Image description

পবিত্র রমজান মাসে তাকওয়ার গুণ অর্জন করা নেককার মুমিন মুসলমানরা ঈদুল ফিতর পালনের পর বছরজুড়ে রোজার সওয়াব লাভে শাওয়ালের ৬ রোজা পালন করে থাকেন। শাওয়ালের ৬ রোজা অনেক ফজিলতপূর্ণ আমল। এ রোজার ব্যাপারে অনেক উৎসাহমূলক বর্ণনা রয়েছে হাদিস শরিফে। 

শাওয়ালের ছয় রোজার বিধান
অধিকাংশ ওলামায়ে কেরামের মতে শাওয়াল মাসের ৬টি রোজা রাখা মোস্তাহাব। এ রোজাগুলো লাগাতার অথবা ভেঙে ভেঙে আদায় করা যায়। হজরত ইবনে মোবারক (র.) বলেন, প্রতি মাসের ৩ দিন রোজা রাখার মতো শাওয়ালের ৬ দিন রোজা রাখাও ভালো আমল। শাওয়ালের রোজার ব্যাপারে একাধিক হাদিসে উৎসাহমূলক বক্তব্য এসেছে। রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি রমজানের রোজা রাখল অতঃপর শাওয়ালের ছয়টি রোজা রাখল, সে যেন সারা বছরই রোজা রাখল।’ (মুসলিম: ১১৬৪; আবু দাউদ: ২৪৩৩)

শাওয়ালের ৬ রোজা কখন রাখবেন
বিজ্ঞ ফিকহবিদ ও আলেমদের অভিমত হলো— ঈদের দিনটি বাদ দিয়ে শাওয়াল মাসের যেকোনো ছয়দিনে রোজা রাখলেই হবে। ধারাবাহিকভাবেও এই ছয়টি রোজা রাখা যাবে, আবার বিরতি দিয়ে দিয়ে ছয়টি রোজা পূরণ করতে পারলেও হাদিসে বর্ণিত সওয়াব পাওয়া যাবে। তবে যত তাড়াতাড়ি আদায় করা যায় তত ভালো। কেননা আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তারাই দ্রুত সম্পাদন করে কল্যাণকর কাজ এবং তারা তাতে অগ্রগামী হয়।’ (সুরা মুমিনুন: ২৮) আরও ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমরা তোমাদের রবের পক্ষ থেকে ক্ষমা এবং এমন জান্নাতের দিকে দ্রুত ধাবিত হও, যার প্রশস্ততা হবে আকাশসমূহ ও জমিনসম। তা মুত্তাকিদের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে।’ (সুরা আলে ইমরান: ১৩৩)

শাওয়ালের ৬ রোজা কাজা রোজার আগে নাকি পরে?

যাদের ভাংতি রোজা আছে, অসুস্থতা কিংবা নারীদের হায়েজ-নেফাসের কারণে রমজানের রোজা অপূর্ণ থাকে, তাদের জন্য নিয়ম ও করণীয় হলো—‘শাওয়াল মাসে তাদের ভাংতি রোজাগুলো আগে পূর্ণ করে নেবে। তারপর তারা শাওয়ালের ৬ রোজা পালন করবে। কেননা ‘..যার ওপর কাজা রয়ে গেছে সে রোজা পুর্ণ করেছে বলে গণ্য হবে না যতক্ষণ ওই রোজাগুলোর কাজা আদায় না করে।’ (আল মুগনি: ৪৪০) সুতরাং আগে রমজানের রোজা পূর্ণ করবে, তারপর শাওয়ালের ৬ রোজা রাখবে—তবেই সারাবছর রোজা রাখার সওয়াব মিলবে। 

অনেকের রমজানের কাজা পূরণ করতে সারামাস লেগে যেতে পারে (যেমন নেফাসগ্রস্ত নারী যদি পুরো রমজানে একটি রোজাও না রাখতে পারেন), তাদেরকে পুরো শাওয়াল মাসে কাজা রোজা রাখতে হবে। তারা জিলকদ মাসে শাওয়ালের ৬ রোজা রাখতে পারবে এবং শাওয়ালের বিশেষ ফজিলতও পাবে। কেননা সে শরিয়তসম্মত ওজরের কারণে বাধ্য হয়ে এই বিলম্ব করেছে। (ফতোয়া সমগ্র ১৯/২০, ফতোয়া নং-৪০৮২ ও ৭৮৬৩)

তবে, আরেকদল আলেমের মতে, কাজা রোজার সংখ্যা বেশি হয়ে গেলে আগে শাওয়ালের ৬ রোজা রাখা উত্তম। কেননা শাওয়াল শেষ হয়ে গেলে অন্যমাসে এই ৬ রোজার ফজিলত নেই। কিন্তু কাজা রোজা বছরের যেকোনো সময় রাখলেই আদায় হয়ে যায়।

শাওয়ালের ৬ রোজার ফজিলত

শাওয়ালের ছয় রোজার ফজিলত বিশুদ্ধ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত। আবু আইয়ুব আনসারি (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, যে ব্যক্তি রমজান মাসের ফরজ রোজাগুলো রাখল, অতঃপর শাওয়াল মাসে আরও ছয়টি রোজা রাখল, সে যেন সারাবছর ধরেই রোজা রাখল। (সহিহ মুসলিম: ১১৬৪) অন্য হাদিসে এসেছে, যে ব্যক্তি রমজানের রোজা শেষ করে ছয়দিন রোজা রাখবে, সেটা তার জন্য পুরোবছর রোজা রাখার সমতুল্য। (আহমদ: ২৮০, দারেমি: ১৭৫৫)

হাদিসগুলোতে বিশেষ লক্ষণীয় বিষয়টি হলো—আলাদাভাবে শাওয়াল মাসের ছয়টি রোজায় কিংবা পুরো রমজানের রোজায় একবছর নফল রোজার সওয়াব দেওয়া হবে না, বরং পুরো রমজান মাস রোজা রাখার পরে শাওয়াল মাসে আরও ছয়টি রোজা রাখলে তবেই পূর্ণ একবছর নফল রোজা রাখার সওয়াব লাভ হবে।

বস্তুত হাদিসগুলো পবিত্র কোরআনের একটি আয়াতের সঙ্গে মিলে যায়। আয়াতটি হলো, ‘কেউ কোনো নেক আমল করলে, তাকে তার দশ গুণ সওয়াব প্রদান করা হবে।’(সুরা আনআম: ১৬০) রমজানের এক মাসের দশগুণ হলো ১০ মাস আর শাওয়াল মাসের ছয়দিনের দশগুণ হলো ৬০ দিন অর্থাৎ দুইমাস। সুতরাং ৩৬টি রোজায় সারা বছর বা ৩৬০টি রোজা রাখার সওয়াব পাওয়া যায়।

তবে, এরকম শর্ত থাকলেও শরিয়তসম্মত কারণে রমজানের পূর্ণমাস রোজা রাখেননি—এমন লোকদের  শাওয়াল মাসের ছয় রোজা রাখাতে মানা নেই। বরং সেক্ষেত্রে নফল রোজার সীমাহীন নেকি তিনি পাবেন, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কেননা নবীজি (স.) বেশিবেশি নফল রোজা নিজে তো রাখতেনই, সাহাবিদেরকেও উৎসাহিত করতেন। নফল রোজার মধ্যে আছে সাপ্তাহিক দুই রোজা (সোমবার ও বৃহস্পতিবার), মাসিক তিন রোজা (আইয়ামে বীজ তথা চন্দ্রমাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখের রোজা), মহররম ও আশুরার রোজা, শাবান মাসের রোজা, শাওয়ালের ছয় রোজা, জিলহজ মাসের প্রথম দশকের রোজা বিশেষ করে ৯ তারিখের রোজার বিশেষ গুরুত্ব ও ফজিলত বর্ণনা করতেন প্রিয়নবী (স.)।

নফল ইবাদতের সীমাহীন গুরুত্ব বর্ণনায় পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘যখন তুমি (ফরজ) দায়িত্ব সম্পন্ন করবে তখন উঠে দাঁড়াবে এবং তুমি (নফলের মাধ্যমে) তোমার রবের প্রতি অনুরাগী হবে।’ (সুরা ইনশিরা: ৭-৮)

শাওয়ালের ছয় রোজার বিশেষ গুরুত্ব

হজরত উবাইদুল্লাহ (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, একদিন রাসুল (স.)-কে জিজ্ঞেস করলাম, ‘ইয়া রাসুলুল্লাহ আমি কি সারা বছর রোজা রাখতে পারব? তখন রাসুলুল্লাহ (স.) বললেন—তোমার ওপর তোমার পরিবারের হক রয়েছে, কাজেই তুমি সারা বছর রোজা না রেখে রমজানের রোজা রাখো এবং রমজানের পরবর্তী মাস শাওয়ালের ছয় রোজা রাখো, তাহলেই তুমি সারা বছর রোজা রাখার সওয়াব পাবে’ (তিরমিজি: ১/১৫৩৪)।

উল্লেখ্য, শাওয়ালের ৬ রোজায় বছরজুড়ে রোজা রাখার ফজিলত ওই ব্যক্তির জন্যই কার্যকর হবে, যে ব্যক্তি রমজান মাসজুড়ে ফরজ রোজা আদায় করেছেন, একইসঙ্গে শাওয়ালের রোজাও পালন করেন। তাই বিজ্ঞ আলেমদের মতে, রমজানের কাজা থাকলে তা আগে আদায়ের পর শাওয়ালের ৬ রোজা রাখা জরুরি। অন্যথায় সারাবছর কিংবা ৩৬০টি রোজার হিসাব মিলবে না। 

মানবকণ্ঠ/এআই