Image description

ডাকসু নির্বাচনের প্রস্তুতি যখন চলছে, তখন নুরুল হক নুর জাতীয় পার্টির কার্যালয় গ্রেপ্তার ও জিএম কাদেরের গ্রেপ্তারের দাবিতে কর্মসূচি করাকালে যৌথ বাহিনীর দ্বারা আহত হয়েছেন। এমন একটা সময়ে একজন সমাজ সচেতন মানুষ হিসেবে বরাবরের চেয়ে একটু গভীরভাবে লক্ষ্য করলে দেখবেন, নিয়ম করে রাজপথে এবং ভার্চুয়াল জগতে বাংলাদেশের বায়ান্ন এবং একাত্তরকে খাটো করার চেষ্টা চলছে।

তারই ধারাবাহিকতায় লক্ষ লক্ষ মানুষকে হত্যার মধ্য দিয়ে যে পাকিস্তান আমাদেরকে স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত করতে চেয়েছিল, সেই পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে অপসারণ করে ক্ষমতায় আসা সরকারের উপপ্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশে এসে বলছে- ‘দিল পরিষ্কার করুন’। তিনি যেদিন এ কথা বলেছেন, ঐ দিনই মেঘনা নদীতে লাশ পাওয়া যায় বরেণ্য সাংবাদিক বিভুরঞ্জন সরকারের। 

এই ঘটনা আমাকে নয় শুধু, দেশের প্রতিটা প্রকৃত প্রেমিকককে স্মরণ করাবে যে, জাতি হিসেবে বাংলাদেশের মানুষ যখন নিজেদের স্বাধীনতা নিশ্চিত করেছে প্রায়, সেই একাত্তরের রক্তাক্ত ডিসেম্বরে আমরা হারিয়েছি বুদ্ধিজীবী সাংবাদিকসহ বুদ্ধিজীবী শ্রেণির বরেণ্য মানুষকে। ইসহাক দার যখন বাংলাদেশ সফরে আসলেন নির্মমভাবে বিভুরঞ্জন সরকারের লাশ তখন মেঘনা নদীতে ভাসছিল। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে তিনি আত্মহত্যা করেছে। তিনি যদি আত্মহত্যা করেও থাকেন, সেই দায়ও সরকারকে নিতে হবে। 

ইতিহাস সবসময় সত্য-সুন্দর-সাহসের পক্ষে। আর তাই ইতিহাস স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলছে- এই বক্তব্যের কয়েক মাসের মধ্যেই এপ্রিল, ১৯৭২ সালে ইতালীয় সাংবাদিক ওরিয়ানা ফালাচির সঙ্গে গৃহীত সাক্ষাতকারে সম্পূর্ণ ভিন্ন কথা বলেন ভুট্টো। ভুট্টো সেদিন আরো বলেছিলেন- বাংলাদেশে পাকিস্তানি সেনা হামলায় মোট নিহতের সংখ্যা হাজার-পঞ্চাশেক বলে দাবি করেন এবং সেনা অভিযানকে ‘নৈতিকভাবে সমর্থনযোগ্য’ বলে ব্যাখ্যা করেন। (ফালাচি, ইন্টারভিউ উইথ হিস্টোরি, পৃ. ১৮৮-১৮৯)। 

কিন্তু তার সকল চেষ্টা ব্যর্থতার পানিতে ভেসে যাওয়ার পর বিশ্ববাসী জানতে পারে ত্রিশ লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে বাংলাদেশ-এর স্বাধীনতা। এই ভূখণ্ডের স্বাধীনতার জন্য ত্রিশ লক্ষ প্রাণের পাশাপাশি ২ লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রমও দিতে হয়েছে ছাত্র-যুব-জনতা বিরোধী পাক বাহিনীর হাতে। সেই পাকিস্তান বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয় ১৯৭৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে, এই সময়ের মধ্যে বিশ্বের ১০০টি দেশ স্বীকৃতি দেয় স্বাধীন বাংলাদেশকে। 

অতএব, আজ জাতি হিসেবে বাংলাদেশের মানুষ সাহসের সাথে বলতেই পারে- একাত্তর ও গণহত্যা ইস্যু মীমাংসিত বিষয় নয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় গণহত্যা চালানোর জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা প্রার্থনা, সম্পদের সুষম বণ্টনসহ উনিশশো একাত্তর সালের যেসব অমীমাংসিত বিষয়ের কথা বাংলাদেশ বলছে। সেগুলো আগেই দুদফায় সমাধান হয়ে গেছে বলে দাবি করেছেন পাকিস্তানের উপপ্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ ইসহাক দার। 

তিনি মন থেকে অতীতের স্মৃতি মুছে ফেলে দুদেশের মধ্যকার সম্পর্ককে সামনে এগিয়ে নেয়ার আহ্বানও জানিয়ে আরো বলেছেন- ‘পরিবারের মধ্যে, ভাইদের মধ্যে যখন এটার সমাধান হয়ে গেছে, এমনকি ইসলামও আমাদের বলেছে যে, তোমাদের হৃদয় পরিষ্কার করো। সুতরাং চলুন সামনে এগিয়ে যাই। আমাদের একসঙ্গে কাজ করতে হবে, আমাদের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল।’ 

এমন উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ তারা অর্থাৎ পাকিস্তান নাগরিকরা চাইলেও বাংলাদেশের প্রকৃত নাগরিকরা চায় অবিরাম মুক্ত বাতাস, সবুজ-লালের পতাকা আর মুগ্ধ করা নীলাকাশ দেখতে। তারা কোনো নতুন শৃঙ্খলে আবদ্ধ হতে চায় না বলেই এগিয়ে চলে লোভ- মোহহীন। যারা লোভে পড়ে, তারা যে ধ্বংস হয়, তা তারা জানে। 

আমি আবারো বলছি- মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বাংলাদেশ ভূখণ্ডে চালানো গণহত্যার জন্য পাকিস্তানের ক্ষমা প্রার্থনা, স্বাধীনতার সময়কার পাকিস্তানের সম্পদের সুষম বণ্টন এবং দুদেশের আটকে পড়া নাগরিকদের প্রত্যাবাসন নিয়ে যে সংকট এখনো বিদ্যমান, তা সমাধান হোক। কেননা, গত ৫৪ বছরের রাজনৈতিক-প্রশাসনিক-কূটনৈতিক কোনো পর্বেই এসব বিষয় নিয়ে অতীতে বিভিন্ন সময় দুদেশের মধ্যে নানান আলাপ-আলোচনা হতে দেখা গেলেও দৃশ্যমান কোনো সমাধান দেখা যায়নি। 

এবার ১৩ বছর পরে পাকিস্তানের উপপ্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ ইসহাক দারের দুই দিনের রাষ্ট্রীয় সফরে ঢাকায় অবতরণ করলে নতুন করে ইস্যুগুলো সামনে আসে এবং সমস্যা সমাধানে বিভিন্ন মহল থেকে অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে দাবি আসলে পরারাষ্ট্র উপদেষ্টা সোচ্চার হয়েছেন। এই বিষয়টি সত্যিই আশার বাতি জ্বালানোর মত একটি ঘটনা। আমিও বাংলাদেশের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেনের ভাষায় বলতে চাই- মুক্তিযুদ্ধের সময় সংঘটিত গণহত্যার জন্য পাকিস্তান মাফ চাক, বাংলাদেশ সেটা চায়। 

একই সঙ্গে, সম্পদের ভাগও চায় দেশটির সরকার। তার দরদভরা দেশপ্রেম কণ্ঠে তিনি যে বলেছেন, ‘বাংলাদেশের অবস্থান খুব পরিষ্কার। আমরা চাই যে হিসাব পত্র হোক এবং আমাদের টাকা-পয়সার যে ব্যাপার সেটার সমাধান হোক। আমরা চাই যে এখানে গণহত্যা হয়েছে, সেটার ব্যাপারে তারা দুঃখ প্রকাশ করুক, মাফ চাক এবং আমরা চাই যে এখানে আটকে পড়া মানুষগুলো আছে তাদেরকে তারা ফেরত নেক।’ এই বক্তব্যকে স্যালুট জানাই। অনেক ভুল মানুষের ভিড়ে তার এমন উচ্চারণ আশা জাগায় বলেই স্বপ্ন দেখি; কাজের মাঝে-লেখার মাঝে-বলার মাঝে সেই স্বপ্ন সাজাই। 

‘শুধু একটি অগ্রগতি মনে করি আমি, ছোট্ট একটু, সেটা হলো যে আমরা দুই পক্ষ একমত হয়েছি যে এই বিষয়গুলো আলোচনা করে সমাধান করা প্রয়োজন, যাতে করে আমাদের সম্পর্কের ক্ষেত্রে এগুলো বাধা হয়ে না আসে। না দুইপক্ষ এ ব্যাপারেও একমত হয়েছি যে, আমরা একদিনে বসে এটা সমাধান করে ফেলতে পারব না।’ এ কথা যেমন যথার্থ তিনি বলেছেন, তেমনি ইসহাক দারের উদ্দেশ্যে দ্বিধাহীন উচ্চারণ করেছেন- ‘এ ধরনের স্পেসিফিকে আপনার না যাওয়া উচিত এখন। যেহেতু, আমি তো বলেছি যে, আমরা আমাদের অবস্থানটাকে তুলে ধরেছি। এটা আমার উপরে ছেড়ে দিন, এটুকু বিশ্বাস করেন যে, আমি বাংলাদেশের অবস্থান খুব শক্তভাবে ব্যক্ত করেছি।’ 

আমরা বাংলাদেশে রাজনীতির নামে মানুষের সাথে প্রতারণা বা অপরাজনীতি যেমন চাই না; তেমনি ভারতের-আমেরিকার-চায়নার-পাকিস্তানের বা অন্য কোনো দেশের সাথে বন্ধুত্বের নামে মানুষকে দাশ বানানোর কোনো রাস্তায় অগ্রসর হতে চাই না। আমাদের বাংলাদেশের মানুষদের লক্ষ্য কেবলমাত্র স্বাধীনতা অক্ষুন্ন রেখে নিজেদের চরকায় তেল দিয়ে দুবেলা-দুমুঠো ভাত, নিরাপদে বাঁচা এবং সম্ভব হলে সামর্থমত উন্নয়নের পথে হাঁটা। 

সেই হাঁটাপথে শিক্ষা-খাদ্য-বস্ত্র-বাসস্থান-নিরপত্তা-সমাজ-সভ্যতাকে সমুন্নত রেখে ঐক্যবদ্ধ হওয়া আর থাকা। কেউ বা কোনো গোষ্ঠী বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ-সার্বভৌমত্ব-সংবিধান নিয়ে প্রশ্ন করলে তাদের পরিণতি কি হয় তা দেখার জন্য ফিরতে পারেন ইতিহাসের ৪৭, ৫২, ৬৯, ৭১, ৯০ বা ২৪-এ। এতে করে স্বাধীনতাবিরোধী-ধর্ষক-খুনি-মবকারী-ষড়যন্ত্রকারীদের পাশাপাশি দুর্নীতিবাজদেরও সতর্ক হওয়ার সামান্য সুযোগ অবশিষ্ট থাকবে।

লেখক: চেয়ারম্যান, নতুনধারা বাংলাদেশ এনডিবি।