Image description

সাদা টাকা ও কালো টাকা কি? এই প্রশ্নটা অনেক দিনের। কারণ টাকার রং কখনো কালো হয় না। তাহলে টাকাকে কেন কালো বলা হয়। টাকা উপার্জনের পদ্ধতিগত দিক বিবেচনায় কি টাকার রং নির্ণয় করা হয়, এটা কিন্তু সঠিক না।

একটি সংজ্ঞায় বলা হচ্ছে, কালো টাকা হলো একটি অবৈধ লেনদেন থেকে প্রাপ্ত আয়। আবার এটাও বলা হচ্ছে যে, কালো টাকা হলো সেই উপার্জিত টাকা যার উপর আয়কর ও অন্যান্য কর পরিশোধ করা হয়নি। কালো টাকা আর অবৈধ উপার্জন এক না-ও হতে পারে।  তবে জাতীয়ভাবে যা বলা হচ্ছে তাতে সব অর্থ একত্র (অবৈধ ও বৈধ) করে ফেলা হচ্ছে। অদৃশ্য আয় বলতে বুঝানো হচ্ছে, যে আয়ের ট্যাক্স দেয়া হয় নাই। আর সব উপার্জন আবার সব সময় দৃশ্যমান নাও হতে পারে। যেমন বাংলাদেশের গ্রামগুলোতে লেদ মেশিন, ট্রাক্টর ব্যবসা (ভাড়া) এক্সকেভেটরের ব্যবসা এগুলো বৈধ ব্যবসা। এরকম অনেক ব্যবসা আছে যা থেকে ব্যবসায়ীরা যে আয় করেন তা আয়করের নির্ধারিত সীমানার অতিক্রম করে যায়। কিন্তু অতিরিক্ত টাকা অর্থাৎ যে টাকার উপর আয়কর প্রয়োজ্য, সেই আয়কর এই শ্রেণির মানুষেরা দেয় না। না দেয়ার বিষয়টি জ্ঞাতসারে বা অজানার কারণও হতে পারে। তাদের উপার্জিত টাকা জমে জমে এক সময় বড় অংকে পরিণত হয়। এই ক্ষেত্রে কি এদের উপার্জিত টাকা কি কালো টাকা হিসাবে পরিগণিত হবে? বাংলাদেশে অবৈধভাবে উপার্জনের নানা পথ রয়েছে।

চাঁদাবাজি করে কোটি কোটি টাকা আয় করছেন কেউ কেউ। এই উপার্জনের ক্ষেত্রটি আয়করের নির্দেশিকা মতে কোনো ফ্রেমে ফেলা যায় না। কোন কোন উপার্জনের উপর আয়কর দিতে হবে তা-ও নির্দিষ্ট করে বলা আছে, চাঁদাবাজি করে অর্থ উপার্জনের উপর কোনো আয়কর নির্ধারণ করার নিয়ম নেই। এই আয় থেকে অর্জিত টাকাটাও কালো। আজ থেকে এক বছর আগে বিভিন্ন সূত্র থেকে যে তথ্য পাওয়া গেছে, তাতে দেখা যায়, ময়মনসিংহ জেলার ভালুকা উপজেলার বিভিন্ন সড়কের পয়েন্টে, শুধুমাত্র পরিবহন সেক্টরের বিভিন্ন পরিবহন (বাস ট্রাক অটো রিকশাসহ সকল যানবাহন) থেকে যে চাঁদা আদায় করা হতো তার পরিমাণ ছিল প্রায় ১৫ লক্ষাধিক টাকা। এই চাঁদার টাকাটা ক্ষমতাসীনদের পকেটেই গেছে। এই টাকা আয় করত ক্ষমতায় থাকা রাজনৈতিক নেতা ও তার আত্মীয়-স্বজনরা। ভালুকা উপজেলার তৎকালীন ক্ষমতাসীনদের আয়ের পরিমাণটা কত? তা কি নির্ধারণ করতে পেরেছে আয়কর বিভাগ। এই চাঁদা আদায়টা আইনগতভাবে সিদ্ধ না, তাই এই ব্যক্তিদের আয়করটাও আয়কর বিভাগ নির্ধারণ করতে পারেনি। তাহলে এই কালো টাকা আর পরিশ্রম করে আয়করের সীমা অতিক্রম করা অর্জিত টাকাকে কি একসূত্রে নেয়াটা ঠিক হবে? যেমন দেশের সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ঘুষ নেয়ার বিষয়টি ওপেন সিক্রেট। আবার কোন কোন অফিসে তা ওপেন, যেমন দেশের প্রকৌশল দপ্তরগুলোতে বিল নিতে গেলে বা কাজ পেয়ে ওয়ার্ক অর্ডার নিলে দরপত্রে বর্ণিত টাকার উপর পারসেন্টেজ দিতে হয়। এই টাকাটা প্রকৌশলীদের ব্যক্তিগত আয়। এর ফলে প্রকৌশলীরা নির্ধারিত আয় থেকে বেশি টাকা উপার্জন করেন। পারসেন্টেজ থেকে প্রাপ্ত টাকাটাও কালো। এই কালো টাকাটা কখনো দৃশ্যমান হয় না। বা এই কালো টাকা সাদা করার কোনো পদক্ষেপও প্রকৌশলীরা নেন না। উপরন্তু যারা ভালো কাজ করেন (ঠিকাদাররা) তাদের উপর প্রকৌশলীরা বেশি ক্ষিপ্ত হন। কারণ পারসেন্টেজের বাইরে তারা কাজ কমবেশি করিয়ে ঠিকাদারের কাছ থেকে টাকা নিয়ে থাকেন। এই আয়গুলোর বিষয়ে কি আয়কর বিভাগ জানেন? যদি জেনে থাকেন তাহলে এই আয়ের উপর কিভাবে আয়কর নির্ধারণ করা যায়, তার কি কোনো পদক্ষেপ নিয়েছেন কি তারা? প্রকৌশলীদের অর্জিত কালো টাকার কি কোন হদিস মেলে। প্রান্তিক পর্যায়ের ঠিকাদারা এই সব প্রকৌশলীদের হাতে নানাভাবে নিগৃহীত হয়। তাই দেখা যায় অনেকেই পেশা ছাড়তে বাধ্য হয়।

বড় মাপের ঠিকাদারা পুকুর চুরি করে প্রকৌশলীদের যোগসাজশে। বড় বড় ঠিকাদাররা ধরা পড়ে কিন্তু প্রকৌশলী ধরা পড়ে কম। ডাক্তারা চেম্বারে বসে রোগী দেখে মোটা অংকের টাকা আয় করে। ডাক্তার ভেদে ভিজিটের হার ৫০০ থেকে ১৫০০ টাকা। একজন ডাক্তার গড়ে প্রতিদিন কমপক্ষে ২০-২৫টি রোগী দেখে থাকেন। হিসাব করে কি কখনো দেখা হয়েছে এদের  মাসিক আয় কত? বেতন ও রোগীর ভিজিট হিসাব করে কি একজন ডাক্তার সরকারকে আয় কর দিয়ে থাকেন? প্রকৌশলী বা চিকিৎসকদের উপার্জিত টাকা সাদা না কালো? এর উত্তরটা কে দিবে। কারণ একজন প্রকৌশলীর বা ডাকাত্তারা শুধুমাত্র বেতনের হিসাবে আয় কর দিয়ে থাকেন। তাই কালো টাকার উৎস মুখ সন্ধান করাটা বেশি কষ্টসাধ্য বিষয় না। সরকারের রাজস্ব গোয়েন্দা বিভাগ চেষ্টা করলেই বের করতে পারবেন। ভূমি রেজিস্ট্রেশন বিভাগে অলিখিতভাবে ওপেন ঘুষ প্রথা চালু আছে। দেশের প্রতিটি সাবরেস্ট্রি অফিসে, প্রত্যেকটি দলিলেই সরকার নির্ধারিত ফির বাইরে টাকা দিতে হয়। যাকে সেরেস্তার খরচ হিসাবে দলিল লেখকরা নিয়ে থাকেন। প্রত্যেক দলিল লেখক হিসাব করে প্রাপ্ত অর্থ অফিসে জমা দেন (এটা দলিল লেখকের পারিশ্রমিকের বাইরে)। একজন সাব-রেজিস্ট্রারের আয় কত। একজন সাব-রেজিস্ট্রারের তার আয়কর দেন শুধুমাত্র বেতনের টাকার উপর। একজন সাব- রেজিস্ট্রারও কালো টাকার মালিক। পুলিশ, কাস্টমসসহ সরকারের সকল বিভাগে এ রকম ঘুষ প্রথা রয়েছে। এই ঘুষ প্রথায় প্রচলিত অফিসগুলোতে যারা চাকরিরত তাদের কালো টাকার পরিমাণ নির্ধারণ করা দরকার। সরকার ৩০ শতাংশ কর দেয়া সাপেক্ষে কালো টাকাকে সাদা করার পদক্ষেপ নিয়েছেন আগামী বাজেটে। তাই এই ঘুষ গ্রহণকারী সরকারি কর্মীদেরকে বলা হোক, তাদের প্রকৃত গ্রহণ করা ঘুষের হিসাব দিয়ে (মাসিক ভিত্তিতে) আয়কর প্রদান করা। এই কথাটা বাজেটে আসা দরকার ছিল। তাহলে কালো টাকা সাদা করার মাধ্যমে সরকারের আর বেশি রাজস্ব আদায় হতো। রাজস্ব বোর্ডের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তার ছেলে খাসি কেনার পড়ে যে তথ্য বেড়িয়ে এলো তাতে বুঝা যায়, দেশের যে পরিমাণে রাজস্ব আদায় হওয়ার কথা তা হচ্ছে না। এই দপ্তরের কর্মকর্তাদের দুর্নীতি ও ঘুষ প্রথম সারিতে রয়েছে। এদেরকে ঘুষ দিয়ে অনেকেই সরকারের কোষাগারে তার কর্তৃক নির্ধারিত আয়কর না দিয়ে পার পেয়ে যাচ্ছেন। অথচ সরকার কিছু নিরীহ মানুষের উপর থেকে জোর করে ট্যাক্স আদায় করছেন, যেমন এমপিওভুক্ত কলেজসমূহের শিক্ষক, প্রান্তিক ব্যবসায়ী, সাধারণ মোবাইল ফোন ব্যবহারকারী। চোরাচালানকারী, মাদক ব্যবসায়ী, চাঁদাবাজ, চোর, ডাকাত, নারীর দালাল, জমির দালাল, ছিনতাইকারীসহ অন্যান্য অপকর্মকারীরা কালো টাকা উপার্জন করে। এরা উপার্জন করতে পারে সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে সহযোগিতা পেয়ে। বর্তমান বাজেটে তাদেরকেও সুযোগ দেয়া হয়েছে ৩০ শতাংশ হারে কর প্রদান করে কালো টাকাকে সাদা করার। এদের আয় করার কৌশলটা দৃশ্যমান না। এরা অদৃশ্যভাবে পুলিশ, প্রশাসন, কাস্টমসসহ সকল বিভাগকে ম্যানেজ করে উপার্জন করে। এদের উপার্জনের সাথে সরকারের প্রশাসনসহ সকল দপ্তর জড়িত। পেশকৃত বাজেটে কালো টাকার নির্দিষ্টভাবে কোনো সংজ্ঞা প্রদান করা হয় নাই। কালো টাকার ধরন হিসাবে এর শ্রেণি বিন্যাস করা উচিত। অনেকেই বলে থাকেন জিডিপির প্রায় ৩৫ শতাংশ কালো টাকা। এই বিষয়টিও সুনির্দিষ্ট করা প্রয়োজন। সরকারের উচিত দপ্তরভিত্তিক কর্মীদের উপর আয়কর নির্ধারণ করা। সরকারের উচ্চ মহল ভালো করে জানেন কোনো দপ্তরে কর্মরত কর্মীরা বছরে কি পরিমাণে আয় (বেতন + ঘুষ) করেন। সেই দপ্তরের উপর এই হিসাবের হারে করারোপ করা উচিত। তাহলে বাজেটে যে পরিমাণ রাজস্ব আদায়ের কথা বলা হয়েছে তার দ্বিগুণ রাজস্ব আদায় হয়ে যাবে।

যেমন স্বাস্থ্য প্রকৌশল দপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী ছিলেন হান্নান সাহেব। তিনি পদোন্নতি পেয়ে তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী হয়েছেন। তিনি নিজ মুখে এটা স্বীকার করেছিলেন যে তার অধীন বছরে প্রায় ১০০ কোটি টাকার উন্নয়নমূলক কাজ হবে। এই কাজ থেকে তিনি এক শতাংশ করে পারসেন্টেজ পাবেন। সেই হিসাবে হান্নান সাহেবের বার্ষিক আয় বেতন বহির্ভূতভাবে দাঁড়ায় ১ কোটি টাকা। এ রকম অসংখ্য হান্না বাংলাদেশে রয়েছে। এই হান্নান গংদের অর্জিত আয়ের হিসাব করা দরকার। আর এদের আয়ের উপর আয়কর ধার্য করে আদায় করতে পারলে, সরকারকে বাজেটের অর্থ সংগ্রহ করার জন্য ব্যাংক থেকে বা বিদেশ থেকে অর্থ সাহায্য নিতে হবে না। সরকারের রাজস্ব বিভাগের উচিত সরকারি কর্মীদের প্রকৃত আয় কত (বেতন ভাতা + ঘুষ) তা নির্ধারণ করা। এর ভিত্তিতে আয় কর আদায় করা। সাদা বা কালো টাকা হিসাবের বিষয়টি তা হলো ক্লিয়ার হয়ে যাবে।

লেখক: সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও কলামিস্ট

মানবকণ্ঠ/এসআরএস