Image description

প্রতিষ্ঠার ৪৭তম বছরে পা রাখল বিএনপি। ১৯৮০ সালের এই দিনটিতে আত্মপ্রকাশের পর দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে একটি শক্তিশালী ও সুপরিচিত রাজনৈতিক দল হিসেবে বেড়ে উঠে এই দলটি। তবে বিএনপির কাহিনি শুধুমাত্র একটি রাজনৈতিক দলের জন্মের গল্প নয়; এটি একটি আদর্শ, বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে দীর্ঘ সংগ্রামের প্রতীক। যার মূলে রয়েছে দেশের স্বার্থ। 

বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে দলটি গড়ে ওঠে একটি প্রগতিশীল রাজনৈতিক দর্শনের উপর ভিত্তি করে। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রাথমিক দশকে দেশ রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল। সেই সময়ে বিএনপির জন্ম গণতন্ত্রের চর্চা ও স্থিতিশীল রাজনৈতিক সংস্কৃতির প্রবর্তনের প্রয়োজনীয়তা হিসেবে দেখা হয়েছিল। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই বিএনপি দেশের রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছে এবং বিভিন্ন আন্দোলন ও সংগ্রামের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষা ও সম্প্রসারণে অবদান রেখেছে।

বিএনপি শুধুমাত্র গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য নয়, জাতীয়তাবাদের আদর্শকে এগিয়ে নেয়ার জন্যও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। দলটি দেশের সার্বভৌমত্ব, ঐক্য ও জাতীয় শৃঙ্খলা রক্ষার ওপর জোর দেয়। জাতীয় পরিচয় ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে দৃঢ় করার মাধ্যমে বিএনপি সমাজে একটি সমন্বিত ও প্রগতিশীল দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তুলতে চেষ্টা করেছে। দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবাদের এই মূল্যবোধ দলটির রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ও আন্দোলনের ভিত্তি হিসেবে কাজ করেছে। 

বিএনপি বিভিন্ন সময়ে জাতীয়তাবাদের চেতনাকে সামনে রেখে আন্দোলন চালিয়েছে। স্বাধীনতার পরে দেশের সংবিধান ও সাংবিধানিক মর্যাদা রক্ষার ক্ষেত্রে দলটি সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছে। দেশের বিভিন্ন সংকট ও চ্যালেঞ্জের সময়ে জাতীয় স্বার্থকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে বিএনপি রাজনৈতিক ও সামাজিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে, যা দেশের স্থিতিশীলতা ও একাত্মবোধকে আরও শক্তিশালী করেছে। 

জাতীয়তাবাদ শুধু অতীতের ইতিহাস নয়; এটি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য দেশপ্রেম ও দায়িত্বশীল নাগরিকত্বের শিক্ষা। বিএনপি যুব ও ছাত্র নেতৃত্বকে জাতীয়তাবাদের চেতনায় শিক্ষিত ও দায়িত্বশীল করার উদ্যোগ নিয়েছে। এর মাধ্যমে দেশকে একটি একাত্ম ও সচেতন জনগণের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক ও সমৃদ্ধশালী রাষ্ট্রে রূপান্তরিত করার লক্ষ্যে দলটির অঙ্গীকার স্পষ্ট হয়। 

১৯৮০-এর দশকে বিএনপি গণতান্ত্রিক আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল। তৎকালীন সময়ে সামরিক শাসনের প্রভাবমুক্ত রাজনীতির জন্য দলের পদক্ষেপগুলো দেশের রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধিতে সহায়ক হয়েছে। দলটি জনগণের ভোটাধিকার, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং ন্যায়বিচারের পক্ষে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছিল। ছাত্র, যুব ও সাধারণ নাগরিকদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে বিএনপি গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিকে দৃঢ় করার ক্ষেত্রে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

১৯৯০ সালে স্বৈরশাসক এরশাদবিরোধী গণঅভ্যুত্থানও বিএনপির রাজনৈতিক সংগ্রামের একটি উজ্জ্বল অধ্যায়। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে গণজাগরণ ও রাজনৈতিক আন্দোলনে বিএনপি নেতৃত্বে জনতা একত্রিত হয়েছিল। এই আন্দোলন শুধু স্বৈরশাসন উৎখাতের জন্য নয়, বরং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্যও গুরুত্বপূর্ণ ছিল। 

এরশাদ পতনের পর অনুষ্ঠিত নির্বাচনে বিএনপি জনগণের ভোটের মাধ্যমে সরকার গঠন করে এবং দেশের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানকে শক্তিশালী করার পথে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করে। বিগত কয়েক দশকে বিএনপির নেতৃত্বে নানা সময় দেশের রাজনৈতিক সংকট সমাধানে চেষ্টা করা হয়েছে। দলটি জাতীয় বাজেট, নির্বাচন প্রক্রিয়া ও নীতি নির্ধারণে জনগণের স্বার্থ রক্ষা ও দেশের উন্নয়নকে প্রাধান্য দিয়ে কাজ করেছে। বিএনপির ইতিহাস প্রমাণ করে, রাজনৈতিক দল শুধুমাত্র ক্ষমতার জন্য নয়, দেশের সমৃদ্ধি ও গণতান্ত্রিক আদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্যও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।

বিএনপি যুব ও নারী নেতৃত্বকে রাজনৈতিক পরিসরে নেতৃত্বদানের সুযোগ দিয়েছে। দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে যুব এবং নারীর সক্রিয় অংশগ্রহণ দেশের গণতন্ত্রকে আরও সমৃদ্ধ করেছে। উদাহরণস্বরূপ, যুবলীগ ও মহিলা দলের মাধ্যমে দেশের রাজনীতিতে নতুন শক্তি, উদ্ভাবন এবং চিন্তাভাবনা যোগ হয়েছে। এটি প্রমাণ করে যে, গণতন্ত্র শুধু নির্বাচনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; এটি সমাজের প্রতিটি স্তরে সচেতনতা ও অংশগ্রহণের মাধ্যমে বিকাশ লাভ করে।

বিগত বছরগুলোতে বিএনপি শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সামাজিক উন্নয়ন এবং নাগরিক অধিকার প্রসারে নানা কর্মসূচি পরিচালনা করেছে। দলটি গ্রামীণ জনগণের জীবনমান উন্নয়নে, নারী ও শিশুদের শিক্ষার প্রসারে এবং সমাজের দুর্বল জনগোষ্ঠীর কল্যাণে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছে। এসব কর্মকাণ্ড দেশের রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার সাথে সামাজিক উন্নয়নের সংযোগ স্থাপন করেছে। 

বিএনপি বিভিন্ন সময় সরকারের নীতি ও সিদ্ধান্তে জনগণের স্বার্থ রক্ষা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে প্রতিবাদী অবস্থান নিয়েছে। দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক আন্দোলনে দলের সক্রিয় অংশগ্রহণ জনগণকে স্বচ্ছ ও দায়িত্বশীল নেতৃত্বের গুরুত্ব বোঝাতে সহায়ক হয়েছে। এই ধরনের নেতৃত্ব জনগণকে বিশ্বাস জোগায় যে, রাজনৈতিক দল শুধুমাত্র ক্ষমতার জন্য নয়, দেশের সমৃদ্ধি ও গণতান্ত্রিক আদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করে।

বিগত সময়ে বিএনপি পরিবেশ, কৃষি ও শিল্প খাতের উন্নয়নেও উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক অগ্রগতির জন্য দলটি বিভিন্ন নীতি প্রণয়ন, কর্মসূচি বাস্তবায়ন ও জনসচেতনতা বৃদ্ধি করেছে। দলটির এই কর্মকাø প্রমাণ করে, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা শুধুমাত্র রাজনৈতিক অধিকার বা ভোটের অধিকার নয়; এটি সমাজের প্রতিটি স্তরে ন্যায়বিচার ও উন্নয়নের নিশ্চয়তা প্রদানের মাধ্যমে বাস্তবায়িত হয়।

বর্তমান সময়ে বিএনপির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা একটি চলমান প্রক্রিয়া। দেশের রাজনৈতিক দলগুলোকে দায়িত্বশীল হতে হবে এবং জনগণের কল্যাণকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে। বিএনপির দীর্ঘ রাজনৈতিক ইতিহাস আমাদের শেখায়, গণতন্ত্র রক্ষা, ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা এবং দায়িত্বশীল নেতৃত্বই দেশের স্থিতিশীলতা ও সমৃদ্ধির মূল চাবিকাঠি। বিএনপির সংগ্রাম শুধু রাজনৈতিক অর্জনের সীমা অতিক্রম করে না; এটি দেশের মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার ও স্বাধীন মতপ্রকাশকে দৃঢ় করার লক্ষ্যে পরিচালিত হয়েছে। 

দলটি বিভিন্ন সময় আন্দোলন, সংলাপ ও অংশগ্রহণমূলক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটকে সচেতন ও দায়িত্বশীল করার চেষ্টা করেছে। এটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, দেশের উন্নয়ন ও স্থিতিশীল গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য রাজনৈতিক দলগুলোকে সংযুক্ত ও দায়িত্বশীল হতে হবে। বিএনপির ১ সেপ্টেম্বরের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী কেবল একটি উদযাপনের বিষয় নয়; এটি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়, বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা, দায়িত্বশীল নেতৃত্ব এবং সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা কতটা গুরুত্বপূর্ণ। 

দেশকে শক্তিশালী ও স্থিতিশীল গণতন্ত্রের দিকে এগিয়ে নিতে হলে রাজনৈতিক দলগুলোকে জনগণের স্বার্থকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে। বিএনপির ইতিহাস আমাদের শেখায়, গণতান্ত্রিক চেতনা ও রাজনৈতিক দায়বদ্ধতা দেশের স্থিতিশীলতা ও সমৃদ্ধির জন্য অপরিহার্য। 

প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে দলটির অর্জন ও সংগ্রাম স্মরণ করা আমাদের শেখায়, দেশের রাজনীতি শুধুমাত্র ক্ষমতার খেলা নয়; এটি জনগণের অধিকার, ন্যায়বিচার এবং সামাজিক কল্যাণ প্রতিষ্ঠার জন্য একটি দায়িত্বশীল প্রক্রিয়া। 

সার্বিকভাবে, বিএনপির দীর্ঘ সংগ্রাম ও রাজনৈতিক অংশগ্রহণ প্রমাণ করে, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা শুধুমাত্র একটি লক্ষ্য নয়; এটি একটি অবিচ্ছিন্ন প্রক্রিয়া। দেশকে স্থিতিশীল ও সমৃদ্ধশালী গণতন্ত্রের পথে এগিয়ে নিতে হলে সকল রাজনৈতিক দলকে দায়িত্বশীল, স্বচ্ছ ও জনগণের কল্যাণমুখী হতে হবে। বিএনপির ১ সেপ্টেম্বরের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী আমাদের জন্য এই গুরুত্বপূর্ণ বার্তা বহন করে।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট