দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর বিশ্বশান্তি ও নিরাপত্তার লক্ষ্যে গঠিত জাতিসংঘের প্রধান ছয়টি অঙ্গ সংস্থার মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে নিরাপত্তা পরিষদ। বলা যায়, এটিই জাতিসংঘ পরিচালনার মূল কেন্দ্রবিন্দু। বর্তমান বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ ও এর ভেটো পদ্ধতির মারপ্যাঁচ আবারো আলোচনায় উঠে এসেছে।
সম্প্রতি ফিলিস্তিনের জাতিসংঘের সদস্যপদ প্রাপ্তির বিষয়ে নিরাপত্তা পরিষদে ১৫টির মধ্যে ১২টি ভোট ফিলিস্তিনের পক্ষে আসলেও যুক্তরাষ্ট্রের ভেটোর কারণে ফিলিস্তিনের সদস্যপদের বিষয়টি অধরাই থেকে গেলো। এমনকি গাজায় চলমান নৃশংসতা, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের দামামা নিরাপত্তা পরিষদের ব্যর্থতাকেই প্রতিধ্বনিত করে। যা জাতিসংঘের নিরপেক্ষতা ও সার্বজনীন অবস্থানকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসযজ্ঞের পর বিশ্ব শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য গঠিত হয়েছিল লিগ অব নেশনস (জাতিপুঞ্জ)। জাতিপুঞ্জের ব্যর্থতা, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু ও ব্যাপক ধ্বংসলীলা বিশ্ব সম্প্রদায়ের মনে আন্তর্জাতিক সংগঠন প্রতিষ্ঠা প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। এরই ধারবাহিকতায় বিশ্বশান্তি, স্থিতিশীলতা ও পারস্পরিক সম্পর্ক গঠনের লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত হয় জাতিসংঘ। এর রয়েছে প্রধান ছয়টি অঙ্গ সংস্থা- সাধারণ পরিষদ, নিরাপত্তা পরিষদ, অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদ, সচিবালয়, অছি পরিষদ ও আন্তর্জাতিক আদালত। তন্মধ্যে সাধারণ পরিষদ জাতিসংঘের সকল সদস্য নিয়ে গঠিত এবং কোনো বিল পাস করতে হলে প্রথমে তা সাধারণ পরিষদ কর্তৃক গৃহীত হতে হয়।
বৈশ্বিক শান্তি ও নিরাপত্তার প্রশ্নে অভূত শক্তির অধিকারী হলো নিরাপত্তা পরিষদ। জাতিসংঘ সনদের ২৩ থেকে ৩২নং অনুচ্ছেদে নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যপদ, কর্তৃত্ব, পরিচালনা পদ্ধতি বর্ণিত আছে। নিরাপত্তা পরিষদ পাঁচটি স্থায়ী সদস্য ও দশটি অস্থায়ী সদস্য নিয়ে গঠিত। তন্মধ্যে দশটি অস্থায়ী রাষ্ট্র দুই বছরের জন্য ভিন্ন ভিন্ন অঞ্চলের ভিত্তিতে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের মাধ্যমে নির্বাচিত হয়। পাঁচটি স্থায়ী সদস্য রাষ্ট্র হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, রাশিয়া ও চীন। যাদের রয়েছে ‘ভেটো’ নামক এক অলৌকিক ক্ষমতা। যার মাধ্যমে নিরাপত্তা পরিষদে উত্থাপিত যেকোনো বিল আটকে দিতে পারে। লাতিন শব্দ থেকে উদ্ভূত ‘ভেটো’ শব্দের অর্থ আমি মানি না।
নিরাপত্তা পরিষদে প্রস্তাব পাসের জন্য ন্যূনতম ৯টি রাষ্ট্রের সমর্থনের শর্ত পূরণ করার পরেও ভেটো ক্ষমতাসম্পন্ন কোনো রাষ্ট্র যদি ভেটো প্রদান করে তবে উক্ত প্রস্তাব বাতিল বলে গণ্য হয়। ভেটো পদ্ধতি নিরাপত্তা পরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সমর্থনকেই শুধু তোয়াক্কা করে না, বরং এটি সাধারণ পরিষদে সর্বোচ্চ দেশের সমর্থনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখায়। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, বর্তমান সময়ের প্রেক্ষিতে ভেটো পদ্ধতির গ্রহণযোগ্যতা ও যৌক্তিকতা কতটুকু? সত্যি বলতে বিশ্বের বেশিরভাগ রাষ্ট্র, শান্তিকামী মানুষেরা নিরাপত্তা পরিষদ ও ভেটো পদ্ধতির সংস্কার চায়। খোদ ভেটো ক্ষমতাসম্পন্ন দেশের উল্লেখযোগ্য অংশ এ পদ্ধতির সংস্কারের পক্ষে।
প্রতিষ্ঠার পর থেকে জাতিসংঘ শান্তি, স্থিতিশীলতা, বাণিজ্য, সংস্কৃতি, শিক্ষা-স্বাস্থ্যসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব সাফল্যজনক অবদান রাখছে। কিন্তু বর্তমান বৈশ্বিক যুদ্ধ-সংঘাতের দিকে দৃষ্টি নিবন্ধ করলে জাতিসংঘের ব্যর্থতার চিত্র প্রদর্শিত হয়। এসব সংঘাত নিরসনে জাতিসংঘ ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। জাতিসংঘের ব্যর্থতার নেপথ্যে আছে নিরাপত্তা পরিষদ ও ভেটো ক্ষমতার দুষ্টুচক্র। সত্যি বলতে, স্থায়ী রাষ্ট্রসমূহ ভেটো ক্ষমতা প্রয়োগ করে ব্যক্তিগত লাভ, জাতীয় স্বার্থে অথবা আদর্শিক স্বার্থে। এর জ্বলন্ত উদাহরণ হচ্ছে ইসরাইল ইস্যুতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান। এখন পর্যন্ত জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের ইসরাইল বিরোধী ৩৮টি প্রস্তাব উত্থাপিত হয়ছে তন্মধ্যে ৩৬টিতে ভেটো দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। ফলশ্রুতিতে ইসরাইল-ফিলিস্তিন সমস্যার সমাধান অধরাই থেকে যাচ্ছে।
তেমনি চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ইতিবাচক সমাধানে জাতিসংঘের ব্যর্থতার মূল কারণ নিরাপত্তা পরিষদ তথা ভেটো পদ্ধতি। উল্লেখ্য, বর্তমান বিশ্বকে কৌশলগত স্বার্থের ভিত্তিতে কয়েকভাগে বিভক্ত মনে হলেও মোটাদাগে পৃথিবী এখন দুভাগে বিভক্ত। এক যুক্তরাষ্ট্র-ইউরোপ সমর্থিত পক্ষ, অপরটি রাশিয়া-চীন সমর্থিত। যখনই স্থায়ী সদস্যদেশসমূহ দেখবে নিরাপত্তা পরিষদের কোনো প্রস্তাব তার বা মিত্রদেশের স্বার্থের বিপক্ষে যাচ্ছে তখন সে ভেটো দিবে- এটাই স্বাভাবিক। এমনটাই ঘটে চলেছে। যেমন ইসরাইল ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের ভেটো, ইউক্রেন ইস্যুতে রাশিয়ার ভেটো। ফলশ্রুতিতে নিরাপত্তা পরিষদ সংঘাত বন্ধে বারংবার ব্যর্থ হচ্ছে, ভবিষ্যতেও হবে।
লেখক: শিক্ষার্থী, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
মানবকণ্ঠ/এফআই
Comments