী পয়েন্টে দুধকুমার নদীর পানি বিপৎসীমার ৬ সেন্টিমিটার ওপরে রেকর্ড করা হয়েছে। কুড়িগ্রাম সেতু পয়েন্টে ধরলার পানি বিপৎসীমার ৬০ সেন্টিমিটার নিচে এবং চিলমারীতে ব্রহ্মপুত্রের পানি ৯১ সেন্টিমিটার নিচে থাকলেও বৃদ্ধি পাচ্ছে।

কুড়িগ্রামের রাজারহাট উপজেলার সরিষাবাড়ী, বুড়িরহাট, মেদনি এবং নাগেশ্বরী উপজেলার রায়গঞ্জ, কেদার, কচাকাটা, বল্লভেরখাস ও নারায়ণপুর ইউনিয়ন প্লাবিত হয়েছে। চর বিষ্ণুপুরের বাসিন্দা শামসুল হক বলেন, “পুরো চরে পানি ঢুকেছে। রাস্তাঘাট ডুবে গেছে, আমন ধানের ক্ষেত তলিয়ে গেছে।”

নাগেশ্বরী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সিব্বির আহমেদ জানান, “দুধকুমারের পানি লোকালয়ে ঢুকলেও আমরা পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রস্তুত।”

নদীভাঙন ও ক্ষয়ক্ষতি

তিস্তার তীব্র স্রোতে রংপুরের গঙ্গাচড়ার মহিপুরে দ্বিতীয় সড়ক সেতুর সুরক্ষা বাঁধে ৭০ ফুট গভীর গর্ত সৃষ্টি হয়েছে, যা রংপুর-লালমনিরহাট মহাসড়ক ও হাজারো পরিবারকে ঝুঁকির মুখে ফেলেছে। রাজারহাটের নাজিমখাঁন এলাকায় তিস্তার পানি খালের মাধ্যমে উল্টো প্রবাহিত হয়ে ভাঙনের হুমকি তৈরি করেছে। স্থানীয় বাসিন্দা অনুকূল বলেন, “জিও ব্যাগ না ফেললে আমাদের বাড়িঘর ভেঙে যেতে পারে।”

কুড়িগ্রাম কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক আব্দুল্লাহ আল মামুন জানান, “তিস্তা ও দুধকুমারপাড়ের আমন ধান ও সবজিখেত তলিয়ে গেছে। ২-৩ দিনের মধ্যে পানি না নামলে ক্ষতি বাড়বে।”

নাগেশ্বরীর চর নারায়ণপুরের কৃষক দেলোয়ার শেখ বলেন, “ঘরে কোমর সমান পানি। একটি ছাগল ও কয়েকটি মুরগি পানিতে ভেসে গেছে।”

পূর্বাভাস ও প্রশাসনের প্রস্তুতি

কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. রাকিবুল হাসান জানান, উত্তর-পশ্চিম ও পশ্চিম-মধ্য বঙ্গোপসাগরে লঘুচাপের কারণে রংপুর, ময়মনসিংহ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, সিকিম, আসাম, মেঘালয় ও অরুণাচল প্রদেশে ভারী বৃষ্টিপাত হচ্ছে। আগামী দুই দিন ভারী বর্ষণ ও উজানের ঢল অব্যাহত থাকায় স্বল্পমেয়াদি বন্যার আশঙ্কা রয়েছে। তিনি বলেন, “নাজিমখাঁন এলাকায় ভাঙন রোধে ১ হাজার ৫০০ জিও ব্যাগ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে, তবে সীমিত বরাদ্দে সমস্যা হচ্ছে।”

জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মো. আব্দুল মতিন জানান, “বন্যা মোকাবিলায় খাদ্য ও সহায়তা উপকরণ মজুত আছে।” জেলা প্রশাসন ভূরুঙ্গামারী, নাগেশ্বরী, কুড়িগ্রাম সদর, রাজারহাট, চিলমারী ও চর রাজীবপুর উপজেলায় কন্ট্রোল রুম চালু করেছে। পানিবন্দি মানুষের মধ্যে শুকনো খাবার বিতরণ চলছে। হাতীবান্ধার ইউএনও শামীম মিঞা বলেন, “প্রায় ২০ হাজার পরিবার পানিবন্দি। প্রশাসন পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে।”

জেলা প্রশাসক নূসরাত সুলতানা জানান, “ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা থেকে মানুষকে সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে এবং শুকনো খাবার বিতরণ অব্যাহত আছে। বন্যা পরিস্থিতি জটিল হওয়ায় স্থানীয় প্রশাসন ও পানি উন্নয়ন বোর্ড সর্বাত্মক চেষ্টা চালাচ্ছে।

প্রতিবেদনটি তৈরিতে সহায়তা করেছেন নীলফামারী, লালমনিরহাট ও কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি।