
বাংলাদেশে নানান কারণে অস্বাভাবিক মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। জুলাই আন্দোলনে দেড় হাজারের বেশি মানুষ মৃত্যুবরণ করেন এদিকে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে নিত্যদিন অনেক মানুষ মারা যাচ্ছেন এবং বিগত দুই মাসে দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির ভঙ্গুর দশার সুযোগ নিয়ে অনেককে হত্যা করা হয়েছে। এর পাশাপাশি সবচেয়ে বেশি মানুষ অনাকাক্সিক্ষতভাবে মৃত্যুবরণ করেছেন এবং করছেন সড়ক দুর্ঘটনায়। মানুষ সড়ক পথে গন্তব্য থেকে গন্তব্যে ছুটে বেড়ান প্রয়োজনের তাগিদে, নিজের ও পরিবারের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য নিশ্চিতের আশায় কিন্তু সেই সুখের খোঁজে বের হয়ে মানুষকে বীভৎসভাবে গাড়িতে পিষ্ট হয়ে চলে যেতে হয় এই ধূলির ধরা ছেড়ে পরপারে।
রোড সেফটি ফাউন্ডেশন এর তথ্যানুযায়ী, চলতি বছরের সেপ্টেম্বর মাসে দেশে ৩৯২ টি সড়ক দুর্ঘটনার ঘটনা ঘটেছে মারা গেছেন ৪৪৬ জন। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির দেওয়া তথ্য মোতাবেক, ২০২৩ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় ঝরেছে ৭৯০২ টি তাজা প্রাণ। অপরদিকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, বাংলাদেশে বছরে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন ২৪ হাজার ৯৯৪ জন। এর পাশাপাশি, হাজার হাজার মানুষ সড়ক দুর্ঘটনার কবলে পড়ে বিকলাঙ্গ হয়ে পড়েন। তাদের মধ্যে অনেকে রয়েছেন যারা পরিবারের সকল সদস্যের দায়িত্ব পালন করতেন, আবার তারাই হয়ে যান পরিবারের জন্য বোঝা।
আমরা জুলাই গণঅভ্যুত্থানের হত্যাকাণ্ডের বিচার চাইছি, ডেঙ্গু মোকাবিলায় ব্যর্থ হওয়ায় সরকারের সমালোচনা করছি। বিভিন্ন মহল এই বিষয়গুলো নিয়ে বেশ সরগরম, আদতে তা হওয়াই উচিত কিন্তু এই যে হাজার হাজার মানুষ সড়কে চাকার নিচে পিষ্ঠ হয়ে মর্মান্তিকভাবে প্রাণ হারাচ্ছেনক্স এটাও এক ধরনের হত্যা, এই হত্যাকাণ্ডের বিচার তো আমরা চাইছি না। কোন কোন মহলের অবহেলার কারণে এসব হত্যাকাণ্ড অবলীলায় ঘটে চলেছে তার হিসেবও আমরা কষতে বসছি না।
গত সেপ্টেম্বর মাসে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ৮০ জন মানুষ মারা যান, অপরদিকে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান ৪৪৬ জন যা ডেঙ্গু আক্রান্তের মৃত্যুর চেয়ে সাড়ে পাঁচ গুণের বেশি। মৃত্যুর সংখ্যা বিবেচনায় আমাদের ডেঙ্গুর চেয়ে সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে অনেক বেশি উদ্বিগ্ন থাকা উচিত, বিভিন্ন মহলে আলাপ করা উচিত। তবে বাস্তবতা ভিন্ন! আমাদের সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে যতটুকু আলোচনা হওয়া উচিত ততটুকু আলোচনা না হওয়ার বিষয়টা মূলত সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে গণসচেতনতার অভাবের পরিচায়ক। আমার বক্তব্যের সারকথা সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে যতটুকু সোচ্চার হওয়া উচিত ততটুকু আমরা মোটেও নয়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই সড়ক দুর্ঘটনায় পেছনে দায়ী ট্রাফিক নিয়ম না মানার প্রবণতা, ট্রাফিক আইন সম্পর্কে অজ্ঞতা, ফিটনেসবিহীন গাড়ি, অদক্ষ চালক, সংকীর্ণ রাস্তা, গণমানুষের সচেতনতার অভাব, সড়কের বেহাল দশা, ট্রাফিকের দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিদের উদাসীনতা ইত্যাদি। সড়কের মৃত্যু অপরিকল্পিত হতে পারে কিন্তু এটা মানতে কারো দ্বিধা থাকার কথা নয়, এটা পরিকল্পিহীনতার ফসল। ২০১৮ সালে নিরাপদ সড়ক আন্দোলন হয়েছিল, আন্দোলনকারীদের চাপের মুখে সরকার সড়ক পরিবহন আইন জারি করেছিল কিন্তু তা বেশিদিন স্থায়ী হয়নি আইনি সংস্কার করে অনেকটা শিথিল করা হয়েছিল। এমনকি সড়ক নিরাপত্তা নিয়ে যে বিদ্যমান আইনটি রয়েছে অদ্যাবধি সেটিরও যথাযথ প্রয়োগ ঘটেনি।
দেশের রাজনৈতিক পালাবদল ঘটেছে, দেশে প্রথমবারের মতো অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়েছে। এই সরকারের কাছে বিগত যেকোনো সরকারের চেয়ে জনসাধারণের প্রত্যাশা কয়েক গুণ বেশি কিন্তু বর্তমান সরকারও সড়ক দুর্ঘটনা রোধে ও যানজট নিরসনে এখনো তেমন কোনো কার্যকর পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে পারেনি। সড়ক দুর্ঘটনার হার সবচেয়ে বেশি রাজধানী শহরে। ২০২৩ সালে ঢাকায় সড়ক দুর্ঘটনায় ১৭১২ জন নিহত হন। কিন্তু খোদ রাজধানীতেই বিভিন্ন সড়কের পাশে পার্কিং দেখা যাচ্ছে, দেখা যাচ্ছে সড়কের মধ্যে খানাখন্দ। রাজধানীজুড়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে বহু সংখ্যক ফিটনেসবিহীন গাড়ি এবং চালকদের মনোভাবও বেপরোয়া।
সড়ক দুর্ঘটনায় শুধুমাত্র একটি প্রাণ ঝরে না, অনেক সময় সেই প্রাণের সাথে জড়িয়ে থাকে একটি পরিবারের ভবিষ্যৎ। পরিবারের একমাত্র কর্মক্ষম ব্যক্তি যখন সড়ক দুর্ঘটনায় অনাকাক্সিক্ষতভাবে মৃত্যুবরণ করেন তখন সেই পরিবারটি অসহায়ভাবে অক‚ল পাথারে হাবুডুবু খেতে থাকে। সড়ক দুর্ঘটনায় সম্পদের ক্ষতির পরিমাণ ব্যাপক। বুয়েটের সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের হিসাব বলছে, ২০১৮ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত তিন বছরে সড়ক দুর্ঘটনায় ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ১ লাখ ৯ হাজার কোটি টাকা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনাজনিত জিডিপির ক্ষতি ৫.৩ শতাংশ। কাজেই বোঝা যাচ্ছে, সড়ক দুর্ঘটনা মানুষের প্রাণনাশের পাশাপাশি দেশের অর্থনীতির বিরাট ক্ষতিসাধন করে। ইতোমধ্যেই সড়ক দুর্ঘটনামুক্ত বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে ‘সড়ক নিরাপত্তা আইন’ নামে নতুন একটি আইন প্রণয়নের দাবি জানিয়েছে নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা)।
তারুণ্যের শক্তিকে কাজে লাগানোর পক্ষে বেশ ভালো একটি প্রস্তাবনা। আমাদের মনে রাখতে হবে, শুধু আইন প্রণয়ন করে এই সড়ক দুর্ঘটনা রোধ করা সম্ভব নয়। সড়ক দুর্ঘটনার রোদে আইন একটি সহায়ক ভ‚মিকা পালন করবে কিন্তু শুধুমাত্র এটির দ্বারা এই সংকট মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। এর জন্য প্রয়োজন সরকার ও জনগণের সম্মিলিতভাবে আন্তরিক প্রচেষ্টা। সড়ক দুর্ঘটনার রোধে সরকারি বেসরকারি পর্যায়ে থেকে জনসচেতনতা সৃষ্টিতে বিভিন্ন উদ্যোগ নিতে হবে। জনসচেতনতার পাশাপাশি চালক ও পথচারী উভয়কেই সড়ক দুর্ঘটনা রোধে প্রশিক্ষণ দিতে হবে।
আওয়ামী লীগ সরকার জাতিসংঘের কাছে প্রতিজ্ঞা করেছিল ২০২০ সালের মধ্যে তারা বাংলাদেশের সড়ক দুর্ঘটনার হাত থেকে নামিয়ে আনবে কিন্তু সেই প্রতিজ্ঞা আর আলোর মুখ দেখেনি। অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে আমাদের দাবি, সড়ক দুর্ঘটনার রোদে অতিসত্বর আইন প্রণয়ন করুন এবং যেসব সড়কের বেহাল দশা সেগুলো সংস্কার, অদক্ষ চালকদের অপসারণ, ফিটনেসবিহীন গাড়িগুলোকে নিষিদ্ধকরণ ও নিয়ম বহির্ভূত পার্কিং নিষিদ্ধের বন্ধের পাশাপাশি প্রয়োজনে সড়ক দুর্ঘটনা রোধে একটি কমিশন গঠন করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করুন। পরিশেষে আবারো স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, সরকারি হিসেব অনুযায়ী গড়ে প্রতিদিন সড়কে প্রায় ১৪ জনের মৃত্যু হয়। কাজেই সড়ক দুর্ঘটনার বিষয়টি সর্বোচ্চ গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা এখন সময়ের দাবি।
লেখক: শিক্ষার্থী ও প্রাবন্ধিক
Comments