
নাটোরে বিএনপির অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও অপপ্রচার নতুন মাত্রা পেয়েছে। অভিযোগ উঠেছে যে, গত ০৮ সেপ্টেম্বর লালপুর উপজেলা বিএনপির সাবেক আহ্বায়ক ও নাটোর জেলা বিএনপির সদস্য ডা. ইয়াসির আরশাদ রাজন লালপুর থানায় হামলা ও আসামি ছিনতাইয়ের মামলার আসামিদের ফজলুর রহমান পটলের বাসভবনে সংবর্ধনা দিয়েছেন। মামলার আসামীদের এভাবে সংবর্ধণা দেয়ার বিষয়টি অপরাধ এবং অপরাধীকে উৎসাহ প্রদান করে আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির আরও অবনতির ঘটাতে পারে। এ ঘটনা দলের তৃণমূল পর্যায়ে সাংগঠনিক দুর্বলতা এবং নেতৃত্বের সমন্বয়হীনতার প্রতিফলন বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
গত ১৬ ডিসেম্বর ২০২৪ মধ্যরাতে বাগাতিপাড়ার দয়ারামপুর ইউনিয়ন বিএনপির সাবেক সভাপতি আব্দুর রশিদ চৌধুরীর বাড়িতে গুলিবর্ষণের ঘটনায় অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়। পুলিশ তদন্তকালে বাগাতিপাড়া উপজেলা ছাত্রদলের আহ্বায়ক সোহেল রানাকে গ্রেপ্তার করে, যিনি পরে জামিনে মুক্তি পান। এরপর লালপুর থানা পুলিশ নাটোর জেলা ছাত্রদলের যুগ্ম আহ্বায়ক রুবেল উদ্দিনকে একই মামলায় গ্রেপ্তার করে। গ্রেপ্তারের পর বিএনপি, ছাত্রদল ও যুবদলের কিছু নেতাকর্মী থানায় হামলা চালিয়ে রুবেলকে ছিনিয়ে নেয়। এ ঘটনায় তিন পুলিশ কর্মকর্তাকে তৎক্ষণাৎ বরখাস্ত করা হয় এবং পুলিশ বাদী হয়ে আরেকটি মামলা দায়ের করে।
লাইভ ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে, আসামি ছিনতাইয়ের সময় নেতাকর্মীরা ‘রাজন ভাই’ স্লোগান দিয়ে আসামিকে নিয়ে বেরিয়ে যান। এ ঘটনার পর ডা. ইয়াসির আরশাদ রাজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে যে, তিনি ফজলুর রহমান পটলের বাসভবনে এই মামলার আসামিদের সংবর্ধনা দিয়েছেন।
বিএনপির সহ-দপ্তর সম্পাদক তাইফুল ইসলাম টিপুর বিরুদ্ধেও দলের অভ্যন্তরীণ ঐক্য নষ্ট করার গুরুতর অভিযোগ উঠেছে। স্থানীয় নেতাকর্মীরা দাবি করেছেন, টিপু নাটোর-১ আসনে ‘ধানের শীষ’ প্রতীক পাওয়ার জন্য দলের ঐক্য ভাঙার চেষ্টা করছেন এবং গোপনে আওয়ামী লীগের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন। এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “টিপু দলের অর্থ আত্মসাৎ করেছেন এবং বিএনপির তথ্য শত্রুপক্ষের কাছে পৌঁছে দিচ্ছেন।”
টিপু নিজেও সাম্প্রতিক সভা-সমাবেশে বিতর্কিত মন্তব্য করেছেন। তিনি দাবি করেন, গ্রেপ্তার হওয়া ছাত্রদল নেতাকর্মীদের জামিন না হওয়ার পেছনে বিএনপির সিনিয়র নেতাদের হাত রয়েছে। তবে নাটোর আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর রুহুল আমিন তালুকদার এই অভিযোগকে ‘অপপ্রচার’ আখ্যা দিয়ে বলেন, “গ্রেপ্তারকৃতরা অপরাধের সঙ্গে জড়িত ছিল বলেই গ্রেপ্তার হয়েছে। বিচার বিভাগ স্বাধীনভাবে কাজ করে, এখানে কোনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নেই।”
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান সম্প্রতি দলের অভ্যন্তরীণ ঐক্য ও সমস্যা সমাধানের উপর জোর দিয়ে বলেছেন, “আমাদের মধ্যে মতপার্থক্য থাকতেই পারে। আমরা বসব, আলোচনা করব। এক আলোচনায় শেষ না হলে আবার আলোচনায় বসব। আলোচনার মাধ্যমেই আমরা সমস্যার সমাধান খুঁজে বের করব।” তিনি সতর্ক করে বলেন, “বিভিন্ন বিষয় নিয়ে মাত্রাতিরিক্ত আলোচনা করলে রাষ্ট্র পুনর্গঠনের কাজে পিছিয়ে যাব, যা দেশ ও জনগণের জন্য ক্ষতিকর হবে।”
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, নাটোরের এই ঘটনা বিএনপির তৃণমূল পর্যায়ে সাংগঠনিক দুর্বলতা ও নেতৃত্বের সমন্বয়হীনতার প্রতিফলন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের একজন অধ্যাপক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “অপপ্রচার এবং স্থানীয় নেতাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব তৃণমূল কর্মীদের মধ্যে বিশ্বাসের সংকট তৈরি করছে। এটি দলের নির্বাচনী প্রচারণা এবং ভোটারদের সমর্থন সংগ্রহের ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করতে পারে।”
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ রায়হান শরীফ বলেন, “তৃণমূল পর্যায়ে এ ধরনের বিভ্রান্তি এবং ক্ষোভ দলের নির্বাচনী প্রস্তুতিকে দুর্বল করতে পারে। বিএনপির জন্য এখন জরুরি হলো তৃণমূল নেতাকর্মীদের মধ্যে ঐক্য ফিরিয়ে আনা এবং স্পষ্ট রোডম্যাপের মাধ্যমে নির্বাচনী প্রচারণা জোরদার করা।”
নাটোরের রাজনৈতিক ইতিহাসে ফজলুর রহমান পটল একটি উজ্জ্বল নাম। তিনি নাটোর-১ আসন থেকে চারবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন এবং বিএনপির প্রচার সম্পাদক ও চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর স্ত্রী কামরুন নাহার শিরিন ২০১৮ সালের নির্বাচনে বিএনপি মনোনীত ধানের শিষের প্রার্থী ছিলেন। তবে গত ৮ এপ্রিল লালপুর থানায় হামলা করে আসামি ছিনতাই করে নিয়ে যাওয়ার সময়ে করা লাইভে দেখা যায় ফজলুর রহমান পটলের ছেলের নামে স্লোগান দিয়েছে। আসামি ছিনতাইকারীরা ‘‘রাজন ভাই’’ নামে স্লোগান দিয়ে আসামিকে নিয়ে বের হয়ে যান। বিএনপি হাইকমান্ড যেখানে দেশব্যাপী সন্ত্রাস এবং চাঁদাবাজ বিরোধী কঠোর অবস্থানের বার্তা দিচ্ছেন সেখানে উপজেলা বিএনপির সাবেক আহবায়ক এবং জেলা বিএনপির একজন সদস্যর এহেন করমকান্ড সাধারন জনগণের কাছে কি বার্তা দেবে সেটাই প্রশ্ন।
থানায় হামলা ও আসামি ছিনতাই বাংলাদেশের দণ্ডবিধির ৩৫৩ ধারা (সরকারি কর্মচারীর কাজে বাধা দেওয়া), ৩৯৫ ধারা (ডাকাতি), এবং ২২৫ ধারা (আইনানুগ হেফাজত থেকে আসামি ছিনতাই) এর অধীনে শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এ বিষয়ে সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী ফেরদৌস আল মাহমুদ পলাশ বলেন, “অপরাধীদের সংবর্ধনা দেওয়া আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিকে আরও অবনতির দিকে নিয়ে যেতে পারে। এটি সমাজে অপরাধীদের প্রতি সমর্থনের সংকেত দেয়, যা আইনের শাসনের জন্য হুমকিস্বরূপ।”
নাটোরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. ইফতেখার আলম বলেন, “তদন্ত সাপেক্ষে প্রকৃত অপরাধীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। আমরা পেশাদারিত্বের সঙ্গে কাজ করছি।”
বিএনপির গঠনতন্ত্রের ৭(খ) ধারা অনুযায়ী, দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গ বা দলের ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত করার কারণে কোনো সদস্যকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত, সদস্যপদ বাতিল, বা দল থেকে বহিষ্কার করা যেতে পারে। নাটোর জেলা বিএনপির একজন জ্যেষ্ঠ নেতা বলেন, “ইয়াসির আরশাদ রাজনের এই সংবর্ধনার ঘটনা দলের জন্য বিব্রতকর। কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব তদন্ত করে রাজনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে।”
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, “বিএনপি আইনের শাসন ও শৃঙ্খলার প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। কোনো নেতা বা কর্মী যদি দলের নীতির বিরুদ্ধে কাজ করে, তবে তদন্তের মাধ্যমে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
Comments