Image description

সম্প্রতি এদেশের ছাত্র জনতা বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের মাধ্যমে স্বৈরাচারী শাসন থেকে জনগণকে মুক্ত করেছে। সত্যিকারের বৈষম্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে প্রথমতো সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যকার বৈষম্য সমূলে উৎপাটন করা আবশ্যক। 

সুনীতি, শুদ্ধাচার, আইনের শাসন ও নৈতিকতা চর্চায় বিশ্বাসী রাষ্ট্র ব্যবস্থাপনায় জেলা আদালতের সহকারী জজ, সিনিয়র সহকারী জজ, জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, এবং যুগ্ম  জেলা ও দায়রা জজ  সমমর্যাদা সম্পন্ন বিচারকগণের গাড়ির সুবিধা  নেই। বিষয়টা বাংলাদেশের জনগণের অনেকের কাছে বিস্ময়কর হলেও এটাই চরম সত্য এবং বাস্তবতা।
 
বাংলাদেশে আমলাদের ভূমি ব্যবস্থাপনায় স্বেচ্ছাচারিতা ও দুর্নীতির ফলাফল দেওয়ানী আদালতগুলোকে মামলার ভারে ভারাক্রান্ত করেছে। খতিয়ান প্রস্তুত, দখল সংক্রান্ত প্রতিবেদন, নামজারি, খাস জমি বন্দোবস্ত প্রভৃতি বিষয়ে মাঠ পর্যায়ের আমলাদের সিদ্ধান্ত দেওয়ানী আদালতে মামলায় রূপান্তরিত হচ্ছে। এই মামলার দ্রুত নিষ্পত্তিতেও বিচারকের প্রাণ ভোমরা অতি সূক্ষ্মভাবে আমলাদের হাতে বন্ধক রাখা হয়েছে।

দেওয়ানী কার্যবিধি আইন-১৯০৮ এর আদেশ ১৮ বিধি মোতাবেক দেওয়ানী আদালতের বিচারক (সহকারী জজ, সিনিয়র সহকারী জজ এবং যুগ্ম জেলা জজ) গণের মামলায় তর্কিত সম্পত্তি বা   ভূমির লোকাল ইন্সপেকশন করার ক্ষমতা রয়েছে। লোকাল ইন্সপেকশন এর মাধ্যমে বিচারক সরাসরি নালিশী জমিতে গিয়ে বিরোধীয় জমি নিজ  চোখে দেখে তথ্য- প্রমাণ সংগ্রহ করতে পারেন যা দ্রুত ন্যায় বিচার প্রদানের কার্যকর মাধ্যম। কিন্তু বাংলাদেশের দেওয়ানী আদালতের বিচারকদের প্রবল ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও উপায় নেই কারণ লোকাল ইন্সপেকশন এ যাওয়ার জন্য বিচারকের গাড়ি নাই। এক্ষেত্রে, লোকাল ইন্সপেকশন এ যাওয়ার জন্য গাড়ির রিকুইজেশনের ক্ষমতা স্থানীয় আমলা (এনডিসি) হাতে রাখা হয়েছে। মাসে গড়ে ১৫-২০ টির মত মোবাইল কোর্ট চালানোর অজুহাতে সরকারি চাকরির তুলনামূলক নবীন কর্মকর্তা (এনডিসি) দামি গাড়ি চড়ে বেড়ান কিন্তু রাষ্ট্রের সার্বভৌম ক্ষমতার অংশীজন হিসেবে ১০-১৫ বছর যাবত বিচার করা সিনিয়র সহকারী জজ বা যুগ্ম  জেলা জজ এর গাড়ির সুবিধা নাই। এটা কী রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায়  বৈষম্য নয়। 

বিচারকের মান মর্যাদা এবং বিচারিক কাজের সাথে গাড়ির সুবিধা ওতপ্রোতভাবে জড়িত অথচ প্রত্যেকবার উচ্চ পর্যায়ের আমলারা জেলা আদালতের বিচারকদের গাড়ির সুবিধা  থেকে বঞ্চিত করে দাবী করেছেন  যে, বিচারকগণ মাঠ পর্যায়ে কাজ করেন না তাই তাদের গাড়ির দরকার নেই।

দেওয়ানি আদালতের বিচারকদের লোকাল ইন্সপেকশন এর ক্ষমতা প্রয়োগের জন্য সহকারী জজ, সিনিয়র সহকারী জজ, এবং যুগ্ম  জেলা জজের গাড়ির সুবিধা প্রদান করা না হলে যতই বিচার বিভাগের কাঠামোগত পরিবর্তন করা  হোক না  কেন ভূমি সংক্রান্ত বিরোধ দ্রুততার সাথে নিষ্পত্তি ও তা কার্যকর করা সম্ভব হবে না। 

অপরাধের সত্য মিথ্যা নিরূপণে ফৌজদারী কার্যবিধি আইনে জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট এর বিচার বিভাগীয় তদন্তের কার্যকর ক্ষমতা রয়েছে। বিচার বিভাগীয় তদন্তের মাধ্যমে চাঞ্চল্যকর বা স্পর্শকাতর মামলা, পারিবারিক বা নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের মামলাগুলো জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট স্বয়ং তদন্ত পূর্বক দ্রুত অপরাধীদের বিচারের মুখোমুখি করতে পারেন। জুডিসিয়াল তদন্তের ঘটনাস্থল পরিদর্শন, ঘটনাস্থলের আশেপাশের ব্যক্তিগণের সাক্ষ্য গ্রহণ প্রভৃতি কাজের জন্য জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের গাড়ি অত্যাবশ্যক নয় কি।

মনে স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে আমলাতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থা আদৌ কী চায় সহকারী জজ, সিনিয়র সহকারী জজ বা জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট স্বয়ং ঘটনাস্থল পরিদর্শন পূর্বক দ্রুত জনগণের ন্যায় বিচার নিশ্চিত করুক, যদি তারা এটা চাইতো তবে বিচারকদের অবশ্যই গাড়ির সুবিধাসহ অন্যান্য সুবিধা এতোদিনে প্রদান করা হত। 

বাংলাদেশে বিগত রাজনৈতিক সরকারের আমলে রাস্তাবিহীন ব্রিজ কালভার্ট নির্মাণে টাকার অভাব হয়নি, কিংবা সংকটকালেও বাংলাদেশের আমলাদের সুযোগ-সুবিধা দিতে টাকার অভাব হয় না কিন্তু জেলা আদালতের ১২০০-১৪০০ বিচারকদের গাড়ির সুবিধা প্রদানে অর্থ সংকট দেখানো হয়েছে। আমলী আদালত হিসেবে জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের গাড়ির সুবিধা না থাকায় বাংলাদেশে নিরাপদ খাদ্য আদালত, পরিবেশ আদালত, ছাড়াও  ছোটখাটো অপরাধের বিচারের জন্য সংক্ষিপ্ত বিচার আদালত পরিচালনা করা সম্ভব হয় না। 

ফলে আমলাতান্ত্রিক ভূমি ব্যবস্থাপনায় বালুমহল, জলমহল, খাল, বিল, নদী, হাট, বাজার সকল কিছু রাজনৈতিক দলের পরিচয়ে ভূমিদস্যুরা দখল করে নিয়ে অপরাধের রাজত্ব  তৈরি করে  রেখেছিল। আমলি আদালতের বিচারক হিসেবে জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট বা সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের গাড়ির সুবিধা থাকলে তার এখতিয়ারে থাকা বিচারিক এলাকায় সপ্তাহে তিনি একবার হলেও ঘুরে আসতে পারতেন। তাহলে  দেখা যেত জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতি কতটা কার্যকর এবং মাঠ পর্যায়ের জনবিরোধী সিন্ডিকেট ভেঙ্গে দেয়ার প্রয়াস পেতেন। কিন্তু স্বাধীনতার এত বছরেও  কেন বিচার বিভাগের কর্মকর্তাদের গাড়ির সুবিধা দেওয়া হলো না? এই প্রশ্নের উত্তর একটাই-এদেশের চতুর আমলারা কখনোই চায় না বিচার বিভাগ শক্তিশালী  হোক এবং মর্যাদাসম্পন্ন বিচারক তার খাসকামরা  থেকে  বেড়িয়ে মাঠ পর্যায়ে গিয়ে অপরাধের বিচার করুক-এতে আমলাদের বিচার করার শখ (মোবাইল  কোর্ট) আরও প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে। কথাটি তিতা হলেও চরম সত্য। একজন মাঠ পর্যায়ের আমলা বিচার করতে উদগ্রীব কারণ-ক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ, অথচ একজন বিচারক মাঠ পর্যায়ে গিয়ে বিচার করতে চান তার উদ্দেশ্য জনগণকে দ্রুত ন্যায় বিচার প্রদান করা ও সমাজে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা পালন করা। 

দুই-চারটে  মোবাইল  কোর্ট চালানোর জন্য আমলাদের গাড়ির প্রয়োজন রয়েছে অথচ হাজার হাজার মামলার বিচার করার জন্য একজন বিচারকের গাড়ির প্রয়োজন হয় না বুঝি? রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় বিশ্বাসী সরকার ব্যবস্থায় সার্বভৌমত্বের অংশীদার বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তা হিসেবে বিচারকদের সাথে এমন  বৈষম্য পৃথিবীর আর  কোথাও  নেই। বৈষম্য দূরীকরণে দ্রুত ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠায় সহকারী জজ, সিনিয়র সহকারী জজ ও যুগ্ম  জেলা জজ সমমর্যাদা সম্পন্ন বিচারকদের গাড়ির সুবিধা প্রদানের কার্যকর উদ্যোগ এই সরকার গ্রহণ করবে বলে আশাবাদী। প্রশাসন ক্যাডারের সাথে বৈষম্যের পাহাড় তুলে গতিশীল বিচার ব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব হবে না।

বিচার কাজের প্রকৃতির সাথে বিচারকের নিরাপত্তা অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত। অনিরাপদ ব্যক্তির কাছ থেকে নিরপেক্ষ ও ন্যায়বিচার আশা করা আকাশ কুসুম কল্পনা। বিচারকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে না পারলে সাহসী ও নিরপেক্ষ বিচারক তৈরি করা সম্ভব নয়। কারণ নিরাপত্তাহীনতা মানুষের নিউরনের স্থিতিশীলতা নষ্ট করে যা বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত। 

দেশে সুশাসন ও ন্যায়দণ্ড সমুন্নত রাখতে ভয়ংকর ও প্রভাবশালী অপরাধীদের বিচার করে দণ্ড প্রদানকারী বিচারক ও তার পরিবার গণপরিবহনে যাতায়াত করে এরকম অনিরাপদ ব্যবস্থা একটা রাষ্ট্র  মেনে নেয় কিভাবে?

লেখক: জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত, নাটোর।