Image description

পৃথিবীজুড়ে শুরু হয়েছে আবহাওয়া এবং পরিবেশগত ব্যাপক পরিবর্তন। বলাই বাহুল্য, এসব পরিবর্তন আমাদের জন্য কোনো শুভ বার্তা বয়ে আনছে না। অর্থাৎ এসব হচ্ছে নেগেটিভ বা নেতিবাচক পরিবর্তন। বিশ্ব আবহাওয়ার ব্যাপক পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ৮টি দেশের উপকূলীয় এলাকায় বিরূপ পরিবেশগত প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হবে বলে ভবিষ্যদ্বাণী ইতোমধ্যেই করা হয়েছে।

ওয়াশিংটনের আবহাওয়া ইনস্টিটিউটের বিশেষজ্ঞরা সম্প্রতি এক গবেষণার পর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন যে, বিশ্বব্যাপী বায়ুমণ্ডলে উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাবে। এতে উষ্ণতা বৃদ্ধি প্রাপ্ত এসব অঞ্চলে প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখা দিবে। দক্ষিণ ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার লাখ লাখ লোক ‘পরিবেশগত উদ্বাস্তুতে’ পরিণত হবে। তারা অবশ্য এ কথাও বলে আশ্বস্ত করেছেন উন্নত পরিবেশ, দূষণরোধ প্রযুক্তির দ্রুত ব্যবহারের মাধ্যমে সম্ভাব্য দুর্যোগের ক্ষয়ক্ষতি লাঘব হতে পারে। ওয়াশিংটনস্থ আবহাওয়া ইনস্টিটিউটের সহযোগিতায় ২৭ মাসব্যাপী ৬০ জন আবহাওয়া বিশেষজ্ঞ এবং ৮টি এশীয় দেশের সরকার এ জরিপ কাজে অংশগ্রহণ করেন। 

ওয়াশিংটন আবহাওয়া ইনস্টিটিউটের জরিপে বলা হয়েছে, উপকূলের ব্যাপক এলাকা সাগরের স্ফীত পানিতে নিমজ্জিত হবে এবং ভূমিধসের সৃষ্টি হবে। মিষ্টি পানির প্রবাহে লবণাক্ত পানি প্রবেশ করবে। উপকূলীয় ব্যাপক এলাকায় মৎস্য উৎপাদন হ্রাস পাবে এবং ঝড়ে ক্ষয়ক্ষতির প্রকোপও বৃদ্ধি পাবে। দক্ষিণাঞ্চলীয় ৮টি দেশ বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ভিয়েতনাম এবং ফিলিপাইনে বিশ্বের মোট জনসংখ্যার এক-চতুর্থাংশ বসবাস করে। বিশ্বব্যাপী বায়ুমণ্ডলের উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে সৃষ্ট গ্রীনহাউস প্রতিক্রিয়ায় মারাত্মক ক্ষতির শিকার হবে- পূর্ব এশিয়ার এই দেশগুলো। ‘গ্রীনহাউস এফেক্ট’ এর জন্য বন উজাড়কেই প্রধান কারণ বলে গণ্য করা হয়। একটি দেশের প্রাকৃতিক ভারসাম্য ও পরিবেশকে সুন্দর-সামঞ্জস্যপূর্ণ রাখতে দেশের মোট আয়তনের শতকরা ২৫/৩০ ভাগ বনভূমি থাকা অত্যাবশ্যক সেখানে আমাদের দেশে বনভূমির পরিমাণ সরকারি হিসাব মতে শতকরা ১৬ ভাগ।

প্রকৃতপক্ষে বনভূমির পরিমাণ আরও অনেক কম বলে পর্যবেক্ষকদের ধারণা। দেশে বনভূমির এই অস্বাভাবিক হ্রাসের কারণে বাংলাদেশের জলবায়ু ক্রমশ উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে। বাংলাদেশ উন্নয়ন পরিষদ কর্তৃক পরিচালিত ‘বাংলাদেশে গ্রীনহাউসের প্রভাব এবং আবহাওয়ার পরিবর্তন শীর্ষক গবেষণা গ্রন্থেও বলা হয়েছে, বাংলাদেশের জলবায়ু ক্রমশ উত্তপ্ত হচ্ছে। গত শতাব্দীর শেষ দিকের তুলনায় গড় তাপমাত্রা বর্তমানে ০.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়েছে। এখন জলবায়ু ঠাণ্ডা হবার কোনো প্রবণতা নেই বলে গবেষণা গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে। 

এভাবে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেতে থাকলে ২০৩১ সাল নাগাদ দেশে বর্তমানের তুলনায় তাপমাত্রা ১ থেকে ১.৫ জিগ্রি সেলসিয়াস এবং ২০৫০ সাল নাগাদ ১.৫ থেকে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত বৃদ্ধি পেতে পারে বলে ধারণা কর হচ্ছে। উচ্চ তাপমাত্রা বৃদ্ধির প্রবণতার সঙ্গে সঙ্গে বর্ষা ঋতুও দীর্ঘায়িত হতে পারে। বাংলাদেশ উন্নয়ন পরিষদ, নিউজিল্যান্ডস্থ ওয়াইক্যাট বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল এন্ড রিসার্চ স্টাডিজ এবং গ্রেটব্রিটেনস্থ ইস্ট এ্যাংলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাইমেটিভ রিসার্চ ইউনিট কর্তৃক প্রণীত এবং বাংলাদেশ উন্নয়ন পরিষদ কর্তৃক প্রকাশিত ৭ খণ্ডের গবেষণা গ্রন্থ থেকে এসব তথ্য জানা গেছে। 

এই গবেষণায় আরও জানা যায়, গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা পানি বিভাজন এলাকাতে ভবিষ্যতে বৃষ্টিপাতের বৃদ্ধিতে সেদেশে বন্যার ভয়াবহতা বাড়বে। অন্যদিকে, বর্ধিত বৃষ্টিপাত নদীর প্রবাহ বাড়িয়ে সমুদ্রপৃষ্ঠ বৃদ্ধির জন্যে উপকূলীয় অঞ্চলে লবণাক্ততার অনুপ্রবেশকে প্রশমিত করতে সাহায্য করতে পারে বলে এই গ্রন্থে বলা হয়েছে। তবে এই গ্রন্থে যে তথ্যটি সবচেয়ে আশঙ্কাজনক তা হলো, তাপমাত্রা বৃদ্ধিজনিত কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠ বৃদ্ধির ফলে বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বা গরান কাঠের বনভূমি সুন্দরবন ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

আমাদের দেশে সুন্দরবন যেন মরুভূমির মধ্যে শ্যামল মরুদ্যান। দেশের অন্যতম প্রধান এই বনভূমি এখন ধ্বংস এবং বিপর্যয়ের মুখে। সুন্দরবন বাংলাদেশের সমগ্র বনভূমির প্রায় ১৭.৭৩ শতাংশ। মানুষের লোভ আর হস্তক্ষেপের ফলে সুন্দরবন তার সৌন্দর্য হারাচ্ছে। দেশ হারাচ্ছে প্রাকৃতিক ভারসাম্য। ফারাক্কা বাঁধের মরণ ছোবল আমাদের দেশকে শুধু পানি শূন্যই বা দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলকে প্রায় মরুভূমিতে পরিণতই করেনি, আমাদের দেশের সামগ্রিক প্রাকৃতিক পরিবেশকে বিনষ্ট করছে। ফারাক্কার নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বনভূমি সুন্দরবন অঞ্চলেও, যেমন ফারক্কা বাঁধের প্রতিক্রিয়ার ফলে পদ্মা নদীর পানির সরবরাহ ও নাব্যতা কমে যায়। ফলে সুন্দরবনে প্রবাহিত শাখা নদীগুলোর মধ্য দিয়ে সমুদ্রের লবণাক্ত পানি অভ্যন্তরভাগে অধিক দূর পর্যন্ত প্রবেশ করে। এর ফলে সুন্দরবনের অন্যতম প্রধান বৃক্ষ কম লবণাক্ততায় টিকে থাকার উপযোগী উদ্ভিদ সুন্দরী গাছ মরে যাচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে সুন্দরী বৃক্ষের অস্তিত্ব বিলুপ্ত হয়ে যাবে। গাছপালা, পশু-পাখি, জীবজন্তু ও মাছের মারাত্মক ক্ষতির আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

এছাড়া মানুষের সচেতনতার অভাবে আজ সুন্দরবনসহ দেশের অন্যান্য অঞ্চলের বনভূমি মারাত্মক হুমকির সম্মুখীন হয়েছে। আমরাও দিন দিন গ্রীনহাউস এফেক্টের নির্মম শিকারে পরিণত হতে চলেছি। দেশের বনাঞ্চলগুলোর সম্পদের অধিক ও অনিয়ন্ত্রিত আহরণ আজ আমাদের পরিবেশ ও প্রতিরোধের জন্য মারাত্মক হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। মানুষই পরিবেশ দূষণের অন্যতম কারণ। যেখানে মানুষের উচিত নিজেদের কলুষমুক্ত পরিচ্ছন্ন পবিত্র রাখার জন্য যথাসম্ভব পরিবেশকে রক্ষা করা, তখন এই মানুষের কারসাজিতেই বনভূমি উজাড় হচ্ছে, যেখানে সেখানে ইটের ভাঁটি গড়ে উঠছে, বর্জ্য ফেলা হচ্ছে, পশু-পাখি নির্বিচারে হত্যা করা হচ্ছে, অপরিকল্পিত শহর গড়ার কারণে প্রকৃতির সবুজ শ্যামলিমাকে বিপন্ন করা হচ্ছে। খাল-বিল, নদী-নালা, জলাশয় ভরাট করা হচ্ছে।

জনসংখ্যা ও সম্পদের বিপুল ফারাক্কা এবং তিস্তাসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ নদীর কারণে আমাদের দারিদ্র্য যেমন দূরীভূত হচ্ছে না, তেমনি আমাদের পরিবেশও নানা ধরনের ভারসাম্যহীনতার শিকার হচ্ছে। সুষম এবং পরিমিত জনসংখ্যার গুরত্ব দেশবাসীকে বোঝাবার দায়িত্ব দেশের শিক্ষিত এবং সচেতন নাগরিকের ওপরই বর্তায়। এ ক্ষেত্রে সচেতন মানুষরা যদি নিজেদের দায়িত্ব এড়িয়ে যান তাহলে পরিবেশের ভারসাম্যহীনতার কারণে যে ব্যাপক ধ্বংস নেমে আসবে সে ক্ষতির ভার সবাইকে বইতে হবেÑ যা সত্যি কষ্টসাধ্য ব্যাপার। 

প্রকৃতপক্ষে নির্বিচারে গাছ কাটা ও পশু-পাখি শিকারের কারণেই সুন্দরবনসহ দেশের অন্যান্য বনাঞ্চল আজ হুমকির সম্মুখীন। শুধু পরিবেশ নয় অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও বনভূমির অপরিসীম গুরুত্ব রয়েছে। দিনে দিনে যে পরিমাণ গাছ কাটা হচ্ছে তার এক-চতুর্থাংশও লাগানো হচ্ছে না। গাছ লাগানো হলেও প্রাথমিক পরিচর্যা ও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে অসংখ্য চারাগাছ মারা যাচ্ছে। বিশ্ব পরিবেশ বিজ্ঞানীদের অভিমত অনুযায়ী দু’হাজার পঞ্চাশ সালের মধ্যে বাংলাদেশের অধিকাংশ এলাকা সমুদ্র গর্ভে তলিয়ে যেতে পারে। 

বন্দরনগরী চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, কুমিল্লা, সিলেটসহ দেশের অন্যান্য শহরও অব্যাহত পাহাড় কাটার কারণে বৃষ্টির সঙ্গে বালি পড়ছে আবাদযোগ্য জমিতে। পানি নিষ্কাশনের খালগুলো ভরাট হয়ে যাচ্ছে। এতে বন্যা সর্বগ্রাসী রূপ ধারণ করছে। লাখ লাখ মানুষ জলাবদ্ধতার শিকার হচ্ছে। এছাড়াও পাহাড় কাটার পরিণামে ভূমিধসে প্রাণ হারাচ্ছে অনেক ছিন্নমূল মানুষ। নিজেদের প্রয়োজনেই এখন পাহাড় অক্ষত রাখা প্রয়োজন হয়ে পড়েছে।

পরিবেশ বিজ্ঞানীদের মতে, দেশের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য এই মুহূর্তে জরুরি ভিত্তিতে সব রকমের পদক্ষেপ নিতে হবে। ব্যাপক প্রচার-প্রচারণার মধ্য দিয়ে জনসচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। প্রচলিত আইনের যথাযথ প্রয়োগ এবং প্রয়োজনে কঠোর আইন প্রণয়ন করে তা প্রয়োগ করতে হবে। অতিসত্বর বন নিধনরোধে অবৈধ করাতকল উচ্ছেদ ও বৈধ করাতকলের সংখ্যা হ্রাসের ব্যবস্থা  করতে হবে। ইট তৈরির জন্য কাঠের ব্যবহার রোধ করতে হবে। এসব করা না হলে যেকোনো ভয়াবহ দুর্যোগের জন্য জাতিকে মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকতে হবে। পরিবেশ ও প্রতিবেশ সমস্যা যেহেতু বর্তমান বিশ্ব প্রেক্ষপটে একটি অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত বিষয়, তাই আমাদের পরিবেশ ভারসাম্যহীনতা এবং বনভূমি উজাড়ের অন্যতম প্রধান সমস্যা হিসাবে ফারাক্কাসহ বিভিন্ন নদীর পানির হিস্যা আদায়ে তৎপর হতে হবে। প্রয়োজনে সমস্যা সমাধানে আন্তর্জাতিক উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। 

এ ছাড়াও দেশি-বিদেশি গবেষক দ্বারা পরিচালিত নিরবচ্ছিন্ন ও গঠনমূলক গবেষণা সেল থাকা জরুরি হয়ে পড়ছে। দেশে পাহাড় ও বনসম্পদ আহরণের ক্ষেত্রে আরও নিয়ন্ত্রিত ও পরিকল্পিত ব্যবস্থা প্রণয়ন করতে হবে। পরিবেশকে রক্ষা করার কাজে সফলতা অর্জন করতে হলে সময় থাকতে সতর্ক হওয়াই সবচেয়ে জরুরি। শুধু সেমিনার বা সমাবেশই যথেষ্ট নয় দেশের জনগণকে পরিবেশ সম্বন্ধে যথেষ্ট শিক্ষিত সচেতন করে তোলার পাশাপাশি যুগোপযোগী কঠোর আইন প্রণয়ন করতে হবে। 

কারণ, ওয়াশিংটনের আবহাওয়া ইনস্টিটিউশনের বিশেষজ্ঞরা এশিয়ার দক্ষিলাঞ্চলীয় ৮টি দেশের প্রতি সতর্কবাণী উচ্চারণ করার পাশাপাশি এও বলেছেন, উন্নত পরিবেশ দূষণ প্রতিরোধ প্রযুক্তির দ্রুত ব্যবহারের মাধ্যমে সম্ভাব্য দুর্যোগের ক্ষয়ক্ষতি হ্রাস করা সম্ভব। আমাদের অবশ্যই এ কথা মাথায় রেখে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে, তা করা না হলে আমাদের রেহাই নেই তা নিশ্চিত করেই বলা যায় প্রায়।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট

মানবকণ্ঠ/আরএইচটি