Image description

একমাস আগে গত ৮ আগস্ট যাত্রা শুরু করেছিল ড. মুহাম্মদ ইউনূস এর নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। ইতোমধ্যেই একটি মাস পেরিয়ে গেছে। দীর্ঘদিন ১৭  বছরের স্বৈরশাসনের পর ছাত্র-জনতার ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের মাধ্যমে অর্জিত বিজয়ের ফসল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস কখনোই মসৃণ এবং সাধারণ জনগণের আকাক্সক্ষা অনুযায়ী ছিল না। যুগে যুগে এখানে বিপুল জনপ্রত্যাশা নিয়ে নতুন নেতৃত্বের সরকার এসেছে। নির্বাচনে জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে ক্ষমতায় এলেও একসময় সেই বিপুল জনসমর্থন নিয়ে অধিষ্ঠিত সরকারটি ক্রমেই অজনপ্রিয়, স্বৈরাচারী স্বেচ্ছাচারী হিসেবে পরিগণিত হয়েছে। জন আকাক্সক্ষার বিপরীতে অবস্থান নিয়ে একের পর এক স্বেচ্ছাচারিতা, অন্যায়, অনিয়ম দুর্নীতির নতুন নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের দুর্নীতি স্বেচ্ছাচারিতা, অনিয়ম, বিরোধী মতের লোকজনদের ওপর নির্যাতন, হত্যা গুম খুন চালিয়ে রীতিমতো এক নারকীয় পরিবেশ সৃষ্টি করেছিল। অথচ বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত এই রাজনৈতিক দলটি গণতন্ত্র, সামাজিক ন্যায়বিচার, সামাজিক সাম্য, অসাম্প্রদায়িক ধর্মীয় সম্প্রীতির একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে অনবদ্য অবদান রেখেছিল।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত স্বাধীনতা পরবর্তী প্রথম সরকার যখন দেশ পুনর্গঠনের পথে সফলতা অর্জন করতে শুরু করেছিল, তখন তিনি  বিপথগামী কতিপয় মানুষের নির্মমতার শিকার হয়েছিলেন। এরপর নানা চড়াই-উতরাই পথ পাড়ি দিয়ে এগিয়ে যেতে হয়েছে বাংলাদেশকে। সময়ের পরিক্রমায় পর পর চারবার বাংলাদেশের রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ছাত্র-জনতার ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের মুখে টিকতে না পেরে দেশ ছেড়ে প্রতিবেশী দেশে আশ্রয় গ্রহণ করতে হয়েছে। এবারের আন্দোলন কোনো রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বে হয়নি। প্রচলিত ছাত্রসংগঠনও সেভাবে রাস্তায় নামেনি। নেতৃত্ব দিয়েছিল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। এরা সেই অর্থে ছাত্রনেতা ছিলেন না। কোটা সংস্কারকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা, যাদের কেউ কেউ ছাত্রসংগঠন করলেও বেশির ভাগ ছিলেন সাধারণ ছাত্রছাত্রী। আন্দোলনের নেতৃত্বেও তারা বিরল যূথবদ্ধতার পরিচয় দিয়েছেন। শতাধিক সমন্বয়ক ও সহসমন্বয়ক নিয়ে অতীতে কোনো আন্দোলন এ দেশে গড়ে ওঠেনি। ডিবি অফিসে আটক থাকা ছয় সমন্বয়ককে দিয়ে সরকার কর্মসূচি প্রত্যাহারের ঘোষণা দেওয়ানোর পরও তাদের মধ্যে কোনো ভুল-বোঝাবুঝি হয়নি। একপর্যায়ে শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলন হয়ে ওঠে রাষ্ট্র সংস্কারের আন্দোলনে।

বাংলাদেশের এই আন্দোলনে দেখা গেছে এমন কিছু দৃশ্য যা বাংলাদেশের রাজনীতিতে আগামী দিনে বড় ধরনের পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে। এমন বিজয় বাংলাদেশের মানুষ আগে দেখেনি, এমন পতনও তারা দেখেনি। দাম্ভিকতা, অহমিকা, আমিত্ত্ব, বিরোধী মতের মানুষকে কোনোভাবেই সম্মান মর্যাদা না দিয়ে অপমান তুচ্ছতাচ্ছিল্য করায় প্রবণতা, চাটুকার পরিবেষ্টিত হয়ে সর্বনাশা সিদ্ধান্ত গ্রহণ শেখ হাসিনাকে ভয়ঙ্কর পতনের দিকে, মারাত্মক পরিণতির দিকে এগিয়ে নিয়ে গেছে। নিজের সর্বনাশ ডেকে আনছেন এটি তিনি উপলব্ধি না করে আরও বেপরোয়া আরও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছিলেন। তার শেষের দিককার কর্মকাণ্ড দেশের সব মানুষকে চরমভাবে বিক্ষুব্ধ করে এক কাতারে নিয়ে এসেছিলেন। তখন শিক্ষার্থীদের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন স্বৈরাচারী স্বেচ্ছাচারী শেখ হাসিনার দুঃশাসন অবসান এবং তার বিদায়ের এক দফা দাবিতে পরিণত হয়। যার চূড়ান্ত পরিণতি তার পদত্যাগ এবং দেশ ছেড়ে পলায়ন। সবশেষে পার্শ্ববর্তী দেশে আশ্রয় গ্রহণ।

একজন জননেত্রী থেকে ভয়ঙ্কর স্বৈরাচারী রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে আবির্ভূত হয়ে দেশ-বিদেশে নিন্দনীয় হয়েছেন আরও আগেই। বিভেদ ও বিভাজনের রাজনীতির মাধ্যমে শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে কার্যত একটি মাফিয়া রাষ্ট্রে পরিণত করেছিলেন। শেখ হাসিনা রাষ্ট্র পরিচালনায় তৈরি করেছিলেন কয়েক স্তরের সুবিধাভোগী শ্রেণি। আদালতের কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছিল সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী ও ভিন্ন মতাবলম্বীদের ওপর নিপীড়নমূলক শাস্তি চাপিয়ে দেয়া। ফলে বাংলাদেশ থেকে বিচার ও আইনের শাসন বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। সামগ্রিকভাবে একটি রক্ত পিপাসু পুলিশ প্রশাসন ও বিচার বিভাগ গড়ে তোলা হয়েছিল। শেখ হাসিনার ১৭ বছরের দুঃশাসনে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা, প্রশাসন পরিচালনা ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে ব্যক্তি পূজার এক অনন্য উদাহরণ তৈরি করেছিলেন। ছাত্র আন্দোলনের মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনার পতন যেমন নতুন এক গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ার সম্ভাবনা তৈরি করেছে তেমনি বাংলাদেশ রাষ্ট্র ভয়ানক এক ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। গণআন্দোলনে শেখ হাসিনার পতনের কারণে বাংলাদেশের রাজনীতি ও প্রশাসনে এক ধরনের শূন্যতা তৈরি হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এখন দ্রুত সরকারকে রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয় সংস্কারের মাধ্যমে নতুন নির্বাচনের পথে যেতে হবে।

ড. ইউনূসের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের নতুন যাত্রা শুরু হতে পারে। সত্যিকার অর্থে হয়তো তার নেতৃত্বে বিভাজনের রাজনীতির অবসান ঘটিয়ে বাংলাদেশ সামনের দিকে এগিয়ে যাবে। এখন যে অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকার আসছে, তাদের সামনে বিরাট চ্যালেঞ্জ। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আজ ভূলুণ্ঠিত। একাত্তরের চেতনায় বৈষম্যহীন বাংলাদেশ আমরা গড়তে পারিনি। নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানের স্বপ্ন আমরা বাস্তবায়ন করতে পারিনি। গণতান্ত্রিক বিধিব্যবস্থা কায়েম করা যায়নি। ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়নি সুশাসন। আমরা কি ২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানের পর সেই বাংলা ফিরে পাব, যেখানে সবাই মেধা ও যোগ্যতায় চাকরি পাবে, অর্থনীতিতে সাম্য আসবে? যে শ্রম ও কর্মজীবী মানুষ শিক্ষার্থীদের পাশে থেকে এই আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন, তাদের জীবনে কি শান্তি ও স্বস্তি ফিরে আসবে? শেখ হাসিনার স্বৈরাচারী দুঃশাসন দেশের প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করে দিয়েছে। ফলে ছাত্র-জনতার ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের মুখে ক্ষমতা থেকে বিদায় নিয়ে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার পর সব ক্ষেত্রেই চরম বিশৃঙ্খলা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। শেখ হাসিনার নৃশংস স্বৈরাশাসনের বিরুদ্ধে জেগে উঠেছিল সারা দেশ। লাখো লাখো বীর জনতা রাজপথে নেমে এসেছিল মৃত্যুর পরোয়া না করে। শেখ হাসিনা তার ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে নির্বিচারে গণহত্যা চালিয়েছেন তার অনুগত পুলিশ বাহিনী এবং তার পোষ্য ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীদের মাধ্যমে। স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশে ভয়াবহতম গণহত্যা প্রত্যক্ষ করেছে দেশের মানুষ, আন্তর্জাতিক মহল।

ইতোমধ্যেই এ সম্পর্কিত নানা রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে। দেশের তরুণ প্রজন্ম দেশ নিয়ে একটি নতুন স্বপ্ন দেখেছে। যে স্বপ্ন একটি নতুন যুগের সূচনা করেছে। তারা এমন একটি দেশের স্বপ্ন দেখছে, যেখানে দেশের আপামর মানুষ তাদের রাজনৈতিক, ধর্মীয় বা তাদের জাতিগত পরিচয় নির্বিশেষে পূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ভোগ করতে পারবে। সরকার গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার, মানবাধিকার ও বাকস্বাধীনতা সমুন্নত রাখবে।

দেশে একটা গণ-অভ্যুত্থান হয়েছে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কার নিয়ে কথা হচ্ছে। রাষ্ট্র সংস্কার, রাজনৈতিক সংস্কার নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরে এ দেশে এক ধরনের রাজনৈতিক ব্যবস্থা চলেছে। যে রাষ্ট্র ও সরকারব্যবস্থার পতন হলো, তা এক ধরনের স্বৈরাচারী, কর্তৃত্ববাদী ব্যবস্থা ছিল। এর ভিত্তিই ছিল বিরোধী সব সংগঠন, সেটা ব্যাংকই হোক, কোম্পানি বা রাজনৈতিক দল হোক-এগুলো ভেঙে ফেলা, দুর্বল করা এবং ভেতর থেকে চূর্ণ করে দেওয়া। আর জনগণের মধ্যে একটা ভয় ছড়িয়ে দেওয়া যে আমার বিরুদ্ধে কেউ কথা বললে গায়েব হয়ে যাবে। ছাত্রদের আন্দোলন যখন গণ-অভ্যুত্থানে পরিণত হলো, এটা উৎখাত হলো। এই সাফল্যের কারণ এর কোনো সংগঠিত ভিত্তি ছিল না। যে শক্তি সরকারব্যবস্থাকে চূর্ণ করল, সেটি অসংগঠিত রাস্তার শক্তি। এরা কিন্তু আজীবন রাস্তায় থাকতে পারবে না। এখন আমাদের অর্জনগুলো বাস্তবমুখী করতে হলে নিয়ম-কানুনের মধ্যে আসতে হবে। বিগত ১৬ বছরের দুঃশাসন আমাদের সব সংগঠন বা প্রতিষ্ঠান ভেঙে ফেলেছে। বিশ্ববিদ্যালয়, ট্রেড ইউনিয়ন, কোম্পানি, ব্যাংক-কিছুই অবশিষ্ট নেই। সুতরাং আমরা এখন যত সুন্দর আইনই করি না কেন, তা কাজ করবে না। তবে হতাশ হলে চলবে না। আমাদের একদিকে নিয়ন্ত্রণ জোরদার করতে হবে, অন্যদিকে সংগঠনও তৈরি করতে হবে। তবে খুব দ্রুত সবকিছু কাজ করবে না। কোনো কোনো সংগঠন দ্রুত তৈরি করা যাবে, কোনো কোনোটি তৈরি করতে পাঁচ-ছয় বছর লেগে যেতে পারে। কালকেই যদি আমরা নরওয়ের মতো দেশ হতে চাই, তাহলে সব ধসে যাবে। এখন সংস্কারের কথা বলাবলি হচ্ছে। সমাজের বিভিন্ন অংশ থেকে এখন নানা রকমের সংস্কারের দাবি উঠছে। কখনো কখনো তা পরস্পরবিরোধীও মনে হচ্ছে। কিন্তু একটি অন্তর্র্বর্তী সরকারের পক্ষে এসব সংস্কারের দাবি কতটা পূরণ করা সম্ভব হবে?

ছাত্রসমাজের কোটা সংস্কার আন্দোলনের প্রাথমিক জয়ের পর সমন্বয়কদের বক্তব্যে স্পষ্ট স্বীকৃতি রয়েছে যে উপযুক্ত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন ও প্রচলিত ধারার রাজনীতির বাইরে গিয়ে রাষ্ট্রের সব প্রতিষ্ঠান নতুন করে গড়ে তোলা প্রয়োজন। পাশাপাশি গতানুগতিক ধারায় দেশ পরিচালনার রাজনীতি পুনঃস্থাপনের উদ্যোগও লক্ষণীয়। এ প্রবণতা ইতিহাসে বহুবার দেখা গেছে। সাধারণ মানুষ যখন আত্মত্যাগের মাধ্যমে বিজয়ের দোরগোড়ায় পৌঁছে, সেসময় পক্ষে-বিপক্ষের কিছু শক্তিধর স্বার্থগোষ্ঠী দরকষাকষি ও সমঝোতা করে পুরনো ধাঁচে নতুন সরকার প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয়। সমাজে দ্রুত স্থিতি ফিরিয়ে আনার জন্য নির্দিষ্ট আন্দোলনের দ্রুত পরিসমাপ্তি টানার চাপ থাকে। সেই প্রক্রিয়ায় প্রথাগতভাবে যাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন হয়েছিল, তারা যেমন সংবিধানের বাধ্যবাধকতার কারণে জড়িত থাকেন, তেমনি দেশি-বিদেশি নানা শক্তি বা স্বার্থ ভবিষ্যৎ রূপরেখাকে প্রভাবান্বিত করার জন্য সক্রিয় ভূমিকায় লিপ্ত হয়। নানা কারণে যাদের রক্তের বিনিময়ে নির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জন সম্ভব হয়েছে, তারা অন্তর্বর্তীকালীন প্রক্রিয়ায় পর্যাপ্ত ভূমিকা রাখতে পারেন না অথবা সুকৌশলে তাদেরকে প্রক্রিয়ার বাইরে রাখার প্রচেষ্টা থাকে। নতুন এক সোনালি সময়ের প্রত্যাশায় আমরা বুক বেঁধেছি। আগেও অনেকবার আশায় বুক বাঁধলেও বারবার আমাদের আশাহত হতে হয়েছে। এবার আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস, তরুণ প্রজন্মের এই গৌরবময় বিজয় কোনোভাবেই ব্যর্থ হবে না। অতীতের মতো  দিকভ্রান্ত, পথভ্রষ্ট হবে না রাষ্ট্র এবং সরকার। 

লেখক: অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার ও কলামিস্ট