Image description

অদ্ভুত একটা সময় পার করছি আমরা। চারদিকে কেবল সমস্যা আর সমস্যা। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি হয়েছে। খুন, ডাকাতি, চুরি, ছিনতাই বেড়ে গেছে। পুলিশ এখনও নিষ্ক্রিয়। ফলে জানমালের নিরাপত্তা নেই। মানুষ সন্ধ্যার পর ঘরের বাইরে যেতে ভয় পাচ্ছে। একই সঙ্গে চলছে মব সংস্কৃতি। তুচ্ছ ঘটনা ও নানা ধরনের ট্যাগজুড়ে দিয়ে পিটিয়ে মানুষ হত্যা চলছে অবলীলায়। মানুষের সম্পদ বিনষ্ট করা হচ্ছে। সরকার কেবল বিবৃতি দিয়ে দায় সারছে। তাদের যেন আর কোনো দায়িত্ব নেই। 

অন্তর্বর্তী সরকার প্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূসের প্রতি মানুষের যে আস্থা ছিল, এই সাত মাসে সেটাতেও চিড় ধরেছে। পরিসংখ্যান বলছে, অপরাধ বেড়েছে। খোদ রাজধানী ঢাকার পরিস্থিতি ভয়াবহ। হয়তো অধ্যাপক ইউনূস স্বীকার করছেন না। নয়তো অতীতের শাসকদের প্রেতাত্মারা তার ঘাড়ে ভর করেছে। কেননা, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে যত ঘটনা ঘটেছে, তারা সেটা সমাধান করার চেয়ে বিএনপি-জামায়াতের ওপর দোষ চাপাতে বেশি ব্যস্ত ছিল। ইউনূস সাহেবও একই কাজ করছেন।

তিনি বিবিসি বাংলাকে সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘একটা পলাতক দল (আওয়ামী লীগ) দেশকে আনসেটেলড (অস্থিতিশীল) করার চেষ্টা করছে।’ স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীও কম যাননি। দেশের সব অপকর্মের দায় পলাতক আওয়ামী লীগের ঘাড়ে চাপিয়ে তিনি তৃপ্তির ঢেঁকুর গিলছেন। সেই চেষ্টায় তিনি অনেকটা সফলও হয়েছেন। অপারেশন ডেভিল হান্ট পরিচালনা করলেন। তাতে কতটা শয়তান ধরা পড়ল, তাতে পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হয়েছে? হয়নি। অর্থাৎ প্রকৃত ডেভিলরা যে ধরা পড়েনি, সেটা স্পষ্ট। 

বরং খুনি, দাগি, চিহ্নিত সন্ত্রাসীদের মুক্তি দেয়া হয়েছে। একই সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনী ভালোভাবে কাজ করছে না। তারা এখনও ভয়ের মধ্যেই আছে। কিশোরগ্যাং নামক উঠতি বয়সী সন্ত্রাসীদের উৎপাত তো আছেই। সুতরাং অপরাধ যে বেড়ে যাবে, তা তো আর বলার অপেক্ষা রাখে না। বিষয়টি সরকারের বোঝা উচিত ছিল।

পুলিশের তথ্যানুযায়ী, গত বছরের নভেম্বর ও ডিসেম্বরেও আগের পাঁচ বছরের একই মাসের তুলনায় ছিনতাই, ডাকাতি ও অপহরণের ঘটনা বেড়েছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতির লক্ষ্যে গত ৮ ফেব্রুয়ারি থেকে ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট’ শুরু হলেও অপরাধের এই ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা অব্যাহত আছে। মওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধবিজ্ঞান ও পুলিশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ওমর ফারুক বলেন, গত ছয় মাসে ছিনতাই, ডাকাতি ও চুরির মতো অপরাধ বেড়ে যাওয়ার বিষয়টি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এই অপরাধগুলো বেড়ে যাওয়া কি আইনশৃঙ্খলা সন্তোষজনক থাকার লক্ষণ? আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকার দাবির সমালোচনা করে তিনি বলেন, মানুষ খুন, চুরি, ছিনতাইয়ের ভয়ের মধ্যে বসবাস করছে। 

সরকারকে এ ব্যাপারে উদাসীন মনে হচ্ছে কারণ তারা এই সমস্যা সমাধানের উপায় জানে না। ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, ‘অপরাধের হার জনসংখ্যার ওপর নির্ভর করে। অপরাধের হার বাড়ছে নাকি কমছে, তা জরুরি বিষয় নয়, তবে যখন হাই-ইমপ্যাক্ট অপরাধ বেড়ে যায় তখন জনগণের মধ্যে ভয়ের অনুভ‚তি তৈরি হয়। সরকার কি এটা বোঝে না? ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মুখে গত বছরের ৫ আগস্ট দেশ ছেড়ে ভারতে চলে যান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ওইদিন এবং এর আগে-পরে দুই দিন সারাদেশে চলে তাণ্ডব। দেশের সিংহভাগ থানা আক্রমণের শিকার হয়। লুট হয়ে যায় পুলিশের অস্ত্র ও গোলাবারুদ। অনেক থানা পুড়িয়ে দেয় হামলাকারীরা। অনেক পুলিশ সদস্যও খুন হয়। পুলিশের অনেক উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তাও পালিয়ে যান। তাদের অনেকে এখনো কাজে যোগ দেননি। 

তাণ্ডবের পর থেকেই পুলিশের মধ্যে একটা আতঙ্ক কাজ করছে। তারা অনেকটা নিরাপদ অবস্থানে থেকে দায়িত্ব পালন করছেন।  অন্তর্বর্তী কিংবা তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতিতে তো বিরোধী দল থাকে না। হ্যাঁ, ঠিকই বলেছেন। বিষয়টি আমিও জানি। কিন্তু এখন যারা ক্ষমতায় রয়েছেন, তারা আবার বিরোধী দলেও রয়েছেন। বিষয়টি একটু খোলাসা করে বলি। সরকার প্রধান ইউনূস সাহেব একাধিক বার বলেছেন, ছাত্ররা তাকে ক্ষমতায় বসিয়েছেন। ছাত্ররা যতদিন চাইবেন, তিনি ততদিন ক্ষমতায় থাকবেন। তিনি যথার্থই বলেছেন। তিনি ছাত্রদের প্রতিনিধি হয়ে ক্ষমতায় আছেন। 

ছাত্র প্রতিনিধি দুজন- আসিফ মাহমুদ সজীব ভূইয়া ও মাহফুজ আলম সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে আছেন। আরেকজন উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম উপদেষ্টার পদ থেকে পদত্যাগ করে একটি দলের দায়িত্ব নিয়েছেন। এই দলের নাম জাতীয় নাগরিক কমিটি (এনসিপি)। তিনি দলটির আহ্বায়ক। দলটি ছাত্রদের; যারা অভ্যুত্থান ঘটিয়েছিলেন। সুতরাং দলটি যে সরকারের আনুকূল্য পাবে, তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। এরই মধ্যে আত্মপ্রকাশের দিন দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে হাজার হাজার মানুষ ঢাকায় জমায়েত হন। বিভিন্ন জেলার ডিসিরা গাড়ি রিকুইজিশন করে তাদের ঢাকায় আসার ব্যবস্থা করেন। 

ডিসিরা তো প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী। কোনো দলের কর্মীদের ঢাকায় পাঠানোর দায়িত্ব তারা কেন নিলেন? নাকি তারা দায়িত্ব নিতে বাধ্য হয়েছেন? আর সেটা তো অস্বাভাবিক কিছু না। কারণ নাহিদ ইসলাম দলের প্রধান। তিনি সরকারের উপদেষ্টা ছিলেন। সরকারে তার এখনো প্রভাব আছে। এছাড়া উপদেষ্টা সজীব ভূইয়া আর মাহফুজ আলমও তারই লোক। এতে স্পষ্ট হয় দল গঠনে সরকারের আনুক‚ল্য রয়েছে। এমন একটা আশঙ্কার কথা কিন্তু বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর একাধিকবার জানিয়েছেন। সরকারের আনুক‚ল্যে দল গঠন এদেশে নতুন কিছু নয়। 

দেশের বিভিন্ন দপ্তরে এখনো ছাত্র প্রতিনিধি রয়েছেন। তাদের ঘাড়ে বন্দুক রেখে শিকার করছেন দুর্নীতিবাজ আমলারা। যেহেতু ছাত্রদের একটা দল হয়ে গেছে; সেহেতু তারা এখন আর ছাত্র প্রতিনিধি নেই। তারা দলের প্রতিনিধি। তাহলে তারা কেন ছাত্র প্রতিনিধি পরিচয়ে থাকবেন। তারা তো এনসিপি কর্মী। বিভিন্ন দপ্তরে যদি এনসিপির প্রতিনিধি থাকে, তাহলে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি, জামায়াতসহ অন্য দলগুলো প্রতিনিধি দিতে চাইলে অবস্থা কী দাঁড়াবে? বিষয়টি ভাবতেই গা শিউরে উঠে। আশাকরি সরকার ও এনসিপি বিষয়টি ভেবে দেখবে।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট