আমরা ছোট থেকেই একটা কথা শুনে এসেছি যে, মেয়েরা মায়ের জাত। কিন্তু আমরা সবাই কি সেই কথাটা মানতে পেরেছি? তাই যদি হতো, তাহলে এদেশে মেয়েরা এত নিরাপত্তাহীনতায় ভুগত না। রাস্তা-ঘাটে, দিনে-রাতে কোথাও নারী সুরক্ষিত নয়। কোথাও না কোথাও তারা শারীরিক ও মানসিকভাবে নিগৃহীত হচ্ছে। দিনের পর দিন সমাজে ধর্ষণ নামক বিষবাষ্প ছড়িয়ে পড়ছে।
সমাজের একটি শ্রেণি শুধু ভোগ্যসামগ্রী হিসেবে নারীকে দেখে। যেখানে নারীকে সম্মানের চোখে দেখার কথা, সেখানে তাকে কটু দৃষ্টিতে দেখা হয়। দুঃখজনক হলেও সত্য এই যে, এই ধরনের নিচু মানসিকতার কাজ আমাদের সমাজের তথাকথিত শিক্ষিতদের মধ্যেও দেখা যায়। ২০২১ সালে ধর্ষণের শিকার হয় প্রায় ৩ হাজার।
পুলিশ সদর দপ্তর থেকে জানা যায় যে, গত পাঁচ বছরে সারা দেশে ধর্ষণের মামলা হয়েছে ৫৯ হাজারের বেশি। আসকের ২০১৯ সালের প্রতিবেদনে বলা হয় যে, সারা দেশে ধর্ষণের ঘটনা বেড়েছে দ্বিগুণেরও বেশি। ২০২০ সালে সংশোধন করে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড ধার্য করা হয়। তবুও ধর্ষণের সংখ্যা কমেনি। দেশে নারী ও শিশুকে ধর্ষণ, গণধর্ষণ কিংবা ধর্ষণের পর হত্যার ঘটনা ঘটেই চলছে।
বিআইএসআর ট্রাস্টের এক গবেষণায় (২০১৮) বাংলাদেশে নারী ধর্ষণের নানাবিধ কারণ ওঠে এসেছে। গবেষণাটিতে ১১৯ জন ধর্ষণের ভিকটিম বা তার পরিবারের সদস্যদের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছে। এছাড়াও বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিবর্গ ও মাঠ-পর্যায়ে অভিজ্ঞ পুলিশ কর্মকর্তাদের সাক্ষাৎকার এবং ৭টি ‘কেইস স্টাডি’ করা হয়েছে। গবেষণার ফলাফলে দেখা যায় যে, ধর্ষণের শিকার নারীর ৯৩ দশমিক ৩ শতাংশ শুধু ধর্ষণ এবং বাকি ৬ দশমিক ৭ শতাংশ ধর্ষণের পর হত্যার শিকার হয়েছিলেন।
সম্প্রতি বাংলাদেশে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান করায় ভবিষ্যতে ‘ধর্ষণের পর হত্যার হার’ বেড়ে যেতে পারে বলে অনেকেই আশঙ্কা প্রকাশ করছেন। শহরাঞ্চলে আবাসিক এলাকার তুলনায় বস্তিতে ধর্ষণ বেশি ঘটে। অপরদিকে শিশুকে ধর্ষণের পর হত্যার ঘটনা তুলনামূলক গ্রামাঞ্চলে বেশি। ধর্ষণ সংঘটনকারীদের মধ্যে প্রায় অর্ধেকেরই বয়স ২১ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে ছিল। এরপরে বেশি সংখ্যক ধর্ষণের ঘটনায় ৩১ থেকে ৪০ বছর (২১ দশমিক ৬ শতাংশ) এবং ১৭ থেকে ২০ বছর (১৩ দশমিক ৫ শতাংশ) বয়সীরা জড়িত ছিল। সবচেয়ে বেশি সংখ্যক (৩৭ শতাংশ) ধর্ষণের ঘটনায় বেকাররা জড়িত ছিল। এছাড়াও ধর্ষণে জড়িতদের মধ্যে শিক্ষার্থী (১৪ দশমিক ৩ শতাংশ), ব্যবসায়ী (১৪ দশমিক ৩ শতাংশ) ও রাজনৈতিক নেতাকর্মী (১০ দশমিক ৯ শতাংশ) উল্লেখযোগ্য। বর্তমানে সব রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মী মিলে যে পরিমাণ ধর্ষণের ঘটনার সাথে জড়িত তার পরিমাণ ১১ শতাংশের মতো। তার অর্থ হচ্ছে রাজনীতি করলে ধর্ষণ করার প্রবণতা নিঃশেষ হয়ে যায় না, যদিও তারা সংগঠিত শক্তি এবং নিদিষ্ট আচরণবিধি মেনে চলার কথা। আবার দেখা যায় যে, অপরাধটি সংঘটনের পর অনেক ক্ষেত্রে দোষীরা প্রচলিত শাস্তি এড়াতে রাজনৈতিক নেতাদের আশ্রয় নেওয়ার চেষ্টা করে।
হত্যা, ধর্ষণ ও নির্যাতনের মতো সহিংস অপরাধের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ ক্ষেত্রে ভিকটিম ও অপরাধীর মাঝে পূর্বপরিচয় ছিল। পরিচিতদের মধ্যে ভিকটিমের প্রতিবেশী বা এলাকার পরিচিত ছাড়াও ধর্ষণ সংঘটনে ঘনিষ্ঠ বন্ধু, কর্মক্ষেত্রের পরিচিত, শ্বশুরবাড়ির লোকজন, নিজ পরিবারের সদস্য, স্বামী, এবং নিকট আত্মীয়দের সংশ্লিষ্টতা দেখা যায়। ভিকটিমের পরিস্থিতিগত দুর্বলতা জানাও এ ধরনের অপরাধ সংঘটনে পরোক্ষ ভূমিকা রাখে। জরিপে অংশগ্রহণকারীরা ধর্ষণ সংঘটনের যেসকল কারণ চিহ্নিত করেছেন তা হলোÑ কথিত প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ বা ক্ষোভ থেকে অপরাধীর প্রতিশোধপরায়ণতা (৪০ দশমিক ৩ শতাংশ), অপরাধীর মাদকাসক্তি (৩০ দশমিক ৩ শতাংশ), অপরাধীর মনস্তাত্ত্বিক সমস্যা (২৮ দশমিক ৬ শতাংশ), ক্ষমতা প্রদর্শন (২১ শতাংশ), পরকীয়া (২০ দশমিক ২ শতাংশ), রাজনৈতিক কারণ (১৬ শতাংশ)।
বিবিসি বাংলার তথ্যমতে, দেশে ধর্ষণের বিচার হয় খুব কম, আর বেশির ভাগ ধর্ষণের ঘটনায় ধামাচাপা পড়ে যায়। অনেক ক্ষেত্রেই ভুক্তভোগীকে বিচার পেতে অনেক হয়রানির শিকার হতে হয়। বাংলাদেশ নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ অনুসারে যদি কোনো পুরুষ কোনো নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করেন, তাহা হইলে তিনি মৃত্যুদণ্ডে বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হইবেন এবং ইহার অতিরিক্ত অর্থদণ্ডেও দণ্ডনীয় হইবেন। কিন্তু অনেকাংশে এই দোষীরা শাস্তি থেকে রেহাই পেয়ে যায়, বা বিচার প্রক্রিয়া অনেক বিলম্বের কারণে ভিকটিম সঠিক বিচার থেকে বঞ্চিত হন। এর জন্য প্রতিনিয়ত ধর্ষণ সমাজে বৃদ্ধি পাচ্ছে।
প্রশাসনিক ও বিচারবিভাগীয় বিভিন্ন ত্রুটির কারণে প্রতিনিয়ত আমাদেরই মা-বোনেরা নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে তৃণমূল পর্যায়ের মানুষ, প্রত্যেকে নিপীড়নের শিকার হয় রাস্তা-ঘাটে। নারী তার পরিবার-পরিজনের সাথেও নিরাপদ থাকতে পারছে না। দিন দিন সমাজ একটা অসুস্থ পরিবেশে ঢুকে পড়ছে। অনেক সময় দেখা যায়, মানুষ গড়ার কারিগর শিক্ষকরাও প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এসবের সাথে জড়িত, যা অত্যন্ত ন্যক্কারজনক। আবার অনেক ক্ষেত্রে এসব সহিংসতা রোধ করতে গিয়ে বাবা-মা এমনকি শিক্ষকরাও প্রাণ হারাচ্ছেন।
সমাজের প্রত্যেককে সচেতন করা না গেলে, এই ব্যাধিকে নির্মূল করা সম্ভব নয়। প্রত্যেকটি সমস্যার সমাধান আছে। কোনো সমাধান এককভাবে, কোনোটা যৌথভাবে দমন করা প্রয়োজন। ধর্ষণ বা নারী উত্ত্যক্তকরণের মতো ঘটনা দমনে সমাজে প্রত্যেকটা মানুষের সাহায্য অপরিহার্য। অপরাধীকে শুধু শাস্তি দিলেই অপরাধ নির্মূল করা যায় না। এক্ষেত্রে সামাজিক ও নৈতিক শিক্ষার দরকার আছে। আধুনিকতার নামে এখন মানুষ ধর্মীয় অনুশাসনকে ভুলতে বসেছে। এই সমস্যা সমাধানের জন্য ধর্মীয় অনুশাসনের প্রয়োজন আছে। এক্ষেত্রে সরকারের পাশাপাশি জনগণের পদক্ষেপ গ্রহণ অপরিহার্য।
লেখক: প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট
মানবকণ্ঠ/আরএইচটি
Comments