Image description

তিন সপ্তাহ ধরে দেনদরবার চলেছে। লিভারপুল দুবার প্রস্তাব দিয়েছিল, প্রথমে ১০ কোটি ৯০ লাখ পাউন্ডের, পরে ১১ কোটি ৩০ লাখ পাউন্ডের। দুটি প্রস্তাবেই নিশ্চয়তা ছিল ১০ কোটি পাউন্ডের, বাকি অঙ্কটা শর্তসাপেক্ষ। নিশ্চয়তার অঙ্ক নিয়ে সমস্যা ছিল না, তবে শর্তসাপেক্ষ অঙ্কটার পরিমাণ আর সেসবের শর্ত নিয়ে সমঝোতা না হওয়ায় বায়ার লেভারকুসেন দুবারই লিভারপুলের প্রস্তাব বাতিল করে দেয়।

তবু লিভারপুল সমর্থকদের সম্ভবত তেমন দুশ্চিন্তা ছিল না। ইউরোপের ফুটবলে দলবদলবিষয়ক খবরের জন্য বিখ্যাত প্রায় সব সাংবাদিকই জানিয়ে রেখেছিলেন, ফ্লোঘিয়ান ভিয়ের্তশকে পেতে রেয়াল মাদ্রিদ, ম্যানচেস্টার সিটি, বায়ার্ন মিউনিখের আগ্রহ থাকলেও দৌড়ে শেষ পর্যন্ত টিকে ছিল শুধু লিভারপুলই। ১০ কোটি পাউন্ডের ‘নিশ্চিত অঙ্ক’ নিয়ে সমঝোতাও হয়ে যাওয়ায় বাকিটা নিয়ে সমঝোতা শুধু সময়ের ব্যাপার বলেই জানা গিয়েছিল।

সেই সমঝোতাও অবশেষে হয়ে গেছে দুই পক্ষে। বিবিসি, ইএসপিএন, ইংল্যান্ডের দ্য টাইমসসহ প্রায় সব সংবাদমাধ্যমই জানাচ্ছে, ফ্লোঘিয়ান ভিয়ের্তশকে পেতে ১১ কোটি ৬০ লাখ পাউন্ডে সমঝোতা হয়ে গেছে লিভারপুল আর লেভারকুসেনের। বাংলাদেশি মুদ্রায় অঙ্কটা প্রায় ২০০০ কোটি টাকা!

তবে আগের দুই প্রস্তাবের মতোই এই প্রস্তাবেও লেভারকুসেনকে ১০ কোটি পাউন্ডের নিশ্চয়তা (গ্যারান্টিড পেমেন্ট) দিয়েছে লিভারপুল। বাকি ১ কোটি ৬০ লাখ পাউন্ড শর্তসাপেক্ষ (অ্যাড-অন), যা ক্লাব হিসেবে লিভারপুল ও ক্লাবটিতে ভিয়ের্তশের পারফরম্যান্সের বিভিন্ন সূচকের ওপর নির্ভর করবে। লিভারপুল-এভারটনের মতো ক্লাবের খবরের ক্ষেত্রে বিশ্বস্ত সাংবাদিক পল জয়েস দ্য টাইমসের প্রতিবেদনে লিখেছেন, শর্তগুলো এমন যে, ইংল্যান্ড ও ইউরোপে বড় টুর্নামেন্টগুলোতে লিভারপুল ও ভিয়ের্তশের পারফরম্যান্স টানা ভালো হলেই কেবল ওই অঙ্কের পুরোটা পাবে লেভারকুসেন।

তবে ১০ কোটি পাউন্ডের ‘নিশ্চয়তা’তেই লিভারপুলের ইতিহাসে সবচেয়ে দামি খেলোয়াড় হয়ে যাচ্ছেন ভিয়ের্তশ। এর আগে লিভারপুলের ইতিহাসে সবচেয়ে দামি খেলোয়াড় ছিলেন দারউইন নুনিয়েস, যদিও ২০২২ সালে তাঁকে কেনার সময়ে লিভারপুলের খরচ হিসেবে যে ৮ কোটি ৫০ লাখ পাউন্ড বলা হয়েছিল সংবাদমাধ্যমে, তার মধ্যে ২ কোটি ১০ লাখ পাউন্ডই ছিল শর্তসাপেক্ষ (যার সবটুকু পূরণ হয়নি বলেই ধারণা)।

আর যদি সব শর্ত পূরণ হওয়ায় বাকি ১ কোটি ৬০ লাখ পাউন্ডও লেভারকুসেনের একাউন্টে পাঠাতে বাধ্য হয় লিভারপুল, সে ক্ষেত্রেই কেবল দলবদলটা ইংলিশ ফুটবলেই এ যাবতকালের সবচেয়ে দামি দলবদল হবে।

তা ইউরোপের এই সময়ের সবচেয়ে প্রতিভাবান প্লেমেকারদের একজন, বয়সের হিসেবে যাঁর ক্যারিয়ারের সম্ভাব্য সবচেয়ে সেরা সময়টা আগামী পাঁচ-ছয় বছরই হতে যাচ্ছে, যাঁকে পেতে ইউরোপের সেরা সব ক্লাব উন্মুখ ছিল – এমন একজনের জন্য এ দাম যথাযথ কি না, সে বিতর্কে ভোটটা লিভারপুলের পক্ষে যাওয়ারই সম্ভাবনা বেশি!

ভিয়ের্তশকে পেতে কার সঙ্গে লড়াই করতে হয়নি লিভারপুলকে! এবং কী অবিশ্বাস্য পরিস্থিতি থেকে দলবদলটা ঘুরিয়ে ফেলেছেন লিভারপুলের স্পোর্টিং ডিরেক্টর রিচার্ড হিউজেস ও ডিরেক্টর অব ফুটবল মাইকেল এডওয়ার্ডস! সঙ্গে যোগ হয়েছে কোচ আর্নে স্লটের বিশ্লেষণভিত্তিক দারুণ প্রেজেন্টেশন, যেখানে ভিয়ের্তশকে কীভাবে খেলানো হবে এবং আগামী বছরগুলোতে তাঁকে ঘিরেই কীভাবে লিভারপুল দলটা সাজবে সে ব্যাপারে পুঙ্খানুপুঙ্খ ধারণা দেওয়া হয়েছিল। দ্য অ্যাথলেটিক থেকে শুরু করে টাইমস… ইউরোপের বিখ্যাত সব সংবাদমাধ্যমেই ভিয়ের্তশের ব্যাপারে বলা হয়, ভিয়ের্তশ আর তাঁর বাবা টাকা-পয়সার চেয়ে তাঁর ক্যারিয়ারের অগ্রগতিবিষয়ক বিশ্লেষণভিত্তিক এমন পরিকল্পনাকেই সব সময় তাঁর ক্যারিয়ারের পরিকল্পনায় গুরুত্ব দিয়েছেন বেশি।    

এই মে মাসের শুরুতেও জার্মানিতে ধারণা ছিল, ফ্লোঘিয়ান ভিয়ের্তশ বায়ার্ন মিউনিখেই যাচ্ছেন। ২২ বছর বয়সী জার্মান প্লেমেকারের বাবা – যিনি আবার ভিয়ের্তশের এজেন্টও – হানস-ইওয়াখিম ভিয়ের্তশের সঙ্গে বায়ার্নের আলংকারিক সভাপতি উলি হোভেনেসের সম্পর্ক ভালো, এর জেরে বায়ার্ন – এবং জার্মানিতে – ভিয়ের্তশের পরবর্তী ক্লাব নিয়ে সংশয় তেমন একটা ছিল না।

কিন্তু বায়ার্নের অতি-আত্মবিশ্বাসই শেষ পর্যন্ত কাল হলো তাদের জন্য। তাদের দিক থেকে আগেভাগেই সংবাদমাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া হলো যে, ভিয়ের্তশ বায়ার্নেই যাচ্ছেন। বায়ার্ন ভেবেছিল, এতে লেভারকুসেনকে চাপে ফেলে দাম কমাতে বাধ্য করা যাবে। এ ব্যাপারে ১৮ মে পর্যন্ত নাকি ভিয়ের্তশের বাবার সঙ্গে সেভাবে আলোচনাই করেনি বায়ার্ন! অথচ ভিয়ের্তশ ও তাঁর বাবা দলবদলের আগে আগ্রহী সব পক্ষের সঙ্গে বিস্তারিত আলাপে আগ্রহী ছিলেন।

ওদিকে লেভারকুসেন চায়নি, তাদের দলের সেরা খেলোয়াড় জার্মানিতেই তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী কোনো ক্লাবে যাক, ভিয়ের্তশ সেদিকটি নিয়ে ভেবেছেন। তা ছাড়া বায়ার্ন কোচ ভাঁনস কম্পানিও বায়ার্নে জামাল মুসিয়ালা ও ভিয়ের্তশকে কীভাবে একসঙ্গে খেলাবেন, সে ব্যাপারে পরিষ্কার ধারণা দিতে পারেননি। কম্পানির পরিকল্পনার সঙ্গে নাকি বায়ার্নের কর্তাব্যক্তিরা একমত ছিলেন না। সব মিলিয়ে বায়ার্নকে ‘রিজেক্ট’ করে দেন ভিয়ের্তশ।

ম্যানচেস্টার সিটি ভিয়ের্তশকে পেতে আগ্রহী ছিল। ভিয়ের্তশও প্রাথমিকভাবে আগ্রহী ছিলেন পেপ গার্দিওলার সঙ্গে কাজ করতে। কেভিন ডি ব্রুইনার জায়গায় ভিয়ের্তশকে আদর্শ বিকল্প হিসেবেও ভেবে রেখেছিল সিটি। তবে সিটির সঙ্গে আলোচনায় যখন ভিয়ের্তশ প্রশ্ন করেন সিটিতে গার্দিওলা কতদিন থাকবেন (গার্দিওলার চুক্তি শেষ ২০২৭-এ), সে প্রশ্নের উত্তর পাননি। ফল? যদিও সিটির দিক থেকে দাবি করা হয়েছে, ভিয়ের্তশকে কেনার প্রকল্পে খরচ তাদের কাছে বেশি মনে হওয়ায় তারা আর আগ্রহী নয়, দ্য টাইমস জানাচ্ছে, ভিয়ের্তশই মূলত সিটিকে ‘না’ বলে দিয়েছেন।

রেয়াল মাদ্রিদের আগ্রহের কথা শোনা গিয়েছিল। লেভারকুসেনে ভিয়ের্তশের কোচ শাবি আলোনসোই এখন মাদ্রিদের কোচ বলে আলোচনাটা এগিয়েছে। তবে মাদ্রিদের স্কোয়াডে এই মুহূর্তে একজন অ্যাটাকিং প্লেমেকারের চেয়েও রক্ষণ ও মাঝমাঠের অন্য জায়গায় খেলোয়াড়ের দরকার বেশি। মাদ্রিদ চেয়েছিল, ভিয়ের্তশ লেভারকুসেনে চুক্তি নবায়ন করে আরেক বছর থেকে যান, যে চুক্তিতে একটা ‘রিলিজ ক্লজে’র ব্যবস্থাও থাকবে। কিন্তু ভিয়ের্তশ লিভারপুলের সঙ্গে কথা বলার পর তাদের পরিকল্পনা মনে ধরায়, পাশাপাশি তাঁর চোখে সেরা লিগ প্রিমিয়ার লিগে খেলার সম্ভাবনা তৈরি হওয়ায় লেভারকুসেনে চুক্তি নবায়ন নিয়ে অত গা করেননি।

ফল? দৌড়ে শেষ পর্যন্ত থাকল শুধু লিভারপুল! তিন সপ্তাহ ধরে লেভারকুসেনের সঙ্গে চুক্তি নিয়ে আলোচনা হয়েছে তাদের। গ্যারান্টিড পেমেন্টের ১০ কোটি পাউন্ড নিয়ে সমঝোতা আগেই হয়ে গিয়েছিল, ‘অ্যাড অনে’র শর্ত নিয়েই যা দেনদরবার হয়েছে। অবশেষে লিভারপুল সমর্থকদের স্বস্তির খবর হয়ে সব দেনদরবারে সমঝোতার খবরই এল। এখন শুধু মেডিক্যালে ভিয়ের্তশের পাস করার অপেক্ষা। তাঁর সঙ্গে লিভারপুল প্রাথমিকভাবে পাঁচ বছরের চুক্তি করতে যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন দ্য অ্যাথলেটিকের ডেভিড অর্নস্টেইন।