Image description

'বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনুস ভালো মানুষ। আপনারা সবাই শুকরিয়া আদায় করেন'। 'আরকানের জমি রোহিঙ্গারা ফিরে পাবে'। সোমবার (৭ এপ্রিল) দুপুরে বান্দরবান আদালত থেকে কারাগারে পাঠানোর সময় এমন মন্তব্য করেন মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের সশস্ত্র সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি-আরসার প্রধান আতাউল্লাহ আবু আম্মার জুনুনি। এরপর থেকেই গণমাধ্যমে শুরু হয়েছে তাকে নিয়ে বাহারি সব শিরোনাম। 

পাঠকপ্রিয়তার লক্ষ্যে তার এইসকল কথাকে উদ্ধৃতি করে যেসকল শিরোনাম হলো তাতে তিনি রাতারাতি দেশে একাংশের কাছে হিরো বনে গেলেন। এরকম একজন জগন্য খুনি, অপরাধীকে নায়ক বানানোর পেছনে গণমাধ্যমের ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃত ভুলের দায় স্বীকার করতেই হবে। মিডিয়ার দায়িত্ব হচ্ছে অপরাধের মুখোশ খুলে সত্য প্রকাশ করা—ভয়াবহ এক অপরাধীর মানবিক মুখমণ্ডল তৈরি করা নয়।

আতাউল্লাহ জুনুনিকে অনেকে না জেনেই দূর থেকে বিশেষ খাতির করেন। তারা মনে করেন, রোহিঙ্গাদের ত্রাণকর্তা হিসেবে যুগে যুগে যারা আবির্ভূত হয়েছেন, জুনুনি তাদেরই একজন। অথচ একজন মানুষ হিসেবে তিনি যেসকল অপরাধের সাথে জড়িত তার ফিরিস্তি তুলে বর্ণনা শুরু করলে শেষ করা বেশ মুসিবতের। মাদক, অস্ত্র চোরাচালান থেকে শুরু করে অপহরণ, গুম, খুনসহ হেন অপরাধ নেই যা তিনি করেননি। রোহিঙ্গাদের উপর মিয়ানমার সেনাবাহিনীর ২০১৭ সালের গণহত্যার দায় পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষভাবে তারই ওপর বর্তায়। 

২০২১ সালে অবিসংবাদিত রোহিঙ্গা নেতা মহিবুল্লাহ হত্যা, ২০২২ সালে সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার (ডিজিএফআই) এক কর্মকর্তাকে খুনে তার প্রত্যক্ষ ভূমিকার কথা শোনা যায়। অথচ তার বক্তব্য আমাদের প্রথম সারির সংবাদমাধ্যমে শিরোনাম হলো- এটা বিভ্রান্তিকর! তার এই রূপ জনগণের সামনে তুলে ধরে মূলত তার পূর্ব-অপরাধগুলোকে ধামাচাপা দেওয়া হচ্ছে। আসলে আতাউল্লাহর মতো অপরাধীরা জানে কীভাবে জনমানসে নায়কসুলভ ভাবমূর্তি তৈরি করতে হয়। তারা কখনো মানবাধিকার, কখনো ধর্মীয় আবেগ, কখনো বা নিপীড়নের গল্প তুলে ধরে নিজের অপরাধ ঢাকতে চায়। এই চেষ্টাকে যদি মিডিয়া সহযোগিতা করে, সেটি শুধু একটি পেশাগত ব্যর্থতা নয়, বরং দেশের স্বার্থের বিরুদ্ধেও অবস্থান নেওয়ার নামান্তর।

২৪ এর অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে দেশের বড় একটি অংশ মানুষ ড. ইউনূসের নেতৃত্বে আস্থা রেখেছেন। ড. ইউনূসকে ভালো মানুষ বলছে- এমন ব্যক্তির প্রতি স্বভাবতই আলাদা সিম্প্যাথি কাজ করবে এই সকল মানুষের মধ্যে। আবার তার মতো অপরাধীর মুখ থেকে এ ধরণের কথাবার্তাকে ড. ইউনূস বিরোধীরা বিতর্কের উপজীব্য হিসেবে ব্যবহার করতে পারে। তার কথা দিয়ে জাতীয় রাজনৈতিক আবহ বা ব্যক্তিত্বকে মূল্যায়ন করাও একধরনের অনাচার। আবার এদিকে রোহিঙ্গাদের প্রতি বাংলাদেশের মানুষের টান থাকার কারণ বহুবিধ- প্রতিবেশী দেশের বাসিন্দা, ধর্ম, দৈহিক গড়ন, ভাষা প্রায় কাছকাছি। এছাড়াও দেশটির বামার আধিপত্যের দাপটে নির্যাতিত ও আমাদের আশ্রয়ে থাকার কারণে রোহিঙ্গাদের প্রতি ভালোবাসা থাকাটা কর্তব্য বলেই ধরে নিই। 

মুক্তিযুদ্ধের সময় বার্মায় বাঙালি শরণার্থীদের প্রতি রোহিঙ্গাদের দুর্ব্যবহারে কথা ভুলে থেকেই তাদের ভালোবাসি। আমরাও মনে করি, আরাকান রোহিঙ্গাদেরই। বিশ্বাস করি, রোহিঙ্গাদের উপর নির্যাতনের ন্যায় বিচার তারা পাবে। ওই মাটিতে তাদের অধিকার ঠিক একদিন প্রতিষ্ঠিত হবে। আমাদের মনের এই কথাগুলো যদি অন্যকেউ বলে এবং সেটা সংবাদের হেডলাইন হয়- আপনাআপনি তার নায়কোচিত চেহারা সামনে ভেসে উঠবে। কিন্তু তিনি যে এই সম্মান প্রাপ্য না। এই লোকটাই আমাদের এক সরকারি মেধাবী কর্মকর্তাকে কয়েকঘণ্টা ধরে নির্মম কষ্ট দিয়ে শেষে গুলি করে মেরেছেন। রোহিঙ্গারা যে একক নেতৃত্বের দিকে ঝুঁকছিল, যাকে ঘিরে ভাগ্য বদলের স্বপ্ন বুনছিল- সেই মুহিবুল্লাহকে হত্যায় তার নামটিই আগে আসে।

মিয়ানমার হয়ে বাংলাদেশে যত অবৈধ অস্ত্র ও মাদক প্রবেশ করে, তার বড় অংশই সামলান তিনি। আমাদের টেকনাফ-উখিয়া অস্থির হয়ে উঠার পেছনেও তার ভূমিকা অনেক। এই অঞ্চলের রোহিঙ্গাদের সাথে সাথে বাঙালি অপহরণের ঘটনাগুলোতে প্রধান অভিযুক্ত তিনিই। তাহলে কোন উদ্দেশ্যে পজিটিভলি উপস্থাপন করতে হবে? যে কিছু খবর নাহলেই ভালো, আতাউল্লাহকে নিয়ে খবর ওই 'কিছু' খবরের একটা। তাছাড়া তাকে নিয়ে ব্যাপক সন্দেহ- তিনি কি আদৌ রোহিঙ্গাদের মুক্তির জন্য লড়ছেন? তাকে আটকের দিনই আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন ফরটিফাই রাইটস আরসা এবং আরএসওসহ রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা শরণার্থী শিবিরে যুদ্ধাপরাধ করছে বলে জানায়। সংস্থাটি আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে (আইসিসি) আতাউল্লাহসহ অন্য অপরাধীদের বিচারের আহ্বান জানায়।

২০১৬ সালে আরসার নেতৃত্বে আসেন আতাউল্লাহ। ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট মিয়ানমার নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের আরসা'র একযোগে হামলা চালানোর পর আরসা এবং আতাউল্লাহ তখন আলোচনায় আসে। ওই হামলার পরই মিয়ানমার সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে নির্মম সামরিক অভিযান শুরু করে, যার ফলে প্রায় ৮ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। ওই হামলায় অন্তত এক হাজার মানুষ নিহত এবং বহু মানুষ আহত ও ধর্ষিত হন। সেখানকার উগ্র বৌদ্ধরাও রোহিঙ্গাদের ওপর অত্যাচার চালায়। 

মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় বাহিনীর সাথে যুদ্ধে টিকতে পারবে না জেনেও আক্রমণ করার পেছনে দ্বিমুখী যুক্তি আছে। নিজেদের অস্তিত্ব এবং শক্তির জানান দিতেই আরসা এই কাজটি করে- এটির মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের কাছে আরসা'র সাহসিকতার চিত্র ফুটে উঠবে। দ্বিতীয় যুক্তিতে বলা হয়- রোহিঙ্গাদের ওপর হামলা চালানোর জন্য 'উছিলা' তৈরী করতেই সেনাবাহিনীর পরামর্শে হামলার নাটক সাজায়। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন- আরসা আগে আক্রমণ না করলে ওই সময় রোহিঙ্গাদের ওপর হামলা করার কোনো কারণই ছিল না দেশটির সরকারি বাহিনীর। অর্থাৎ যে উদ্দেশ্যেই আরসা হামলা করুক রোহিঙ্গাদের এই বড় ক্ষতির দায় আতাউল্লাহ ও তার সংগঠনকেই নিতে হবে।

এদিকে মিয়ানমার নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর হামলার পরই আরসাকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে ঘোষণা করেছে মিয়ানমার। অন্যদিকে রাখাইনের দখলে থাকা বিদ্রোহীগোষ্ঠী আরাকান আর্মিও আরসাকে প্রতিপক্ষ মনে করে। বাংলাদেশ এখন রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে কঠিন এক কূটনৈতিক যুদ্ধে আছে। 

মিয়ানমারের জান্তা সরকার এবং রাখাইন অঞ্চলের বিদ্রোহী আরাকান আর্মির সমঝোতায় প্রত্যাবাসনের একটা জানালা তৈরি হতে চলেছে। বাংলাদেশের গলার কাঁটা রোহিঙ্গা প্রত্যাবসানে জান্তা সরকার ও আরাকান আর্মি- এই দুই পক্ষকেই দরকার পড়বে। এছাড়া রোহিঙ্গারা একধরনের শূন্যতায় ভুগছে—নেতৃত্বহীনতা, আশ্রয়হীনতা, পরিচয়হীনতা। এই শূন্যতার সুযোগে যদি আতাউল্লাহ আবারও ‘নায়ক’ রূপে প্রতিষ্ঠা পায়, রোহিঙ্গারা আবারও তার সংগঠনের ভণ্ডামিতে পা দিতে পারে, সমর্থন করা শুরু করতে পারে। ভবিষ্যতে রোহিঙ্গাদের আরও বড় বিপদের মুখে ঠেলে দিতে পারে আতাউল্লাহর আরসা।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট