
স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে আগামী বছরই উত্তরণের পক্ষে আছে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার। কয়েক সপ্তাহ ধরে ব্যবসায়ীরা এলডিসি উত্তরণ পিছিয়ে দেয়ার দাবি করছেন। কিন্তু সরকারের সিদ্ধান্ত হচ্ছে ২০২৬ সালের ২৪ নভেম্বর জাতিসংঘ নির্ধারিত সময়ে এলডিসি থেকে বের হবে বাংলাদেশ। এলডিসি উত্তরণ মসৃণ করতে একটি কমিটিও কাজ করছে।
নির্ধারিত সময়েই বাংলাদেশের এলডিসি উত্তরণ হবে। শক্ত যুক্তির অভাবে এলডিসি উত্তরণের পেছানোর আবেদন জাতিসংঘ গ্রহণ না-ও করতে পারে। গত ১৩ মার্চ অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদে সিদ্ধান্ত হয়, ২০২৬ সালে ২৪ নভেম্বর নির্ধারিত সময়েই বাংলাদেশ এলডিসি থেকে উত্তরণ হবে। ওই বৈঠকে আরও সিদ্ধান্ত হয় যে এলডিসি উত্তরণের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার মাধ্যমে রূপান্তর প্রক্রিয়াকে মসৃণ করার পরিকল্পনা বা স্মুথ ট্রানজিশন স্ট্র্যাটেজি (এসটিএস) বাস্তবায়নে একটি কমিটি গঠন করা হবে।
গত মার্চ মাসেই ছয় সদস্যের বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করে সরকার। এর আগে সরকারের পক্ষ থেকে স্মুথ ট্রানজিশন স্ট্র্যাটেজি (এসটিএস) বা কর্মকৌশল অনুমোদন ও প্রকাশ করা হয়। সেই আলোকে এখন কাজ করছে ওই কমিটি। ২০১৮ সালে বাংলাদেশ এলডিসি থেকে উত্তরণপ্রক্রিয়ায় প্রবেশ করে। নিয়ম অনুসারে, প্রস্তুতির জন্য ছয় বছর শেষে ২০২৪ সালে এলডিসি থেকে বের হওয়ার কথা বাংলাদেশের। কিন্তু কোভিডের কারণে বাংলাদেশকে আরও দুই বছর সময় দেয়া হয়।
১৯৭৫ সালে জাতিসংঘের এলডিসি তালিকায় যুক্ত হয় বাংলাদেশ। এলডিসিভুক্ত দেশ হওয়ার কারণে শুল্কমুক্ত বাণিজ্য-সুবিধাসহ নানা সুবিধা পেয়েছে বাংলাদেশ। বর্তমানে বিশ্বে ৪৪টি স্বল্পোন্নত দেশ রয়েছে। এলডিসি দেশগুলোও একধরনের উন্নয়নশীল দেশ। যেসব দেশের সক্ষমতা তুলনামূলক কম, তাদের এই তালিকায় রাখা হয়।
নির্ধারিত সময়ে এলডিসি উত্তরণ হলে ব্যবসায়ীদের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা ও অন্যান্য দিক থেকে একটা চ্যালেঞ্জ হবে, এটা অস্বীকার করা যাবে না। যেহেতু তারা অনুরোধ করছে, সরকার ইচ্ছা করলে পেছানোর আবেদন করতে পারে। এই আবেদন শেষ পর্যন্ত জাতিসংঘ গ্রহণ করতে পারে, না-ও পারে। এ জন্য আমাদের শক্ত যুক্তি দাঁড় করাতে হবে। বিভিন্ন সূচকের দিক থেকে আমরা হয়তো খুব শক্ত যুক্তি দাঁড় করাতে পারব না। তবে ট্রাম্পের পাল্টা শুল্ক, দেশের অভ্যন্তরীণ পরিবর্তন প্রভৃতি বিষয়ে আমরা শক্ত যুক্তি তুলে ধরতে পারি।
এলডিসি থেকে বের হলে সবচেয়ে সমস্যায় পড়তে হবে রপ্তানি খাতকে। শুল্কমুক্ত বাণিজ্যসুবিধা উঠে যাবে। বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের পণ্যের ওপর নিয়মিত হারে শুল্ক বসবে। বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই বাড়তি শুল্কের কারণে রপ্তানি বছরে ৫৩৭ কোটি ডলার বা সাড়ে ৪৫ হাজার কোটি টাকা কমতে পারে। এখন যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশ কোনো শুল্কসুবিধা পায় না।
এলডিসি উত্তরণ হলেও ২০২৯ সাল পর্যন্ত ইউরোপীয় ইউনিয়নে জিএসপির আওতায় এই শুল্কমুক্ত সুবিধা থাকবে। এই দুটি বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের বড় বাজার। বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারে ওষুধশিল্প। এলডিসি থেকে বের হলে ওষুধশিল্পের ওপর মেধাস্বত্ব বিধিবিধান আরও কড়াকড়ি হবে। এলডিসি হিসেবে বাংলাদেশের ওষুধ প্রস্তুতকারক কোম্পানিগুলোকে আবিষ্কারক প্রতিষ্ঠানকে মেধাস্বত্বের জন্য অর্থ দিতে হয় না। মেধাস্বত্বের (পেটেন্ট) ওপর অর্থ দেয়া হলে ওই ওষুধের দাম বেড়ে যেতে পারে।
এ কারণে এলডিসির গরিব নাগরিকরা স্বল্পমূল্যে ওষুধ পাবে না। এলডিসি হিসেবে বাংলাদেশ এই সুবিধা বেশি পেয়েছে। বাংলাদেশ ওষুধশিল্প একটি শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়েছে। এলডিসি থেকে উত্তরণ হলে আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থাগুলোর কাছ থেকে সহজ শর্তের ঋণ পাওয়ার সুযোগ সীমিত হতে পারে। অবশ্য বাংলাদেশ এখন বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকসহ (এডিবি) বিভিন্ন ঋণদাতা সংস্থার কাছ থেকে সহজ ও কঠিন শর্তের ঋণ নেয়া শুরু করেছে। এ ছাড়া নগদ ও ভর্তুকি সহায়তার পাশাপাশি করছাড়ে আরও কড়াকড়ি আরোপ হবে।
বাংলাদেশকেও কৃষি, শিল্প, রেমিট্যান্সসহ বিভিন্ন খাতে এসব সহায়তা দেয়া কঠিন হবে। এলডিসি থেকে উত্তরণ হলে লাভও আছে। পুরোপুরি উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বিবেচিত হবে, যা হবে সামাজিক ও অর্থনৈতিক সক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ। অর্থনৈতিক সক্ষমতার কারণে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক ঋণদাতা সংস্থাগুলোর কাছ থেকে বেশি সুদে অনেক বেশি ঋণ নেওয়ার সক্ষমতা বাড়বে। বিদেশি বিনিয়োগও আকৃষ্ট হবে। অবশ্য বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার ক্ষেত্রে বিনিয়োগ পরিবেশ বড় ভূমিকা পালন করে।
স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে বাংলাদেশের উত্তরণের নির্ধারিত সময়সীমা পিছিয়ে দেয়ার দাবি তুলেছেন ব্যবসায়ীরা। তাদের দাবি, এই মুহূর্তে এলডিসি থেকে উত্তরণ হলে রপ্তানি খাতসহ নানা খাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। সম্প্রতি এক সেমিনারে দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ীরা এই দাবি করেন। ব্যবসায়ীদের এই দাবির পর এলডিসি উত্তরণের বিষয়টি নতুন করে আবারও আলোচনায় এসেছে। এলডিসি উত্তরণের সময় পেছানো কতটা যৌক্তিক ও বাস্তবসম্মত, তা নিয়ে নানা মতামত দেখা দিয়েছে।
সরকারের পক্ষ থেকে সময় বৃদ্ধির আবেদন করার জন্য কী কী যৌক্তিক কারণ আছে, সরকার চাইলেই কি সময় পেছাতে পারবে, এমন প্রশ্ন সামনে এসেছে। গত আট বছরের নানা প্রক্রিয়া ও একাধিক মূল্যায়ন শেষে ২০২৬ সালের ২৪ নভেম্বর এলডিসি থেকে বের হবে বাংলাদেশ, এমন সিদ্ধান্ত জাতিসংঘের। সেই হিসাবে এলডিসি থেকে উত্তরণে বাংলাদেশের সামনে সময় আছে ১৫ মাসের কিছুটা বেশি। এই সময়ে এসে উত্তরণের সময় পিছিয়ে দেয়ার দাবি উঠেছে। এলডিসি থেকে কোন দেশ বের হবে, সে বিষয়ে সুপারিশ করে সিডিপি।
এ জন্য প্রতি তিন বছর পরপর এলডিসিগুলোর ত্রিবার্ষিক মূল্যায়ন করা হয়। মাথাপিছু আয়, মানবসম্পদ, জলবায়ু ও অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা, এই তিন সূচক দিয়ে একটি দেশ উন্নয়নশীল দেশ হতে পারবে কি না, সেই যোগ্যতা নির্ধারণ করা হয়। যেকোনো দুটি সূচকে যোগ্যতা অর্জন করতে হয় কিংবা মাথাপিছু আয় নির্দিষ্ট সীমার দ্বিগুণ হতে হয়। এই মানদণ্ড সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তন হয়।
বাংলাদেশ ২০১৮ ও ২০২১ সালের ত্রিবার্ষিক মানদণ্ডের তিনটিতেই উত্তীর্ণ হয়। ২০২১ সালেই বাংলাদেশ চূড়ান্ত সুপারিশ পায় যে ২০২৪ সালে এলডিসি থেকে বেরিয়ে যাবে বাংলাদেশ। কিন্তু করোনার কারণে প্রস্তুতির জন্য দুই বছর সময় বাড়িয়ে দেয়া হয়। ১৯৭৫ সালে এলডিসি তালিকায় যুক্ত হয় বাংলাদেশ। এলডিসিভুক্ত দেশ হওয়ার কারণে পণ্য রপ্তানিতে শুল্কমুক্ত বাণিজ্য-সুবিধাসহ নানা সুবিধা পেয়েছে বাংলাদেশ। এলডিসি উত্তরণের সময় পেছানোর জন্য বাংলাদেশের যৌক্তিক কারণ থাকতে হবে।
আট বছর সময় পাওয়ার পরও প্রস্তুত নয়, এই কারণ দেখিয়ে সময় পেছানো যাবে না। ২০১৮ সালে বাংলাদেশ এলডিসি থেকে উত্তরণপ্রক্রিয়ায় প্রবেশ করে। সাধারণত ৬ বছরে এ প্রক্রিয়া শেষ হয়। কিন্তু কোভিডের কারণে বাংলাদেশসহ অন্য দেশকে আরও দুই বছর সময় দেওয়া হয়। এলডিসি উত্তরণ পেছানোর আবেদনের দুটি প্রক্রিয়া আছে। প্রথম প্রক্রিয়াটি হলো, সরকারপ্রধানকে সরাসরি ইকোসকের সিডিপির প্রধানের কাছে চিঠি লিখতে হবে।
চিঠিতে যৌক্তিক কারণ দেখাতে হবে যে নির্দিষ্ট এক বা একাধিক নতুন ও অপ্রত্যাশিত কারণে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক সূচকগুলো নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। এখন উত্তরণ পেছানো ছাড়া আর বিকল্প নেই। বাংলাদেশের আবেদন পেলে সিডিপি একটি মূল্যায়ন করবে এবং এই মূল্যায়নের ওপর পেছানোর বিষয়টি নির্ভর করবে। দ্বিতীয় উপায়টি হলো, বাংলাদেশ সরাসরি জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে আবেদন করতে পারে। তখন সাধারণ পরিষদই সিদ্ধান্ত নেবে। সে ক্ষেত্রে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ভূমিকা রাখতে পারে এমন শক্তিশালী দেশের সহায়তা লাগবে এবং যৌক্তিক কারণ দেখাতে হবে।
গত বছরের আগস্টে বাংলাদেশে গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হয়। এরপর অর্থনীতিতে কিছু সংস্কার হয়েছে। তবে এক বছরে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি হয়েছে, রপ্তানি ও প্রবাসী আয় বেড়েছে। ব্যাংক খাতেও কিছু সংস্কার হয়েছে, যার ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে ওই খাতে। মূল্যস্ফীতি কমেছে। সরকারের নীতিনির্ধারকদের তরফ থেকে দাবি করা হচ্ছে, বাংলাদেশের অর্থনীতি আগের চেয়ে ভালো অবস্থানে আছে।
তাহলে এলডিসি উত্তরণের সময় পেছাতে গেলে বাংলাদেশ কী কারণ দেখাবে, সেটাও এখন প্রশ্ন। তবে দক্ষ শ্রমশক্তি, অর্থনীতি ও সামাজিক খাতে সংস্কার, রাজস্ব খাত, বিনিয়োগ পরিবেশসহ নানা খাতে দুর্বলতা আছে। পোশাক, ওষুধসহ রপ্তানির বিভিন্ন খাতের ব্যবসায়ীরা এলডিসি উত্তরণ ৩ থেকে ৬ বছর পেছানোর দাবি করছেন। এক সেমিনারে তারা এই দাবি জানিয়ে এলডিসি থেকে উত্তরণের সময় বাড়ানোর জন্য পাঁচটি কারণ বা যুক্তি তুলে ধরেছেন। সেগুলো হচ্ছে ১. ভালো বাণিজ্য দর-কষাকষির জন্য, ২. তৈরি পোশাকের বাইরে রপ্তানি বৈচিত্র্য আনা, ৩. শিল্প খাতে দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তোলা, ৪. বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ ও ৫. প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা বাড়ানো ও জলবায়ু সহনশীলতা টেকসই করা। তার মতে, এলডিসি থেকে উত্তরণ হলে বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানিতে শুল্ক বাড়বে ১২ শতাংশ।
আর জিএসপিসহ অন্যান্য বাণিজ্যসুবিধা নিশ্চিত করতে না পারলে রপ্তানি কমবে ৬ থেকে ১৪ শতাংশ। ব্যবসায়ীদের দাবি, এলডিসি উত্তরণের জন্য অনুকূল অর্থনৈতিক বাস্তবতা নেই। এলডিসি থেকে উত্তরণের পথে বাংলাদেশের বড় বাধা হচ্ছে বিদ্যুৎ ও গ্যাস-সংকট। নির্ভরযোগ্য জ্বালানি সরবরাহ না থাকলে তৈরি পোশাক, বস্ত্র ও ওষুধশিল্পের মতো গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলো বৈশ্বিক চাহিদা মেটাতে সক্ষম হবে না। এতে উত্তরণের ঝুঁকি আরও বাড়বে। অন্যদিকে বৈশ্বিক সুদের হার ও অভ্যন্তরীণ খেলাপি ঋণ বেড়েছে। এতে ঋণপ্রবাহ কমছে। আবার বিদেশি বিনিয়োগ কমছে।
সরকারি প্রতিষ্ঠান ও সংস্থা বিভিন্ন প্রস্তুতিমূলক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। তবে এটা শুধু সরকারের প্রস্তুতির বিষয় নয়, বেসরকারি খাতের প্রস্তুতি নিতে হবে। এভাবে চলতে থাকলে আগামী পাঁচ বছর পরও প্রস্তুতি নেয়া হবে না। ডোনাল্ড ট্রাম্পের ২০ শতাংশ শুল্ক মেনে নিতে পারলে এই চ্যালেঞ্জও আমরা উতরে যেতে পারব। নেপাল উত্তরণ করছে, সেখানে আমরা পাঁচ বছর সময় চাইব, সেটা হয়তো হবে না। পেছানো গেলে ভালো, তবে না হলেও প্রস্তুতি রাখতে হবে। বাংলাদেশ সময় পেছানোর আবেদন করতে পারে।
কিন্তু সেটা জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে গৃহীত হতে হবে। তিনটি সূচকে আমাদের অবস্থান কম দেখাতে হবে। ১ হাজার ৩০০ ডলার মাথাপিছু আয় হলে উত্তরণ হওয়ার সক্ষমতা অর্জন হয়। কিন্তু আমাদের বর্তমানে আছে ২ হাজার ৮০০ ডলারের বেশি। তাই সময় বাড়ানোর আবেদন করলেও প্রস্তুতি রাখতে হবে।এলডিসি উত্তরণের প্রভাবের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) বাজারসুবিধা উঠে যাওয়ার আপাতত কোনো সম্পর্ক নেই। গ্যাস-বিদ্যুতের সংকট, পণ্যজট, পরিবহন সমস্যার কথা ব্যবসায়ীরা বলছেন।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এলডিসি উত্তরণ পিছিয়ে দিলেই কি এসব সমস্যা দূর হয়ে যাবে? এলডিসি থেকে উত্তরণের পরপরই বাণিজ্যসুবিধা বন্ধ হয়ে যাবে না। ইইউ ২০২৯ সাল পর্যন্ত বিদ্যমান বাণিজ্যসুবিধা দেবে। যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, চীন বাণিজ্যসুবিধা অব্যাহত রাখার কথা বলেছে। জাতিসংঘের বিধিবিধানের কারণে এলডিসি উত্তরণে আমাদের নৈতিক বাধ্যবাধকতা আছে। এলডিসি উত্তরণ পিছিয়ে দেয়ার সুযোগ নেই। যদি থাকেও, তাতে আমাদের দিক থেকে এ ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপ নেয়া উচিত হবে না।
ঝড় মোকাবিলায় আমাদের প্রস্তুতি নিতে হবে। জেগে উঠতে হবে। এখন উট পাখির মতো আমাদের মুখ গুঁজে থাকলে চলবে না। বাংলাদেশ ইতোমধ্যে এলডিসি উত্তরণের জন্য জাতিসংঘের নির্ধারিত তিনটি শর্ত পর পর দুবার পূরণ করেছে। শর্তগুলো হচ্ছে মাথাপিছু আয়ের মানদণ্ড, মানবসম্পদ সূচক ও অর্থনৈতিক ঝুঁকি সূচক। গত আট বছরের নানা প্রক্রিয়া ও একাধিক মূল্যায়ন শেষে ২০২৬ সালের ২৪ নভেম্বর এলডিসি থেকে বের হবে বাংলাদেশ, এমন সিদ্ধান্ত জাতিসংঘের। সময় আছে মাত্র ১৫ মাস।
বাংলাদেশ এলডিসি উত্তরণের প্রক্রিয়ায় ঢুকে গেছে। ফলে এলডিসি উত্তরণ হতেই হবে। তবে সঠিক সময়ে সঠিকভাবে উত্তরণ নিয়ে দর-কষাকষি করা ও সময় বাড়ানো প্রয়োজন। এলডিসি উত্তরণ পেছানোর জন্য আমাদের কাছে যথেষ্ট কারণ রয়েছে, সুযোগও আছে। ফলে বাংলাদেশ সময় বাড়ানোর আবেদন করতে পারে। এ ছাড়া বাংলাদেশের মতো একই ধরনের কারণে অন্য কয়েকটি দেশ বাড়তি সময় পেয়েছে। এটিও বিবেচনায় নিতে পারি।
প্রথমে ১৩ মার্চ অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের এলডিসি উত্তরণের সিদ্ধান্ত বদলাতে হবে। জাতিসংঘে এলডিসি উত্তরণ পেছানোর আবেদনের দুটি প্রক্রিয়া আছে। প্রথম প্রক্রিয়াটি হলো, বর্তমান সরকারপ্রধানকে সরাসরি জাতিসংঘের জাতিসংঘ অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদের (ইকোসক) কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসি (সিডিপি) প্রধানকে চিঠি লিখে জানাতে হবে, নির্দিষ্ট এক বা একাধিক ‘নতুন’ ও ‘অপ্রত্যাশিত’ কারণে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক সূচকগুলো নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে।
এখন উত্তরণ পেছানো ছাড়া আর বিকল্প নেই। বাংলাদেশের আবেদন পেলে সিডিপি একটি মূল্যায়ন করবে এবং এই মূল্যায়নের ওপর পেছানোর বিষয়টি নির্ভর করবে। দ্বিতীয় উপায়টি হলো, বাংলাদেশ সরাসরি জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে আবেদন করতে পারে। সাধারণ পরিষদই সিদ্ধান্ত নেবে। সে ক্ষেত্রে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ভূমিকা রাখতে পারে এমন শক্তিশালী দেশের সহায়তা লাগবে এবং যৌক্তিক কারণ দেখাতে হবে। বাংলাদেশের এখন সব মনোযোগ দেয়া উচিত মসৃণ উত্তরণ কৌশলে (এসটিএস)।
এ জন্য শিল্প উৎপাদক, ওষুধ খাত ও কৃষি খাতের উদ্যোক্তাদের সবাইকে সঙ্গে নিয়ে কাজ করা উচিত। তিনটি বিষয়ে বেশি মনোযোগ দেয়া দরকার। এগুলো হলো, এক. অর্থনীতিতে বৈচিত্র্য আনা; দুই. শ্রম ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি; তিন. প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধি। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, তিন বছর পিছিয়ে গেলে এবং নির্বাচিত সরকার দায়িত্বে এলে কি বিদ্যুৎ সমস্যা, যানজট সমস্যা ইত্যাদি সমাধান হয়ে যাবে? বৈশ্বিক রাজনীতি এখন খুবই টালমাটাল, এটা মাথায় রেখে আমাদের রেখে কাজ করতে হবে। আগামী বছরে এলডিসি তালিকা থেকে বাংলাদেশের উত্তরণে অনেক বিষয় চিন্তা করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার, কলাম লেখক
Comments