Image description

দেশের উত্তরের সীমান্তবর্তী জেলা কুড়িগ্রামে একের পর এক কৃষিজমি চলে যাচ্ছে ইটভাঁটার দখলে। সরকারি কোনো নিয়মনীতির পরোয়াই করছেন না জেলার ভাঁটা মালিকরা। না আছে অধিদফতরের ছাড়পত্র, না আছে ইট পোড়ানোর লাইসেন্স, না আছে ফায়ার সার্ভিসের সার্টিফিকেট। এমনকি ভ্যাট-আয়কর প্রদানের কাগজপত্র ছাড়াই অবাধে ভাঁটা চালিয়ে যাচ্ছেন মালিকরা। এরই মধ্যে জেলাজুড়ে এ রকম অবৈধ ইটভাঁটা গড়ে উঠেছে ১১১টি। সবকটি ভাঁটার অবস্থানই আবার আবাদি জমির ওপর, জনবসতির মাঝে। ভাঁটাগুলোর অতি নিকটেই আবার স্কুল-কলেজসহ নানা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। 
পরিবেশ অধিদফতর সূত্র মতে, কুড়িগ্রাম জেলায় মোট ১১১টি ইটভাঁটা অবৈধভাবে কৃষিজমিতে গড়ে তোলা হয়েছে। মাত্র ২১টি ইটভাঁটার কাগজপত্র হালনাগাদ আছে। ২০ থেকে ২৫টি ইটভাঁটার মালিক আবেদন করেছেন। তবে ৫১টি ইটভাঁটার নেই কোনো ধরনের কাগজই।
জনবসতিপূর্ণ এলাকায় অবস্থিত এই শতাধিক ভাঁটায় ইট পোড়ানোর কাজ চলে রাত-দিন। ২৪টি জনবসতি ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাশে এভাবে অবাধে ইটভাঁটা গড়ে ওঠায় বিষাক্ত ছাই, কালো ধোঁয়ায় হুমকির মুখে পড়ে গেছে পরিবেশ, যার খেসারত দিতে হচ্ছে পুরো জেলার জনসাধারণকে। ভাঁটা মালিকদের বেপরোয়া ভাবের কারণে চরম স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়েছে পার্শ্ববর্তী এলাকাগুলোর শিক্ষার্থীসহ হাজারো মানুষ। আর ফসলি জমির ওপর অবস্থান সরাসরি প্রভাব পড়ছে ফলনে।
দীর্ঘমেয়াদি উর্বরতা হারানোর কারণে ফলন হ্রাসের আশঙ্কায় পড়েছেন কৃষকরা। হুমকির মুখে পড়ে গেছে শত শত একর জমির আমন ও বোরো এবং রবিশস্য আবাদ। গত কয়েক দিনের সরেজমিন অনুসন্ধানে জানা যায়, জেলার ফুলবাড়ী উপজেলার কাশিপুর ইউনিয়নের আজোয়াটারী গ্রামের বিস্তীর্ণ কৃষিজমিতে মেসার্স ডব্লিউএএইস ব্রিকস ফিল্ড, এবি ব্রিকস, মেসার্স এমএসএইচ ব্রিকস, বড়ভিটা ইউনিয়নের নওদাবশ এলাকায় সাইফুর রহমান সরকারি কলেজের পাশে মেসার্স এএমবি, ফুলবাড়ী সদর ইউনিয়নের খামারের বাজার এলাকায় মেসার্স কেএমবি এবং শিমুলবাড়ী ইউনিয়নের জকুরটল এলাকায় মেসার্স জেএমএস নামে ছয়টি ইটভাঁটা গড়ে উঠেছে। এসব ইটভাঁটার একটিরও নেই পরিবেশ অধিদফতরের ছাড়পত্র। পরিবেশ অধিদফতরে নামমাত্র আবেদন করে শুধু সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদ থেকে ট্রেড লাইসেন্স নিয়ে চলছে ইট পোড়ানোর কাজ। শুধু তাই নয়, ইটভাঁটার আয়তন দুই একরের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার নিয়ম থাকলেও বিস্তৃত এলাকা দখলে নিয়েছেন ভাঁটা মালিকরা। ভরাট করেছেন পানি নিষ্কাশনের পথ। 
একই চিত্র জেলার ভূরুঙ্গামারী, নাগেশ্বরী, কুড়িগ্রাম সদর, রাজারহাট, উলিপুর, চিলমারীসহ রৌমারী ও রাজীবপুর উপজেলার শতাধিক ইটভাঁটার। ভাঁটা-সংলগ্ন স্থানীয়দের অভিযোগ, ইটভাঁটার মালিকরা প্রভাবশালী হওয়ায় সরকারি নিময়নীতির কোনো তোয়াক্কা করেন না তারা। তাদের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেয় না প্রশাসন। 
ফুলবাড়ী ও নাগেশ্বরী উপজেলার একাধিক কৃষক জানান, ভাঁটা মালিকরা জমি ভাড়া নিয়ে ইট পোড়ানোর কাজ করছেন। এসব ইটভাঁটার বিষাক্ত ধোঁয়ায় গত ৫ বছর ধরে বোরো এবং আমন আবাদের ফলন বিঘাপ্রতি ৬-৭ মণ কমে এসেছে। ভাঁটার কালো ধোঁয়া সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করছে এখানকার সুপারি বাগানের। ধোঁয়ার বিষক্রিয়ায় কয়েক বছর ধরে এই এলাকায় সুপারির ফলন ব্যাপকভাবে কমে গেছে। তা ছাড়া আম, কাঁঠাল, নারিকেলসহ বিভিন্ন ফলের ফলনও কমে গেছে। এ ছাড়া ভাঁটার মালিকরা ইট পরিবহনের জন্য উঁচু রাস্তা তৈরি করে বন্ধ করে দিয়েছেন পানি নিষ্কাশনের মুখ। এতে প্রতি বর্ষা মৌসুমেই পানিতে তলিয়ে নষ্ট হচ্ছে এই এলাকার শত শত বিঘা আমন ক্ষেত। 
এ প্রসঙ্গে ফুলবাড়ী উপজেলার মেসার্স ডব্লিউএএইচ ব্রিকস ফিল্ডের মালিক মোশারফ হোসেন জানান, শুধু আমার ভাঁটার নয়, জেলার কোনো ইটভাঁটারই পরিবেশ অধিদফতরসহ আনুষঙ্গিক কোনো কাগজপত্র নেই। প্রতি বছর মালিক সমিতির লোকজনসহ ডিসি অফিসে কথা বলেছি। তারা ভাঁটা চালানোর মৌখিক অনুমতি দিয়েছে।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) সুমন দাস জানান, ইতিমধ্যেই কয়েকটি ভাঁটায় ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হয়েছে। কোনো ভাঁটা কর্তৃপক্ষই উপযুক্ত কাগজপত্র দেখাতে পারেনি। তাই তাদেরকে নির্দিষ্ট সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছে। সময় মতো কাগজ দেখাতে না পারলে অবৈধ ইটভাঁটাগুলোর বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। 
এ বিষয়ে কুড়িগ্রাম পরিবেশ অধিদফতরের সহকারী পরিচালক রেজাউল করিম বলেন, ‘এ জেলায় মোট ১১১টি ইটভাঁটা অবৈধভাবে কৃষিজমিতে গড়ে তোলা হয়েছে। এর মধ্যে ৫১টি ইটভাঁটার কোনো ধরনের বৈধ কাগজ নেই। বাকিগুলো নামমাত্র ট্রেড লাইসেন্সে চলছে। বিষয়টি জেলা প্রশাসকসহ ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে।