Image description

নতুনভাবে ঘুরে দাঁড়ানোর পরিকল্পনা নিয়েছে জাতীয় পার্টি। এ লক্ষ্যে সারাদেশের তৃণমূল নেতাদেরকে বর্ধিত সভার মাধ্যমে আহŸান জানিয়েছে দলটির হাইকমান্ড। এ বিষয়ে দলের চেয়ারম্যান জিএম কাদের ও মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নুর বার্তা নিয়ে মাঠে কাজ করার অঙ্গীকার করেছেন তৃণমূল জাতীয় পার্টিসহ কেন্দ্রীয় নেতারা। একই সঙ্গে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ব্যর্থতার রেশ কাটিয়ে রাজনীতির মাঠে নিজেদের শক্ত অবস্থানের কথাটিও পুরোদমে জানান দিতে চায় জাতীয় পার্টি। এ লক্ষ্যকে সামনে রেখে কেন্দ্র থেকে শুরু করে তৃণমূল পর্যায়ে সংগঠন গোছানোর কাজটিকে প্রাধান্য দিয়েছেন তারা।

এদিকে নিজেদেরকে গুছিয়ে তোলার পদক্ষেপ হিসেবে নির্বাচনের তিন মাসের মাথায় এসে কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির বর্ধিত সভা করে জাতীয় পার্টি। গত ২৭ এপ্রিল শনিবার সকাল ১০টায় রাজধানীর রমনায় অবস্থিত ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে এই সভা অনুষ্ঠিত হয়। দলটির চেয়ারম্যান ও বিরোধীদলীয় নেতা জিএম কাদের এমপি এতে সভাপতিত্ব করেন। জাতীয় পার্টির মহাসচিব ও বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ মো. মুজিবুল হক চুন্নু এমপি দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যদের পাশাপাশি জেলা, উপজেলাসহ সব পর্যায়ের শীর্ষ নেতা (সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক) উপস্থিত ছিলেন। এমনকি জাতীয় পার্টির বিভিন্ন অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদকরা  সেই সভায় অংশ নেন। সভায় দলের সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান, কো-চেয়ারম্যানবৃন্দ, প্রেসিডিয়াম সদস্য, চেয়ারম্যানের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্যসহ কেন্দ্র থেকে তৃণমূল-সব পর্যায়ের নেতাদের উপস্থিতিতে আগামী দিনের রাজনীতির পথ পরিক্রমা ঠিক করে জাতীয় পার্টি। বিশেষ করে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন-পরবর্তী ক্ষোভ-হতাশা কাটিয়ে দেশের চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে নিজেদের করণীয় নিয়েও আলোচনা স্থান পায় বিস্তরভাবে। 

সভায় সেইদিন সারাদেশে জাতীয় পার্টির করুণদশার কথা জানিয়েছেন দলটির বিভাগীয় ও জেলা পর্যায়ের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকরা। এমনকি এই করুণদশা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য পার্টির চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ কাদেরকে দলীয় সিদ্ধান্তের বিষয়ে বৌয়ের কথা না শোনার পরামর্শ দিয়েছিলেন তারা। সেইসঙ্গে মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নুকে শুধুমাত্র বনানীর কার্যালয়ে বসে না থেকে দলীয় কার্যক্রম পরিচালনার জন্য সারাদেশ সফরেরও পরামর্শ দেন নেতারা।

বিভাগীয় ও জেলা পর্যায়ে নেতারা বলেছিলেন, দলের নেতৃত্ব ও পরিস্থিতি যে পর্যায় চলে গেছে তাতে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জাপার অস্তিত্ব ধরে রাখা কঠিন হয়ে পড়বে। ভরাডুবি হবে নিশ্চিত। গত ২৭ পার্টির বর্ধিত সভায় সারাদেশ থেকে আসা নেতারা এই পরামর্শ দেন।

এ সময় মঞ্চে দলটির চেয়ারম্যান জিএম কাদের, মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু, কো-চেয়ারম্যান এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদারসহ ২৪ জন কেন্দ্রীয় নেতা মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন। সভায় উপস্থিত হওয়া নেতারা গতকাল মানবকণ্ঠকে এতথ্য জানায়। 

বর্ধিত সভায় খুলনা জেলা জাতীয় পার্টির সভাপতি শফিকুল ইসলাম মধু বলেছিলেন, ‘পার্টির কিছু নেতা রয়েছেন যারা সুযোগ সন্ধানী। এই সুযোগ সন্ধানী নেতারা রাজনীতির মাঠে না থেকেও বার বার এমপি-মন্ত্রীও হয়েছেন। সেজন্য জাপার প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান প্রায়ত হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ মনোকষ্ট নিয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন।

দলের সার্বিক পরিস্থিতির বর্ণনা দিয়ে চেয়ারম্যানের উদ্দেশে তিনি সেই সময় বলেছিলেন, ‘জাতীয় পার্টির দুর্গ ছিল রংপুর। আজ সেই র্দুগ নেই। এর কারণ কি? কারণ একটাই, নেতৃত্বের অভাব। কান কথা শুনে রাজনীতির নেতৃত্ব দেওয়া যায় না। দলের মধ্যে কান কথা বেশি চলছে। ফলে রংপুরের ঘাঁটি হারিয়ে গেছে। তাই এক কথায় বলতে হয়- বৌ মরলে বৌ পাওয়া যায়, ভাই মরলে ভাই পাওয়া যায় না।

কিশোরগঞ্জ জেলা জাতীয় পার্টির সভাপতি ডা. আব্দুল হাই মঞ্চে বসে থাকা জাপা চেয়ারম্যানের উদ্দেশে বলেছিলেন, ‘আপনার আশেপাশে যারা বসা আছেন, তারা শুধু হালুয়া-রুটির জন্য আপনার আশপাশে ঘুরঘুর করেন। হালুয়া-রুটির জন্য আপনার কাছে ধর্না দেন। এসব নেতাদের কাছ থেকে দূরে থাকুন। লেজুরভিত্তিক রাজনীতি না করে নিজস্ব রাজনীতি নিয়ে জনস্বার্থে কর্মসূচি দিয়ে মাঠে নামুন।

টাঙ্গাইল জেলা জাপার সভাপতি মোজাম্মেল হক বলেছিলেন, ‘জাতীয় পার্টির রাজনীতি বনানী অফিস কেন্দ্রিক হয়ে গেছে। যারা প্রতিদিন বনানী অফিসে গিয়ে চেয়ারম্যান জিএম কাদের ও মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নুর সঙ্গে দেখা করেন, তারা পদ-পদবি পান। তারাই প্রেসিডিয়াম সদস্য ও চেয়ারম্যানের উপদেষ্টা হচ্ছেন। এভাবে একটি রাজনৈতিক দল চলতে পানে না।

তিনি সেই আরও বলেছিলেন, ‘আমরা সবসময় আওয়ামী লীগের দোষ দিয়ে থাকি। তারা কথা দিয়ে কথা রাখেনি, ইত্যাদি, ইত্যাদি। আওয়ামী লীগ দলকে এগিয়ে নেয়ার জন্য কৌশল অলম্বন করবে, এটাই স্বাভাবিক। জাতীয় পার্টি কেন কৌশল নিয়ে সামনে পথ চলছে না।’

ঢাকা মহনগরের দক্ষিণের নেতা ও প্রেসিডিয়াম সদস্য জহিরুল আলম রুবেল বলেছিলেন, ‘৪২ বছর ধরে আমি জাতীয় পার্টির রাজনীতি করি। আমার মতো অনেকে আছেন যারা এই দলটি করতে গিয়ে সবকিছু হারিয়েছেন। আজ আমাদের মাজা ভেঙে গেছে। তিনি সেই সময় আরো বলেছিলেন ‘দেশের প্রধান বিরোধীদল জাতীয় পার্টি; কিন্তু মঞ্চে মাত্র ২৪ নেতা উপস্থিত। অন্য নেতারা কোথায়? তারা তো সময় মতো হালুয়া-রুটির জন্য সামনের কাতারে থাকবেন।

তিনি আরও বলেছিলেন, ‘বেগম রওশন এরশাদ জাতীয় পার্টি নামে দল করছেন। তিনিও জানেন তাকে দিয়ে রাজনৈতিক দল হবে না। তাদের ওখানে যেসব নেতা রয়েছেন তারাও সময় মতো চলে আসবেন। তারাও নির্বাচনে মনোনয়ন পাবেন, এমপি হবেন। ‘অথচ এমন অনেকেই আছেন যারা ২০/২৫ বছর জাতীয় পার্টির রাজনীতি করছেন- কিন্তু একবারও নির্বাচন করার সুযোগ পাননি। ওইসব নেতার সমর্থকরা কেন জাপাকে সমর্থন জানাবে?’- প্রশ্ন তোলেন ঢাকা দক্ষিণের নেতা রুবেল

জাপা সূত্র জানায়, বিএনপিসহ তাদের বলয়ে থাকা রাজনৈতিক দলগুলোর বর্জনের মধ্যে গত ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ১১টি আসনে জয়লাভ করে জাতীয় পার্টি। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সঙ্গে আসন সমঝোতার এই নির্বাচনে খুব একটা সুবিধা করতে না পারলেও টানা তৃতীয় মেয়াদে জাতীয় সংসদের প্রধান বিরোধী দলের আসনে বসেন তারা।

জানতে চাইলে এ প্রসঙ্গে জাতীয় পার্টির মহাসচিব ও বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ মো. মুজিবুল হক চুন্নু এমপি বলেন, আমরা এর আগে কো-চেয়ারম্যান এবং প্রেসিডিয়াম সদস্যরা মিলে কয়েক দফা বৈঠক করেছি। সদ্য সারা দেশের নেতাদের নিয়ে বৈঠকে অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে দলের কো-চেয়ারম্যান, প্রেসিডিয়াম সদস্য, চেয়ারম্যানের উপদেষ্টাবৃন্দ, সংসদ-সদস্য, কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য-সবাই উপস্থিত ছিলেন। এর বাইরেও সারা দেশের সাংগঠনিক জেলা এবং উপজেলার দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা ও অঙ্গ এবং সহযোগী সংগঠনের নেতারা উপস্থিত ছিলেন সেইদনি। তাদের মনের দুঃখ কষ্টের কথা আমরা শুনছি। সেইভাবে দল গোছানোর চেষ্টা অব্যাহত আছে।

তিনি আরও বলেন, গত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে আমাদের দলের নেতা-কর্মীদের মনে অনেক ক্ষোভ ও হতাশা আছে। আমাদেরও কিছু ভুলত্রæটি আছে, নির্বাচনে যারা প্রার্থী ছিলেন তাদের মনে ক্ষোভ আছে, কর্মীদেরও মনে হতাশা আছে। এর মধ্যে অনেকে আবার দল ছেড়ে চলে গেছেন-সামগ্রিকভাবে বলা যেতে পারে আমরা একটি ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছি। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ এবং দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে নিজেদের করণীয় ঠিক করতে সম্প্রতি বর্ধিত সভায় করেছি। আগামী মাসে দলের নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে এসব বিষয়ে আরো একাধিক বৈঠকে বসবে। সবার মতামত নিয়ে আমরা আগামীতে কিভাবে এগিয়ে যাব তা ঠিক করব।

মানবকণ্ঠ/এআই