
বগুড়ার শেরপুর উপজেলার পাড়া-মহল্লায় দাদন ব্যবসার বলি হচ্ছেন সাধারণ মানুষ। নিয়ম অনুযায়ী সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কর্তৃক নিবন্ধিত সংগঠন ছাড়া ক্ষুদ্র ঋণ কার্যক্রম পরিচালনা অবৈধ হলেও এ উপজেলার অধিকাংশ ইউনিয়নে অবৈধ ক্লাব-সমিতি ও ব্যক্তিকেন্দ্রিক চড়া সুদে ঋণ দিয়ে রাতারাতি টাকাওয়ালা বনে যাচ্ছেন দাদন ব্যবসায়ীরা। তাদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে টাকা দিয়ে আসার সুবিধার প্রলোভনে দিনমজুর, কৃষক, ভ্যান/রিক্সাচালক থেকে শুরু করে স্কুল শিক্ষক এমনকি বেসরকারি চাকরিজীবীরাও নিঃস্ব হচ্ছেন।
উপজেলার কয়েকটি ইউনিয়ন ঘুরে দেশ রূপান্তরের অনুসন্ধানে এমন তথ্য উঠে এসেছে। উপজেলার বিশালপুর ইউনিয়নের নয়লাপাড়া গ্রামের অঞ্জলী রানী (৪৫)। শ্রমিকের কাজ করে এক ছেলে এক মেয়ে নিয়ে কোন রকমে চলে তাদের সংসার। ছেলে মেয়ের পড়ালেখার খরচ চালাতে গিয়ে মাঠে কৃষিকাজ না থাকায় একই গ্রামের ভিম বর্মনের ছেলে ছিরেন বর্মন, ছফেন বর্মনের ছেলে চঞ্চল, কালু বর্মনের ছেলে গৌতম বর্মন, প্রভাত বর্মনের ছেলে অশোক বর্মনের কাছ থেকে দুই বছর আগে ৫০ হাজার টাকা ঋণ নেন। স্বামী-স্ত্রী মিলে মাঠে কাজ করে ৭০ হাজার টাকা পরিশোধ করলেও দাদন ব্যবসায়ীরা আরও ৫০ হাজার টাকার দাবি করে তাদেরকে নানা রকম হুমকি দিতে থাকে। এর প্রেক্ষিতে গত ১০ জুন (মঙ্গলবার) মাঠ থেকে অঞ্জলী রাণীর সাত মাসের গর্ভবতী গাভী নিয়ে যান তারা। গাভীটি আনতে গেলে ৫০ হাজার টাকা ছাড়া গাভী দেবে না বলে জানানো হয়। পরে, শেরপুর থানা পুলিশের সহায়তায় গাভীটি ফিরে পান অঞ্জলী।
উপজেলার খানপুর ইউনিয়নের খাগা, চক খাগা, নায়ের খাগা, ভিমজানি, ছাতিয়ানি গোপালপুর, ভাটরা, সুঘাট ইউনিয়নের বিনোদপুর, কল্যাণী, চকসাদি, জোড়গাছা, সূত্রাপুর, বেলগাছি, আওলাকান্দি, মধ্যভাগ, মির্জাপুর ইউনিয়নের মদনপুর, কৃষ্ণপুর, কাশিয়াবালা, রাজারদিঘী, দড়িমুকুন্দ, বিরইল, আড়ংশাইল, মাথাইল চাপড়, বীরগ্রাম, শাহ বন্দেগী ইউনিয়নের আন্দিকুমড়া, ঘোলাগাড়ি, রহমতপুর, ধড়মোকাম, দহপাড়া। বিশালপুর ইউনিয়নের নয়লাপাড়া, সিরাজ নগর, হাসাগাড়ীসহ অন্যান্য গ্রামেও দীর্ঘদিন ধরে মানুষকে টাকা দিয়ে ভয় দেখিয়ে চড়া সুদে টাকা আদায় করার কথা জানান এলাকাবাসী। এছাড়াও, শেরপুর পৌর শহরের শিশু পার্ক এলাকার আশেপাশে স্বর্ণ ব্যবসার আড়ালে গড়ে উঠেছে একটি সক্রিয় দাদন ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট।
উপজেলার খানপুর ইউনিয়নের ভাটরা গ্রামের বাসিন্দা সানোয়ার হোসেন বলেন, গ্রামাঞ্চলে এই দাদন ব্যবসা মহামারি আকার ধারণ করেছে। কেউ এক মাসের জন্য এক হাজার টাকা নিলে মাস শেষে তাকে এক হাজার দুইশ টাকা দিতে হয়। এছাড়াও, পাড়া-মহল্লায় যেকল অবৈধ ক্লাব/সমিতি আছে তারা সাপ্তাহিক বা মাসিক কিস্তিতেও টাকা দিয়ে থাকে। যাতে শতকরা সুদের পরিমাণ ধরা হয় ২০ টাকা।’
১০নং শাহবন্দেগী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবুল কালাম আজাদ তার ইউনিয়নের অন্তর্গত অনেক গ্রামেই এই দাদন ব্যবসার ভয়াল থাবার কথা জানিয়ে বলেন, ‘আসলে মানুষের মাঝে আগের মত আর সেই পারস্পারিক বন্ধন নেই। এরফলে কেউ কারও বিপদে এগিয়ে আসে না। এছাড়াও, আমানতদারিতা রক্ষা না করা ও ওয়াদা ভঙ্গের ক্ষতিকর দিকগুলো নিয়েও মানুষ ততটা মাথা ঘামায়না। মানুষে-মানুষে আস্থার কমতি আর সরকারি নিয়ম কানুন না জানার কারণেই দাদন ব্যবসায়ীরা সহজ সরল মানুষদের পুঁজি করে তাদের অবৈধ কর্ম চালিয়ে যাচ্ছে।’
সাধারণ মানুষ কেন দাদন ব্যবসার বলি হচ্ছে? এ প্রসঙ্গে উপজেলা সমাজ সেবা কর্মকর্তা মো. ওবাইদুল হক বলেন, উপজেলা সমাজসেবা কার্যালয়, উপজেলা পল্লী উন্নয়ন অফিস, উপজেলা পল্লী দারিদ্র বিমোচন ফাউন্ডেশন অফিস, উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তার কার্যালয়, উপজেলা যুব উন্নয়ন অফিস গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে স্বল্প সুদে ঋণ দিয়ে থাকে। মানুষ এসকল সুবিধা গ্রহণ না করে দাদন ব্যবসায়ীদের দারস্থ হয়ে সর্বস্ব হারায়। কেউ আর্থিক অনটনে পড়লে দাদন ব্যবসায়ীদের কাছে না গিয়ে সরকারি সংস্থাগুলো থেকে ঋণ নেওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।
উপজেলা স্বার্থরক্ষা পরিষদের সভাপতি কে এম মাহবুবার রহমান হারেজ বলেন, কোন এনজিও থেকে ঋণ নিতে গেলে নানা নিয়ম-কানুন আর শর্তের জটিলতায় অনেক সময় লাগে। যার ফলে বিপদ-আপদ বা আর্থিক প্রয়োজনে মানুষ বাধ্য হয়ে দাদন ব্যবসায়ীদের দ্বারস্থ হয়। পাড়া মহল্লায় দাদন ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট ভাঙার পাশাপাশি গ্রাম-শহরে ক্লাব-সমিতির আড়ালে দাদন ব্যবসা বন্ধে উপজেলা সমাজ সেবা কার্যালয় ও উপজেলা প্রশাসনের হস্তক্ষেপ জরুরি বলে মনে করেন তিনি।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আশিক খান বলেন, অবৈধ ক্লাব-সমিতি ও ব্যক্তিকেন্দ্রিক দাদন ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট সম্পর্কে তিনি জেনেছেন। বিষয়টি খুবই দুঃখজনক। এ ব্যাপারে দ্রুত আইনগত পদক্ষেপ নেয়া হবে বলে জানান তিনি।
Comments