Image description

ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার মানবাধিকার রক্ষায় প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে ব্যর্থ হচ্ছে বলে সমালোচনা করেছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ)। সংস্থাটি জানিয়েছে, ২০২৪ সালের গণআন্দোলনের মাধ্যমে শেখ হাসিনার ১৫ বছরের দমনমূলক শাসনের অবসান হলেও বিরোধীদের বিরুদ্ধে নির্বিচার গ্রেপ্তার, রাজনৈতিক প্রতিশোধ ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা অব্যাহত রয়েছে। গুম ও নিখোঁজের মতো গুরুতর নির্যাতন কিছুটা কমলেও সমস্যা এখনো রয়ে গেছে।

মানবাধিকার লঙ্ঘন অব্যাহত

এইচআরডব্লিউ-এর এশিয়া বিষয়ক উপপরিচালক মীনাক্ষী গাঙ্গুলি বলেন, “গত বছর হাজার হাজার মানুষ যে আশা নিয়ে শেখ হাসিনার দমনমূলক শাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল, সেই আশা এখনো পূরণ হয়নি। ইউনূস সরকার নিরাপত্তা বাহিনীর সংস্কার না করে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধপরায়ণ আচরণ করছে।”

প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২৪ সালে গঠিত ১১টি সংস্কার কমিশন এবং জাতিসংঘসহ দেশি-বিদেশি মানবাধিকার সংস্থাগুলোর সুপারিশ এখনো বাস্তবায়িত হয়নি। এর মধ্যে পুলিশ সংস্কার, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা এবং নারী ও সংখ্যালঘুদের অধিকার সংরক্ষণ অন্যতম। সরকার রাজনৈতিক সহিংসতা, সাংবাদিকদের হয়রানি ও উগ্র ধর্মীয় গোষ্ঠী কর্তৃক নারী এবং এলজিবিটি সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে হুমকি-হয়রানি ঠেকাতে ব্যর্থ হয়েছে। রংপুরের একটি হিন্দু পল্লিতে ২৬ ও ২৭ জুলাই ১৪টি ঘর ভাঙচুর এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে সংখ্যালঘুদের ওপর সহিংসতার ঘটনা এর উদাহরণ।

গণআন্দোলন ও এর পরবর্তী ঘটনাবলি

২০২৪ সালের গণআন্দোলনে জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে ১,৪০০ মানুষ নিহত হয়। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা দেশত্যাগ করেন এবং ৮ আগস্ট ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়। তবে পুলিশি হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যুর ঘটনা অব্যাহত রয়েছে। গোপালগঞ্জে ১৬ জুলাই আওয়ামী লীগ ও জাতীয় নাগরিক পার্টির সমর্থকদের সংঘর্ষে পাঁচজন নিহত হন, এবং পরে পুলিশ শতাধিক আওয়ামী লীগ কর্মীকে গ্রেপ্তার করে।

গত বছর ৬ আগস্ট থেকে ২৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৯২,০০০-এর বেশি মানুষের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের হয়, যার মধ্যে ৮,৪০০ জনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা। উত্তর ঢাকার সাবেক মেয়র আতিকুল ইসলামের বিরুদ্ধে ৬৮টি মামলা দায়ের হয়, যার ৩৬টি ঘটনার সময় তিনি দেশের বাইরে ছিলেন। এইচআরডব্লিউ দাবি করেছে, এসব মামলার অধিকাংশ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং অনেকে বিনা কারণে আটক, চিকিৎসা ও জামিন থেকে বঞ্চিত। শেখ হাসিনাসহ অভিযুক্তদের বিচার শুরু হবে ৩ আগস্ট, তবে অধিকাংশ মামলায় এখনো চার্জশিট বা প্রমাণ জমা পড়েনি।

বিতর্কিত আইন ও নিরাপত্তা বাহিনী

‘বিশেষ ক্ষমতা আইনের’ মতো বিতর্কিত আইন ব্যবহার করে বিরোধীদের দমন অব্যাহত রয়েছে। ফেব্রুয়ারিতে ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট’-এ ৮,৬০০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়, যাদের অধিকাংশ আওয়ামী লীগ সমর্থক বলে দাবি। এইচআরডব্লিউ বলছে, অপরাধীদের বিচার জরুরি হলেও গ্রেপ্তারগুলো রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।

শেখ হাসিনার আমলে মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে নিরাপত্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে উল্লেখযোগ্য কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। পুলিশ জানায়, গত বছরের সহিংসতায় মাত্র ৬০ জন পুলিশ সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, যদিও র‍্যাবসহ একাধিক বাহিনী জড়িত ছিল। গুম তদন্তে গঠিত কমিশনে ১,৮০০-এর বেশি অভিযোগ জমা পড়লেও নিরাপত্তা বাহিনী তথ্য গোপন করছে বলে অভিযোগ।

সংস্কারে ব্যর্থতা ও সুপারিশ

ইউনূস সরকার ১১টি সংস্কার কমিশন গঠন করলেও কোনো সুপারিশ বাস্তবায়ন করেনি। নারীদের রাজনীতিতে নিরাপদ অংশগ্রহণ এবং সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এখনো চ্যালেঞ্জ। এইচআরডব্লিউ সরকারকে বিচার ও পুলিশ সংস্কার, র‍্যাব ভেঙে দেওয়া এবং ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার আহ্বান জানিয়েছে। তারা জাতিসংঘ ও অন্যান্য দেশকে ইউনূস সরকারকে সমর্থনের পাশাপাশি গুরুতর অপরাধীদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপের পরামর্শ দিয়েছে।

মীনাক্ষী গাঙ্গুলি বলেন, “ইউনূস সরকার অনেক চ্যালেঞ্জের মুখে রয়েছে, তবে এখনই বাস্তব ও স্থায়ী পরিবর্তন আনার সময়। যারা অতীতে নিপীড়িত হয়েছে, তারা যেন আজ ভিন্ন নামে নিপীড়ক না হয়।”