কোটা সংস্কারের একদফা আন্দোলনের চাপে ক্ষমতা ছেড়ে বিদেশে পাড়ি জমাতে বাধ্য হোন আওয়ামী লীগ সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। রাষ্ট্রপতির নিকট তিনি ক্ষমতা হস্তান্তর করে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের আগে রাষ্ট্রপতির অধীনে সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে থাকার পরও জন-জীবনে আতঙ্ক, জাতীয় সম্পদের ক্ষতিসাধন, সংখ্যালঘুদের জীবন-সম্পদ ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের উপর হামলার ঘটনা ঘটেছে। একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়েছে।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এমন একটি কাজ করবেন যেন নতুন করে আর কোনো ফ্যাসিবাদী সরকারের সৃষ্টি না হয়, যেনতেনভাবে ক্ষমতা রক্ষায় যেন কোনো সরকার মানুষ হত্যার আশ্রয় না নেয়। বাংলাদেশের মানুষের জন্য একটি বাসযোগ্য দেশ হবে সেই প্রত্যাশা শান্তি প্রিয় সকল মানুষের। সময়ের এক ফোঁড়, অসময়ের হাজার ফোঁড়।
সাম্প্রতিক কোটা সংস্কার আন্দোলনের ঘটনায় চার শতাধিক মানুয়ের জীবনহানী, (ছাত্র, পুলিশ, শিশু, সাংবাদিক) সম্পদের ক্ষতিসাধন, জনজীবনে ভীতিকর পরিবেশ, মানবাধিকারের লঙ্ঘন দেশ-বিদেশে বাংলাদেশের ভাবমূতিকে ম্লান করেছে। এই ঘটনার সাথে কম-বেশী যারা জড়িত আমার মনে হয় তারাও সাধারণ সচেতন মানুষের মতো অনুতপ্ত। তবে কেউ ক্ষমতার মোহ আর কেউ আত্ম-সম্মানের জন্য বিষয়টির ফয়সালায় আসছেন না। তবে দ্রুতই কোনো ফয়সালায় না এলে ঘটে যাওয়া ঘটনার আরো অবনতি হবে।
মানুষ মাত্রেই ভুল হয়, অতএব ভুল হতেই পারে তবে ব্যক্তির ভুল আর সরকারের ভুল এক নয়। ভুল হলে শোধরানোর পথও আছে কিন্তু যুগে যুগে শাসকদর মতো এবং ভাববাদীদের মতো যদি বিশ্বাস করে শাসক ঈশ্বরের প্রতিনিধি, শাসকের আদেশই ঈশ্বরের আদেশ, এটি লঙ্ঘন করা মানেই ঈশ্বরের আদেশ লঙ্ঘন করা। এবারের আন্দোলনের বাস্তবতায় এমন ঘটনারই প্রকাশ ঘটেছে বলে অনেকেরই ধারণা। ২০১৮ সালের কোটা সংস্কার ও নিরাপদ সড়ক আন্দেলন শুরু হয়েছিল সাধারণ শিক্ষার্থীদের ব্যানারে, সেখানে বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের কর্মী-সমর্থকরাও ছিলেন। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের কারণে সরকার কোটা সংস্কার না করে কোটাই বাতিল করে দিয়েছিলেন।
সমাজে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য বিশেষ সুবিধা প্রদানের সংবিধানের কতিপয় ধারার আলোকে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের সুবিধা নিশ্চিত করার জন্য হাইকোর্টে রিট করা হয়েছিল। হাইকোর্ট সরকারের কোটা বাতিল সংক্রান্ত সিদ্ধান্তকে বাতিল করে দিলে সরকার তার বিপক্ষে হাইকোর্টে রিট করে। কোটা পুরো বাতিল না করে যদি সরকার সংস্কার করতেন তাহলে নতুন করে এ ধরনের ইস্যু সামনে না-ও আসতে পারতো এবং এতোগুলো নিরীহ প্রাণ ঝরে পড়তো না।
সংবিধানের বিষয়টি খেয়াল রেখে সরকার সংস্কার করলেই তার সমাধান সম্ভব ছিল। ২০২৪ সালের জুলাই মাসে কোটা সংস্কার নিয়ে সৃষ্ট আন্দোলন প্রাথমিকভাবে ছিল অহিংস ও শান্তিপূর্ণ এবং সকল স্তরের মানুষের নিকট গ্রহণযোগ্য। নেতৃত্ব অরাজনৈতিক কিন্তু সরকারি দলের সাধারণ কর্মী-সমর্থকসহ বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের কর্মী-সমর্থকরাও এর সাথে যুক্ত ছিলেন। কিন্তু সরকারের দায়িত্বশীল পদের দুটি জায়গা থেকে রাজাকার-জামায়াত-শিবির আখ্যা দেয়া এবং এই আন্দোলন দমনে সরকারি দলের ছাত্র সংগঠনকে ব্যবহারে ইঙ্গিত করা পরিস্থিতিকে উত্তপ্ত করে তুলে। সরকার সমর্থিত সেই হেলমেট সাধারণ শিক্ষার্থীদের উপর হামলা করলে পরিস্থিতির অবনতি ঘটে।
সাধারণ শিক্ষার্থীদের অরাজনৈতিক একটা আন্দোলন দমন করতে ৪ শতাধিক মানুষকে কেন জীবন দিতে হলো? পৃথিবীর অধিকাংশ শাসকেরা নিজেদের সবচেয়ে জ্ঞানী এবং সবজান্তা ভাবার কারণে রাষ্ট্রীয় এ ধরনের সংকটের সৃষ্টি হচ্ছে। আমাদের দেশও এর ব্যতিক্রম নয়। ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খানের সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন, ১৯৬৯ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক জোহা এবং ঢাকায় ছাত্রনেতা আসাদ পুলিশের গুলিতে শহিদ হওয়ার কারণে ১৯৬৯ সালের ছাত্র গণঅভ্যুথান হয়েছিল, যার ফলশ্রুতিতে ’৭০-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয় সুনিশ্চিত হয়েছিল, পাকিস্তানি স্বৈরশাসকরা ক্ষমতা হস্তান্তর না করায় মুক্তিযদ্ধ হয়েছিল সেখানে ছাত্র-সমাজের বীরত্বপূর্ণ অবদানের কথা ভুলে গেলে ভুল হবে।
১৯৯০ সালের স্বৈরাচার শাসকের পতনে ছাত্রদের ঐতিহাসিক সংগ্রাম, ওয়ান ইলেভেন আন্দোলনের সময় সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে ছাত্রদের আন্দোলনের এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি বাস্তবায়নের ইতিহাস ভুলে গেলে শাসকদের বিপদে পড়ার সম্ভাবনা থাকবেই। ২০১৮ সালে গাড়িচাপায় ছাত্র মৃত্যুর ঘটনায় সাধারণ শিক্ষার্থীদের ব্যানারে নিরাপদ সড়ক আন্দোলনকে দমাতে সরকার তখনও দলীয় ক্যাডার ও হেলমেট বাহিনীকে কাজে লাগিয়েছিল।
এই হেলমেট বাহিনীর আদু ভাই ছাত্রনেতাদের ছাত্রাবাসে সিট-বাণিজ্য, রাজনৈতিক কর্মসূচি না বুঝিয়ে নিজের সংগঠনের সদস্য না করিয়ে জোর করে মিছিলে নিয়ে যাওয়া, গণরুম সংস্কৃতি চালু করে সাধারণ শিক্ষার্থীদের নির্যাতন, কিডন্যাপ বাণিজ্য, চাঁদাবাজি ও নারী কেলেঙ্কারিসহ নানান কাজের কারণে এবং অঢেল টাকা-পয়সার মালিক হওয়ায় ওই হেলমেট বাহিনীর উপর সাধারণ শিক্ষার্থী ও বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের নেতাদের যে চাপা ক্ষোভের জন্ম হয়েছিল তারই বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে।
যার ফলে ওই হেলমেট বাহিনীকে ক্যাম্পাস ছাড়া করতে পেরেছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পক্ষপাতমূলক আচরণ, ক্যাম্পাসে সকল ছাত্র সংগঠনের সহাবস্থান নিশ্চিত করতে না পারা এবং নতুন নেতৃত্ব সৃষ্টিতে ছাত্র সংসদের নিয়মিত নির্বাচন না হওয়ায় ছাত্রদের দাবি-দাওয়া নিয়ে নামে-বেনামে সংগঠনের জন্ম, আন্দোলন সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় যেমন ছন্দ-পতন ঘটছে আবার দায়-দায়িত্বের জায়গাতেও বিশ্বস্ততার সংকট সৃষ্টি হচ্ছে। সেই কারণেই ছাত্র আন্দোলন নিয়েও ভাববার সময় এসেছে।
ছাত্র সংগঠনগুলোর কাজ কি? গত ১৫ বছরে সরকারের আশপাশে থাকা নেতা-কর্মীদের সম্পদের আকাশচুম্বী অবস্থা দেশের বাইরে টাকা পাচার, ব্যাংকের টাকা লুটপাট এবং তাদের বিচার না হওয়া, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি সাধারণ মানুষকে বিক্ষুব্ধ করেছিল। তারই একটা বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে বলে অনেকেই মনে করছেন। স্বাধীনতার ৫৩ বছরেই শুধু নয় গত ১০০ বছরেও সাধারণ শিক্ষার্থীদের ব্যানারে একটি যৌক্তিক দাবি বাস্তবায়ন করতে যেয়ে এতো সংখ্যক মানুষ আর কখনো কোথাও হত্যার শিকার হয়নি।
সরকারের কাজে-কর্মে বিতশ্রদ্ধ ডানপন্থি, বামপন্থি এবং স্বাধীনতাবিরোধী সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দল সরকার পতনের আন্দোলন অনেক আগে থেকেই করছে, কিন্তু তারা তাদের সেই আন্দোলনে সফল হয়নি। মাঝখান থেকে কিছু জীবনহানী ও জাতীয় সম্পদের ক্ষতিসাধন হয়েছিল। সরকার বলেছিল বিরোধীরা কোটা সংস্কার আন্দোলনে ভর করেছে, তাদের রাজনৈতিক অবস্থান থেকে তারা করেছে এবং করবে এটাই স্বাভাবিক। সরকার মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সাথে আপস করে শুধুই ক্ষমতামুখী হলে বিপদের সময় তারা পিছুটান দেবেই।
সাম্প্রদায়িক শক্তি প্রগতিশীলদের কখনও বন্ধু হতে পারে না, তার উদাহরণ হেফাজতে ইসলাম। আগে-পিছের একাডেমিক ধারাবাহিকতা ছাড়াই ১২ বছরের দাওরা হাদিস শিক্ষাকে মাস্টার্স ডিগ্রির সমমর্যাদা দেয়ায় সরকার প্রধানকে কওমি জনীনীর খেতাব যারা দিয়েছিলেন তারাও সরকার পতনের জন্য সকল সদস্যকে ঢাকা আসার আহ্বান করেছিলেন। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতাবিরোধী, মানবতাবিরোধী কাজের জন্য সাংবিধানিকভাবেই সকল সাম্প্রদায়িক রাজনীতি নিষিদ্ধ হয়েছিল ১৯৭২ সালের সংবিধানের আলোকে।
১৯৮৮ সালের ৩০নং আইন বলে সংবিধানে রাষ্ট্রীয় মূলনীতি পরিবর্তন করায় এবং ৫ম সংশোধনীর ফলে মৌলবাদী এবং সাম্প্রদায়িক রাজনীতির যাত্রা শুরু হয়েছিল। ৫ম সংশোধনী ও অষ্টম সংশোধনী বাতিল হওয়ার সাথে সাথই ১৯৭২ সালের সংবিধান পুনরুজ্জীবিত হয়ে যায় ফলে সব রকমের সাম্প্রদায়িক রাজনীতি নিষিদ্ধ হয়ে যাওয়ার কথা কিন্তু আওয়ামী লীগ নতুন করে সংশোধনী এনে একইসাথে রাষ্ট্রীয় ধর্ম ইসলাম ও ১৯৭২ সালের সংবিধানের মূলনীতিও বহাল করায় সাম্প্রদায়িক রাজনীতি সাংবিধানিক অধিকার পায়।
ক্ষমতার প্রয়োজনে তারা যে একাজ করেছিল বলে অনেকেরই ধারণা। সাম্প্রদায়িক শক্তিকে ক্ষমতার ট্রামকার্ড হিসেবে ব্যবহার করতেই সরকারের এ রকম আয়োজন ছিল। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নামে একটি সরকার গঠিত হয়েছে। তাদের কাজের পরিধিও ঘোষণা এবং সে অনুযায়ী তারা কাজ করবেন, দেশের সকল ক্ষেত্রে বৈষম্যের সমাপ্তি ঘটবে, সাধারণ মানুষের নাগরিক অধিকার নিশ্চিত হবে এটাই জাতির প্রত্যাশা। বিগত আমলে শাসকদের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের যে চিত্র দৃশ্যমান হয়েছিল সেটা যেন আর ফিরে না আসে, জাতিকে যেন আর কোনো স্বৈরাচার এবং ফ্যাসিবাদের নির্যাতন ভোগ করতে না হয়।
লেখক: কলেজ অধ্যক্ষ ও কলামিস্ট
Comments