Image description

বাংলাদেশসহ সমগ্র বিশ্বে কৃষিক্ষেত্র দীর্ঘদিন ধরে মানুষের অর্থনৈতিক ও সামাজিক জীবনের মূল ভিত্তি হিসেবে কাজ করে আসছে। কৃষির মাধ্যমে আমরা খাদ্য নিরাপত্তা, রাষ্ট্রীয় সেবা ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের দিক এগিয়ে নিয়ে যাই। তবে, আজকের দিনেও কৃষিক্ষেত্রে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বাঁক ও সংকট দেখা দেয়। তখন প্রশ্ন ওঠে- “কৃষি কাজে সংস্কার নাকি কৃষকদের সংস্কার?” 

আজকের বিশ্বে বিজ্ঞানের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে কৃষিক্ষেত্রেও আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবে, অনেক ক্ষেত্রে কৃষকদের মধ্যে এই প্রযুক্তির ব্যাপারে যথেষ্ট জ্ঞান ও আগ্রহের অভাব দেখা যায়। নতুন ধরনের চাষাবাদ কৌশল, উন্নত বীজ, সেচ প্রযুক্তি ও সার ব্যবস্থাপনার ব্যাপারে যথাযথ তথ্যের অভাবে প্রচলিত পদ্ধতিতে চলতে থাকলে উৎপাদনশীলতা কমে যায়। উদাহরণস্বরূপ, ডিজিটাল কৃষি ও স্মার্ট ফার্মিং সম্পর্কিত ধারণা এখনও প্রচলিত অনেক এলাকার কৃষকদের কাছে অপরিচিত। 

আধুনিক প্রযুক্তির সুযোগ গ্রহণে ব্যর্থ হলে, কৃষকদের উৎপাদনশীলতা ও প্রতিযোগিতামূলক অবস্থান দুর্বল হয়ে পড়ে। বাজার ব্যবস্থাপনার অভাব এবং অর্থনৈতিক নীতির দুর্বলতা কৃষি খাতে অনেক সমস্যা সৃষ্টি করছে। উৎপাদনের পর, কৃষিপণ্য বিপণনে অনেক ক্ষেত্রেই কৃষকদের ধান-ধানের মূল্য খুব কমেই পাওয়া যায়। মধ্যস্থতাকারীদের দ্বারা করে নেয়া যথাযথ মূল্য নির্ধারণ, বাজারে অতিরিক্ত সরবরাহের কারণে মূল্য হ্রাস, এবং সরকারি নীতিমালা প্রায়ই কৃষকদের পক্ষে কাজ করে না। এর ফলে কৃষকদের নিরবচ্ছিন্ন আয়ের নিশ্চয়তা অস্বাভাবিক ও অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। ক্রমাগত আয়ের অনিশ্চয়তা ও বাজারের অস্থিরতা কৃষকদের চেতনায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলে, যা একটি প্রভাবশালী সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা নির্দেশ করে। 

বাংলাদেশ একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ দেশ। বন্যা, চক্রবাত, খরা এবং অন্যান্য দুর্যোগ কৃষি কার্যক্রমে ব্যাঘাত ঘটায়। এছাড়া, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে মৌসুমি অনিয়ম ও অপ্রত্যাশিত আবহাওয়া পরিস্থিতি কৃষকের জন্য অতিরিক্ত চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব দুর্যোগ ও পরিবর্তনের মোকাবিলায় কোনো পর্যাপ্ত ব্যবস্থাপনা বা প্রযুক্তিগত সাহায্য না থাকলে কৃষি উৎপাদন ও কৃষকদের জীবিকা দুটোই মারাত্মক ঝুঁকিতে পড়ে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও সহায়তামূলক কাঠামো সংস্কারের মাধ্যমে এই সমস্যার সমাধানের চেষ্টা করা যেতে পারে, তবে এর আগে কৃষকদের আধুনিক দুর্যোগ মোকাবিলার দক্ষতা অর্জন করাও অপরিহার্য। বিশেষজ্ঞদের মতে, কৃষিক্ষেত্রে অন্যতম প্রধান সমস্যার মধ্যে অন্যতম হলো কৃষকদের পর্যাপ্ত শিক্ষাগত ও প্রশিক্ষণমূলক সুযোগের অভাব। 

আধুনিক কৃষি কৌশল, সঠিক বাজার বিশ্লেষণ, আর্থিক ও প্রযুক্তিগত ব্যবস্থাপনার বিষয়গুলোতে যথাযথ প্রশিক্ষণের অভাবে কৃষকরা অনেক সময় অদক্ষ বা প্রচলিত পদ্ধতি অবলম্বন করে থাকেন। কৃষি বিষয়ে সচেতনতা ও আধুনিকতার অভাব শুধুমাত্র উৎপাদনের উপর নয়, বরং কৃষকদের আত্মসম্মান, মানসিকতা এবং উদ্ভাবনী চিন্তাধারার উপরও প্রভাব ফেলে। যথার্থ শিক্ষাগত ও তথ্য প্রযুক্তির প্রশিক্ষণ কৃষকদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস ও উদ্যোগী মনোভাব তৈরি করতে সাহায্য করবে। 

“কৃষি কাজে সংস্কার” বলতে আমরা বুঝি প্রযুক্তিগত উন্নয়নের, আধুনিক পদ্ধতি ও নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার পরিবর্তনের প্রয়াস। আর “কৃষকদের সংস্কার” বলতে বুঝায় কৃষকের মানসিকতা, শিক্ষা, আচরণ, ও সামাজিক ও অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন। এখানে উভয় দিকেই সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে, তবে কোনটি প্রধান, তা নির্ভর করে পরিস্থিতির গুরুত্ব এবং সমস্যার মূল কারণের উপর।

উন্নত কৃষি প্রযুক্তির গ্রহণযোগ্যতা: নতুন যুগের কৃষিতে কম্পিউটারাইজড সেচ, ড্রোনের মাধ্যমে ফসল পর্যবেক্ষণ, উন্নত প্রক্রিয়াকরণ প্রযুক্তি ও অটোমেশন ব্যবস্থার ব্যবহার অত্যন্ত জরুরি। উদাহরণস্বরূপ, কৃষি মেশিনাইজেশন ও সঠিক সময়ে সেচ প্রদান উন্নত ফসল উৎপাদনে সহায়ক হবে। এতে কৃষকের শারীরিক পরিশ্রম কমবে এবং উৎপাদনের পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে। 

“কৃষি কাজে সংস্কার নাকি কৃষকদের সংস্কার?” প্রশ্নটি শুধুমাত্র একটি দ্বিমুখী দিশার আলোচনাকে নির্দেশ করে না, বরং এর মধ্যে এক নিবিড় আন্তঃসম্পর্কিত প্রকৃত চ্যালেঞ্জ রয়েছে। আধুনিক প্রযুক্তির অগ্রগতি, বাজারের চাহিদা, পরিবেশ ও সামাজিক পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে কৃষিক্ষেত্রে একদিকে টেকসই উন্নয়নের প্রচেষ্টা চলছে, অন্যদিকে কৃষকদের মধ্যে প্রচলিত মানসিকতা ও অনিচ্ছার বাধা রূপে অবস্থান করছে। কেবলমাত্র কৃষি কাজে প্রযুক্তিগত সংস্কার, উন্নত রূপান্তর বা আধুনিক ব্যবস্থাপনা নিয়ে আসলে চলবে না। কৃষকদের মধ্যে নিজস্ব উদ্ভাবনী চিন্তা, ঝুঁকি গ্রহণের মানসিকতা এবং পরিবর্তনের প্রতি এক ইতিবাচক মনোভাব তৈরি করা অবশ্যই প্রয়োজন। তথ্যপ্রযুক্তি, প্রশিক্ষণ কর্মশালা, নীতি প্রণয়ন ও বিনিয়োগের মাধ্যমে কৃষিক্ষেত্রে দুটি দিকের পরিবর্তনের সমন্বয় ঘটলে সৃষ্টিশীল ও টেকসই উন্নয়ন সম্ভব হবে। 

স্বচ্ছ এবং স্থায়ী উন্নয়নের জন্য, সরকার, বেসরকারি সংস্থা এবং সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে একত্রে কাজ করতে হবে। কৃষকদের আর্থিক সহায়তা, প্রযুক্তিগত প্রশিক্ষণ ও সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের একটি সুসঙ্গত প্রক্রিয়া গড়ে তুলতে হবে। এই সমন্বিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে যদি কৃষি খাতে নতুন প্রযুক্তি ও দক্ষতা প্রবাহিত করা সম্ভব হয়, তবে কৃষকদের আর্থিক নিরাপত্তা, সামাজিক মর্যাদা এবং ব্যক্তিগত আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি পাবে। 

কৃষিক্ষেত্রে সংস্কার কোন একক প্রক্রিয়া নয়, বরং এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া যা সময়, অবিচল সাধনা ও আন্তঃসম্পর্কিত পরিবর্তনের প্রয়োজন। কৃষকরা যদি নতুন যুগের চ্যালেঞ্জ মেনে নিতে পারতেন এবং প্রযুক্তির সঙ্গে তাল মিলিয়ে নিজেদের মানসিকতা ও কর্মপদ্ধতিতে পরিবর্তন আনতে পারতেন, তবে কৃষি খাত শুধু আমাদের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে না, বরং দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নে এক উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখবে।

লেখক: শিক্ষার্থী