
শিশু-কিশোরদের যোগাযোগ দক্ষতার বড় অভাব এখন পরিবার ও সমাজে। সাধারণ অর্থে যোগাযোগ বলতে আমরা বুঝি তথ্যের বা ভাবের আদান প্রদান। এই আদান প্রদান পারস্পরিক বোঝাপড়ার সম্পর্ক সৃষ্টি করে, যার অভাব শুধু বড়দের মধ্যেই নয়, কোমলমতি শিশু-কিশোরদের মধ্যেও ভয়াবহরূপে তৈরি হচ্ছে। শিশু-কিশোরদের বেশিরভাগ শুধু যে স্মার্টফোনে ভিডিও গেমস খেলার নামে নেতিবাচক কনটেন্ট দেখে বিপথগামী হচ্ছে, তা নয়, মুখোমুখি যোগাযোগের সুযোগ না থাকাটাও এই বিপথগামিতার জন্য অনেকটা দায়ী।
এখন একক পরিবারের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পেতে থাকায় শিশু-কিশোরেরাও একা হয়ে পড়ছে। আগেকার যৌথ পরিবারগুলোতে শিশু-কিশোররা একসঙ্গে দাদা-দাদি, নানা-নানি এবং চাচাতো, মামাতো খালাতো, ফুফাতো ভাইবোনদের সাথে আলাপচারিতায় মেতে উঠে যেভাবে নিজেদের মধ্যে শেয়ারিং করার সুযোগ পেত, এখনকার একক পরিবারে সেই সুযোগ আর মিলছে না। এ ছাড়া অনেক পরিবারের অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের অন্যের সঙ্গে মিশতে দিতে চান না। সন্তান অন্যদের সাথে মেলামেশা করে নষ্ট হয়ে যাবে, এই আশঙ্কা তাদের। আশঙ্কাটা যে অমূলক, তাও নয়। বর্তমানে আর্থ-সামাজিক পরিবেশ ও নৈতিক অবক্ষয়ের কারণে শিশু-কিশোরদের স্বাভাবিক বিকাশ যেমন ঘটছে না, তেমনি অনেক শিশু-কিশোরকে অনৈতিক কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িয়ে পড়তে দেখা যাচ্ছে। কিন্তু এই অনাকাঙ্ক্ষিত কর্মকাণ্ড থেকে শিশু-কিশোরদের বের করে আনার তেমন উদ্যোগও চোখে পড়ে না অভিভাবকদের মধ্যে। তারা পৃথক কিংবা একসঙ্গে খুবই কম কথা বলেন সন্তানদের সাথে। যেটুকু বলেন, তাতে বেশিরভাগই থাকে পড়াশোনায় আরো বেশি মনোযোগী হওয়ার শাসন। এ থেকে শিশু-কিশোরদের মনে যে মানসিক চাপটি তৈরি হচ্ছে, তাতে তারা পড়াশোনার বাইরে খেলাধুলা, বন্ধুদের সাথে মেলামেশা বলে যে কিছু আছে, তা প্রায় ভুলতেই বসেছে।
পড়াশোনা অবশ্যই প্রথম অগ্রাধিকার কিন্তু সাথে সাথে শিশু-কিশোরদের পারস্পরিক সম্পর্ক তৈরির মাধ্যমে তাদের মানসিক বিকাশটাও যে জরুরি, সেটি যে কারণেই হোক, সেভাবে এখন আর বিবেচিত হচ্ছে না। অনেক সময় দেখা যায় একই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত বা একই এলাকায় বসবাসরত সমবয়সি অনেক শিশু কিশোর হীনম্মন্যতার কারণে উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানদের সাথে আলাপচারিতায় যুক্ত হওয়াকে এড়িয়ে যেতে চায় বা দূরত্ব বজায় রাখে। একই আচরণ দেখা যায় নিম্ন বিত্ত পরিবারের সন্তানদের প্রতি কিছু উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানদের ক্ষেত্রেও। শিশু কিশোরদের বন্ধুত্বপূর্ণ মেলামেশার ক্ষেত্রে এই যে মানসিক দূরত্ব, তা তাদের মানবিক বা সামাজিক মানুষ হিসেবে বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রে বড় একটা অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিশু-কিশোরদের যোগাযোগ দক্ষতা সফল সামাজিক সম্পর্কের ভিত্তি। এই দক্ষতা শিশুদেরকে একে অপরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলতে সহায়তা করে। যোগাযোগ দক্ষতা শিশুকে যেমন আত্মবিশ্বাসী করে তোলে, তেমনি নিজেকে অন্যের কাছে গুরুত্বপূর্ণ ও প্রিয়ভাজন ভাবতেও শেখায়। এ কারণে শিশু-কিশোরদেরকে যোগাযোগের কৌশল সম্পর্কে ধারণা দেয়া জরুরি। বেশিরভাগ শিশু স্বভাবগতভাবেই মুখের অভিব্যক্তি, দাঁড়ানো বা বসার ক্ষেত্রে বিভিন্ন স্টাইল অনুসরণের মাধ্যমে বন্ধু ও সমবয়সীদের সঙ্গে মৌখিক ও অ-মৌখিক যোগাযোগ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে। এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ হলো, তাদের চোখে-মুখে ও কণ্ঠে উৎফুল্ল ভাব থাকা। এই উৎফুল্লতা সফল যোগাযোগ গড়ে তুলতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখে।
সাধারণত দেখা যায়, শিশুরা কী নিয়ে কথা বলবে তা খুঁজে পায় না। এ ক্ষেত্রে শিশুরা একে অপরের কাছে খুবই সাধারণ প্রশ্ন উত্থাপন করে কথোপকথন শুরু করতে পারে। অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, যে-সব শিশুর ঘনিষ্ঠ বন্ধু রয়েছে, তারা অন্যদের তুলনায় বেশি সামাজিক ও বেশি মিশুকও। এর কারণ হলো, এ ধরনের শিশুরা তাদের বন্ধুদের সঙ্গে মতবিনিময় করতে পারে, নিজেদের ভালোলাগা-মন্দলাগার কথা সহজে বলতে পারে। এই প্রফুল্লতার আনন্দ তাদের পড়াশোনা ও অন্যান্য কাজের উপরও প্রভাব ফেলে। কিন্তু যে-সব শিশু কারো সাথে সহজে সম্পর্ক তৈরি করতে পারে না, তারা এক কোণায় বসে সমবয়সীদের খেলা দেখতে বাধ্য হয়।
এর কারণ হলো, তাদেরকে হয় পরিবার থেকে কারো সাথে মিশতে বারণ করা হয়, নয়তো কারো সাথে সম্পর্ক স্থাপনের কৌশলটিই তাদের জানা থাকে না বা জানানো হয় না। শিশু কিশোরদের আত্মবিশ্বাসী ও সৎসাহসী মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা যে একটা উন্নত জাতি গড়ার মূলমন্ত্র, তা অস্বীকার করার উপায় নেই। এই যোগাযোগ দক্ষতা বাড়ানোর জন্য কিছু বিষয় বাবা মায়েদেরই শেখানো উচিত।
শিশু মনস্তত্ত্ববিদরা বলছেন, আপনার শিশু সন্তান যখন কারো সঙ্গে কথা বলে, তখন যেন সে অপর পক্ষের চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলে। আত্মবিশ্বাস তৈরির জন্য এই আই কন্টাক্টটি খুব জরুরি। অনেক শিশু মঞ্চে উঠে বা অনেকের মধ্যে দাঁড়িয়ে কথা বলতে ভয় পায়। এগুলো হয় শিশুর আত্মবিশ্বাসের অভাব বা নিজেকে গুটিয়ে রাখার প্রবণতা থেকে। এই ভয় বা জড়তা স্থায়ী হয়ে গেলে শিশুরা কোথাও, বিশেষ করে কর্মক্ষেত্রে নিজের শক্তি, দক্ষতা, অর্জিত শিক্ষা নিয়ে নিজেকে পরিপূর্ণভাবে মেলে ধরতে পারে না। এজন্য স্কুলের বা সামাজিক যে কোনো অনুষ্ঠানে বিতর্ক, কবিতা আবৃত্তি, ছবি আঁকা, নাটকে অভিনয়, লেখালেখি ইত্যাদি সৃজনশীল কাজে শিশু-কিশোরদের অংশ নেয়ার সুযোগ করে দেয়া প্রয়োজন।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক মেখলা সরকার জানান, শিশু তার চারপাশের পরিবেশ থেকে শেখে। চারপাশের শব্দভাণ্ডারগুলো তার মস্তিষ্ক গ্রহণ করে। তাদের সব শব্দ শেখাতে হয় না। সে নিজ থেকেই অনেক শব্দ শিখে যায়।
তিনি আরো বলেন, অনেক সময় দেখা যায় বাবা-মা মোবাইল নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। এতে শিশুরা মা বাবাকে কাছে পায় না। শিশু সন্তানকে সময় দিতে হবে মা বাবাদের। এজন্য মোবাইল ব্যবহারে সচেতন হতে হবে তাদের। বাবা মার বডি ল্যাংগুয়েজ অর্থাৎ নাক, মুখ ও চোখের অভিব্যক্তি শিশু সন্তানকে অনেক কিছু বুঝতে সহায়তা করে। তাদের হাত পা নাড়িয়ে কথা বলা, কোনো কিছু বর্ণনা করে বোঝানো-এসব শিশুর যোগাযোগ দক্ষতা বাড়াতে সাহায্য করে। এজন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন অভিভাবকদের প্রেরণা ও সহযোগিতা। তারা যদি শিশুদের পড়াশোনার পাশাপাশি অন্য বন্ধুদের সাথে সুসম্পর্ক তৈরি, খেলাধুলা, স্বজনদের মিলনমেলা, সৃজনশীল কাজে অংশ নিতে সতর্ক দৃষ্টি রেখে উৎসাহিত করেন, তাহলে তারা যেমন ধীরে ধীরে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ বাড়াতে সক্ষম হবে, তেমনি সকল ক্ষেত্রে সাবলীলভাবে ও আত্মবিশ্বাসের সাথে নিজেদের সফলভাবে উপস্থাপন করার যোগ্যতাও অর্জন করতে পারবে এ প্রত্যাশা অমূলক নয়।
লেখক: কবি, কথাশিল্পী ও কলামিস্ট
Comments