
আত্মনির্ভরশীল জীবন গড়ার জন্য সঞ্চয় ও মিতব্যয়ীতার গুরুত্ব অপরিসীম। তবে এই গুণ দুটিকে অনেকেই কৃপণতার সঙ্গে গুলিয়ে ফেলেন। অথচ সঞ্চয় ও কৃপণতা দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন ধারণা। সঞ্চয় যেখানে ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুতি, সেখানে কৃপণতা একটি নিন্দনীয় স্বভাব যা ব্যক্তি ও সমাজ উভয়ের জন্যই ক্ষতিকর। ইসলামে সঞ্চয়কে উৎসাহিত করা হলেও কৃপণতাকে কঠোরভাবে নিন্দা করা হয়েছে।
সঞ্চয় মানে হলো জীবনের জরুরি প্রয়োজনগুলো পূরণের পাশাপাশি ভবিষ্যতের জন্য কিছু সম্পদ জমা রাখা। এটি একটি বুদ্ধিমানের কাজ যা মানুষকে অপ্রত্যাশিত বিপদ বা আর্থিক সংকটের সময় নিরাপত্তা দেয়। অন্যদিকে, কৃপণতা হলো প্রয়োজনের সময়ও খরচ করতে অনীহা প্রকাশ করা। কৃপণ ব্যক্তি নিজেকেও কষ্ট দেয় এবং অন্যের প্রয়োজনেও এগিয়ে আসতে চায় না। এর ফলে সে শুধু নিজের ক্ষতিই করে না বরং সমাজের প্রতি তার দায়িত্ব থেকেও দূরে সরে যায়।
পবিত্র কুরআন ও হাদিসে কৃপণতার বিরুদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছে। কৃপণতা যে শুধু ব্যক্তিগত একটি মন্দ স্বভাব নয় বরং এর সামাজিক ও আধ্যাত্মিক পরিণতিও ভয়াবহ তা বিভিন্ন হাদিসে স্পষ্ট। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, "তোমরা কৃপণতা থেকে বেঁচে থাক, কেননা, তোমাদের পূর্ববর্তীদেরকে এ কৃপণতাই ধ্বংস করেছে। তাদেরকে তাদের কার্পণ্য নির্দেশ দিয়েছে কৃপণতা করার ফলে তারা কৃপণতা করেছে। অনুরূপভাবে তাদেরকে আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করার নির্দেশ দিয়েছে ফলে তারা তা ছিন্ন করেছে এবং তাদেরকে অশ্লীলতার নির্দেশ দিয়েছে ফলে তারা অশ্লীল কাজ করেছে।" (আবু দাউদ, হাদিস: ১৬৯৮)। এই হাদিস থেকে বোঝা যায়, কৃপণতা মানুষকে একের পর এক মন্দ কাজের দিকে ধাবিত করে।
ইসলামে অন্যের প্রতি দয়া ও সহানুভূতি প্রদর্শনের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। রাসুল (সা.) বলেছেন, "নিশ্চয়ই আল্লাহ তার প্রতি দয়া করেন, যে তার বান্দাদের প্রতি দয়া করে।" (বুখারি, হাদিস: ১৭৩২)। এছাড়াও তিনি বলেছেন, "আল্লাহ তায়ালা বান্দার সাহায্যে ততক্ষণ থাকেন, যতক্ষণ সে অপর ভাইয়ের সাহায্যে থাকে।" (মুসলিম, হাদিস: ২৩১৪)। এই হাদিসগুলো প্রমাণ করে, অন্যের উপকারে এগিয়ে আসা শুধু একটি ভালো কাজই নয়, বরং এটি আল্লাহর সাহায্য পাওয়ার একটি মাধ্যম।
দান না করা এবং কৃপণতার জন্য রাসুল (সা.)-এর একটি হাদিসে কঠোর বার্তা এসেছে। তিনি বলেছেন, "প্রতিদিন ভোর বেলায় দু’জন ফিরিশতা অবতরণ করেন। তাদের একজন বলেন, হে আল্লাহ! সৎপথে ব্যয়কারীদেরকে শুভ প্রতিদান দান করুন। আর অন্যজন বলেন, হে আল্লাহ! কৃপণকে ধন-সম্পদের দিক দিয়ে ধ্বংসের সম্মুখীন করে দিন।" (বুখারি, হাদিস: ১৪৪২)।
পবিত্র কুরআনেও কৃপণদের নিন্দা করে বলা হয়েছে, "যারা কৃপণতা করে এবং মানুষকে কৃপণতার নির্দেশ দেয়; আর গোপন করে তা, যা আল্লাহ তাদেরকে স্বীয় অনুগ্রহে দান করেছেন। আর আমি প্রস্তুত করে রেখেছি কাফিরদের জন্য লাঞ্ছনাকর আজাব।" (সুরা নিসা, আয়াত: ৩৭)। এই আয়াতটি কৃপণতাকে শুধু একটি ব্যক্তিগত ত্রুটি হিসেবে নয় বরং আল্লাহর অনুগ্রহের প্রতি অকৃতজ্ঞতা এবং এক ধরনের অবিশ্বাসের সমতুল্য হিসেবে উপস্থাপন করে।
সুতরাং, সঞ্চয় এবং কৃপণতার মধ্যে পার্থক্য বোঝা অত্যন্ত জরুরি। সঞ্চয় যেখানে একটি সুস্থ ও নিরাপদ জীবনের জন্য অপরিহার্য, সেখানে কৃপণতা একটি নৈতিক ও আধ্যাত্মিক ব্যাধি যা ব্যক্তি ও সমাজ উভয়কেই ক্ষতিগ্রস্ত করে।
Comments