ঢাকা শহরে গাছপালা খুবই কম তার চেয়ে কম জলাভূমি। খোলা জায়গা বা সড়কও অনেক কম। ঢাকায় এখন ফাঁকা এলাকা ৩০ বর্গ কিলোমিটারের কম অথচ ১৯৯৫ সালেও ছিল ৫২ কিলোমিটারের বেশি। একদিকে তাপমাত্রা শোষণ করে পরিবেশকে ঠাণ্ডা রাখার উপাদান কমে গেছে অন্যদিকে গরম বাতাস সরে যাওয়ার মতো খোলা জায়গা বা সড়কও কম।
ফলে ঢাকার তাপমাত্রা স্বাভাবিকভাবেই অপেক্ষাকৃত বেশি থাকে এবং তা আরো বেশি অনুভূত হয়। ঢাকাকে বলা হয় কনক্রিটের জঞ্জালের শহর। সড়কের পাশ ধরে একটার পর একটা ভবন গা ঘেঁষাঘেষি করে তৈরি করা হয়। এই ভবনের সারি এই কনক্রিটের জঞ্জাল শহরটিকে আরো গরম করে রাখে। মুন্সীগঞ্জ ও ঢাকা পাশাপাশি এলাকা এবং একই রকম ভূ-প্রকৃতি থাকায় তাপমাত্রা একইরকম থাকার কথা। অথচ মুন্সীগঞ্জের তুলনায় ঢাকার তাপমাত্রা দুই ডিগ্রির মতো বেশি অনুভূত হয়। একটি বড় শহরের ২৫% সড়ক থাকার কথা সেখানে ঢাকায় রয়েছে মাত্র ৭ শতাংশ। ঢাকায় সবুজ এলাকা ১৯৯৬ সাল থেকে প্রতিনিয়ত কমতে কমতে এখন দাঁড়িয়েছে মাত্র ৭ শতাংশে অথচ থাকার কথা ১৫%।
জলাভূমি থাকার কথা ১২.৫০ শতাংশ আছে এখন ৩ শতাংশের কম। জলাভূমি ১৯৯৫ সালে ৩০.২৪ বর্গ কিলোমিটার আর এখন আছে ৪.২৮ বর্গকিলোমিটার। অর্থাৎ তিন দশকের কম সময়ে কমেছে ৮৬% জলাভূমি। এসব তথ্য জানা থাকলে ঢাকা শহর কেন অগ্নিকুণ্ডু হয়ে আছে তা বুঝতে অসুবিধা হবে না। এছাড়া ঢাকা শহরে এখন অতিরিক্ত এয়ারকন্ডিশনিং মেশিন ব্যবহƒত হচ্ছে বিপুল পরিমাণ। কোনো কোনো ভবনে মৌচাকের মতো এসি লাগানো রয়েছে। এসির অতিরিক্ত ব্যবহার শহরের তাপমাত্রা বাড়াতে ভূমিকা রাখে। এ সময়ে এসি কেনার বিজ্ঞাপন আমাদের সাথে প্রহসন করে।
ঢাকার পার্শ্ববর্তী এলাকা থেকে শহরের তাপমাত্রা অনেকটা বেশি থাকার আরেকটি কারণই এই এসি। এসি থেকে নির্গত গরম বাতাস শহরের তাপমাত্রা বাড়িয়ে দেয়। এই গরমে যাদের সম্পদ রয়েছে তারা এসির মধ্যে বেশিক্ষণ থেকে শহরের জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে উঠছেন। দেশে ২৫ ডিগ্রির চেয়ে কম তাপমাত্রায় এসি ব্যবহার নিষিদ্ধ করা দরকার। একটি শহরে কনক্রিটের স্তূপ থাকার কথা ৪০-৪৫% কিন্তু ঢাকায় আছে ৮০% এর বেশি। ফলে শহরটি দ্রুতই বাস অযোগ্য হয়ে পড়ছে। বাংলাদেশে জলবায়ুর পরিবর্তন স্পষ্ট হচ্ছে। সারা পৃথিবীরই তাপমাত্রা বাড়ছে।
২০২৩ সাল ছিল বিশ্বের সবচেয়ে উষ্ণতম বছর। এবারও সে রেকর্ড ভাঙার দিকেই পৃথিবী এগিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের আরেকটি আপদ হিসেবে এসেছে শীতকালের দৈর্ঘ্য কমে যাওয়া। গ্রীষ্মকালে তামপাত্রা অস্বাভাবিক মনে হলেও বাস্তবিক সব ঋতুতেই তাপমাত্রা বেড়েছে। গ্রীষ্মকালের ব্যাপ্তি বৃদ্ধি পাওয়ায় তার প্রভাব পড়ছে সর্বত্র। বাংলাদেশের আবহাওয়া অধিদপ্তরের গবেষকগণ বলছেন, ১৯৮০ সাল থেকে প্রতি বছরই প্রতি ঋতুতেই তাপমাত্রা আগের বছরের তুলনায় বেড়েছে। বিশেষ করে গত ১০ থেকে ১২ বছর ধরে তাপপ্রবাহের মাত্রা আরো বেড়েছে। তাপদাহের সংখ্যাও ব্যাপকহারে বেড়েছে।
আগামীতে তাপপ্রবাহ আসার সম্ভাবনা আরো বাড়বে। এ বছর দেশের বিভিন্ন স্থানে তাপমাত্রা ৪০ থেকে ৪৩ পর্যন্ত উঠে গিয়েছে। বাংলাদেশের জন্য আরেকটি ভয়ানক খবর হলো বর্ষা আসতে ২০০০ সালের পর থেকে জুন মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ লেগে যাচ্ছে। অর্থাৎ বর্ষাকালের কিছুটা খেয়ে নিচ্ছে গ্রীষ্মকাল আবার গ্রীষ্মকালও শুরু হচ্ছে মার্চের শুরু থেকেই। অর্থাৎ গ্রীষ্মকাল বসন্তকালেরও অনেকটা খেয়ে নিয়েছে। তাপদাহ চলে যাচ্ছে অক্টোবর পর্যন্ত। বাংলাদেশে এখন শীতের তীব্রতা কম হলেও অনেকের কাছে তা অপেক্ষাকৃত বেশি তীব্র বলে মনে হয়। এটা গ্রীষ্মকালের জন্যও প্রযোজ্য।
সংযুক্ত আরব আমিরাতে তাপমাত্রা ৪৫-৪৬ ডিগ্রি পর্যন্ত উঠে যায়। দিল্লীর তাপমাত্রাও ঢাকার চেয়ে বেশি। ঢাকায় অনুভূতিটা বেশি হয় আর্দ্রতার জন্য। বাতাসে আর্দ্রতা বেশি থাকলে অসহনীয় গরম অনুভূত হয়। ফলে তাপমাত্রা ৩৫ ডিগ্রি হলেও তা ৪০ ডিগ্রির মতো অনুভূত হতে পারে। এক্ষেত্রে গরম বাতাস প্রশান্তির বদলে অস্বস্তি তৈরি করে। আর্দ্রতার কারণে শরীর থেকে অতিরিক্ত তাপ ঘামের সাহায্যে বের হতে পারে না। আর্দ্রতা কম থাকলে ঘাম দ্রুতই বাতাসের সংস্পর্শে বাষ্পীভূত হয়ে যায়। আর্দ্রতা বেশি থাকলে বাতাসে জলীয় বাষ্প বেশি থাকে বলে অতিরিক্ত জলীয় বাষ্প গ্রহণ করতে পারে না। শরীরের ঘাম কম বাষ্পীভূত হওয়ার কারণে বেশি গরম অনুভূত হয়। এর থেকে বাঁচার জন্য প্রচুর পানি ও তরল খাবার খেতে হয়। এমন কিছু সচেতনতাও আমাদের সাহায্য করতে পারে।
এই তীব্র গরমে প্রতি বছরই বেশ কয়েকজন মানুষই মারা যায় হিটস্ট্রোকে। এবার একজন পুলিশ সদস্যও হিটস্ট্রোকে মারা গেলেন। নাগরিকদের পানি ও ছাতা নিয়ে বের হওয়ার পরামর্শ দিয়ে তাদের জীবনটা অন্তত রক্ষা করা যায়। মিডিয়াতে এ বিষয়ে বিজ্ঞাপন প্রচার করা জরুরি। সাধারণ নাগরিকগণও এসব বিজ্ঞাপন সামাজিক মিডিয়াতে শেয়ার করে মানুষের কল্যাণে ভূমিকা রাখতে পারে। পৃথিবীর তাপমাত্রা গত ৫৮ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ ছিল ২০২৩ সালে। বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির জন্য মূল দায়ী কার্বন নিঃসরণ।
মূলত চীন, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ভারত, রাশিয়া, জাপান, জার্মানির মতো দেশগুলো বছরে ৫০ হাজার মেগাটনের বেশি কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণ করে। এতে বাংলাদেশের হাত খুবই নগণ্য তবে বাংলাদেশকেই সবচেয়ে বেশি ভূগতে হচ্ছে। সারা পৃথিবীই তাপমাত্রা বৃদ্ধির শিকার হচ্ছে। এরমধ্যে বাংলাদেশের মতো দেশগুলো পড়বে মারাত্মক সংকটে। দেশের তাপমাত্রা বাড়ছে, শুষ্কতা বাড়ছে, দক্ষিণবঙ্গে লবণাক্তা বাড়ছে। লক্ষ লক্ষ মানুষ বাস্তুহারা হয়েছে এবং আগামী কয়েক বছরে কয়েক কোটি মানুষ বাস্তুহারা হতে পারেন। বাংলাদেশকে এ বিষয়ে অনেকটাই উদাসীন মনে হয়েছে। এই সংকট মোকাবিলায় বাংলাদেশের পদক্ষেপ দৃশ্যমান নয়।
ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন ঢাকার তাপমাত্রা কমাতে একজন হিট অফিসার নিয়োগ দিয়েছে। তার কর্মকাণ্ডও দৃশ্যমান নয়। তার কথা নিয়ে আমজনতা ট্রলে মেতে থাকে। ফলে তার কথা মানুষ গুরুত্ব দিয়ে শুনবে না। এখন বৃক্ষরোপণ ও জলাধার নির্মাণ ব্যাপক হারেই বাড়াতে হবে। প্রতিবছর ১০ কোটি গাছ লাগানোর উদ্যোগ নিতে হবে। আমরা দীর্ঘকাল ধরেই উপকূলীয় এলাকায় সবুজ বেষ্টনীর কথা শুনছি কিন্তু তার ব্যাপকতা দৃশ্যমান হচ্ছে না। সুন্দরবন ক্ষতিগ্রস্ত হয় এমন অনেক উদ্যোগও নেয়া হয়েছে রাষ্ট্রীয়ভাবে। অথচ এই বনটি আমাদের বহু বিপর্যয় থেকে রক্ষা করেছে। দেশে প্রতিবছর ৬/৭টি ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানছে বা কোনো না কোনো বড় বিপর্যয় নেমে আসছে। জাতিসংঘ বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে ধরে রাখতে চায়। তাপমাত্রা এরচেয়ে বেশি বাড়লে বিশ্বে মারাত্মক খাদ্য ঘাটতি দেখা দিবে। বৈশ্বিক ক্ষেত্রে আমাদের ভূমিকা রাখার সুযোগ কম এমন অজুহাতে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকলে বিপর্যয় বাড়তেই থাকবে। বিষয়টি নিয়ে বিশ্বব্যাপীই প্রচারণা চালাতে বাংলাদেশ ভূমিকা রাখতে পারে। বিভিন্ন ফোরামে বিষয়টি উত্থাপন করে এর কার্যক্রমকে বেগবান করতে পারে।
প্রধান কার্বন নিঃসরণকারী দেশগুলোকে চাপে রেখে কার্বন নিঃসরণ কমাতে উৎসাহিত করতে হবে। এর বাইরে আমাদের দেশেরও কিছু করণীয় রয়েছে। সরকার কিছু পদক্ষেপ নিলে শহরের তাপমাত্রা অন্তত ২ ডিগ্রি কমিয়ে দিতে পারে। শহরের ঘনবসতি কমিয়ে দিতে হবে। কেউ বাড়ি করতে হলে অন্তত ৫০% জায়গা ছাড়তে হবে। সরকারি জমিতে আবাসন বা অফিস নির্মাণ নিষিদ্ধ করতে হবে। সরকারি জমিগুলোতে বনায়ন ও জলাশয় নির্মাণ করতে হবে। বেদখল হওয়া সরকারি জমিগুলো দ্রুতই উদ্ধার করে সেখানেও বনায়ন ও জলাশয় নির্মাণ করতে হবে। ঢাকার খালগুলো উদ্ধার করা গেলেও জলাশয়ের সমস্যা কিছুটা দূর করা সম্ভব হতো। দেশে জলাশয় ভরাট আইন থাকলেও তার কার্যকারিতা নেই বললেই চলে। বালু দিয়ে পুকুর ও জলাশয় ভরাট করাতে সেখানে বৃক্ষরোপণও সম্ভব হচ্ছে না। বালু সহিষ্ণু বৃক্ষের আবাদ করা যেতে পারে। চরাঞ্চলেও বনায়ন করার উদ্যোগ নেয়া দরকার। গ্রামগঞ্জেও বহুতল ভবন নির্মাণে ঋণ দেয়ার সুযোগ তৈরি করতে হবে।
অসহনীয় তাপমাত্রা, ঘন ঘন বিদ্যুৎ বিভ্রাট আমাদের কর্মশক্তিও কমিয়ে দিবে। এই গরমে কৃষকদের পক্ষে শস্য ঘরে তোলা কঠিন হয়ে উঠছে। সারাদিনের তীব্র রোদ এবং শেষ বিকেলের হঠাৎ আসা কালবৈশাখীর ছোবলে এবং বজ্রপাত কৃষকদের পক্ষে মাঠে থাকা অসম্ভব করে দেয়। প্রতি বছরই বজ্রপাতে বহু কৃষক ও সাধারণ মানুষ মারা যায়। বজ্রপাত থেকে রক্ষা করার কোনো উদ্যোগই দীর্ঘকালে নেয়া হয়নি। এ মৃত্যুকে আমরা স্বাভাবিক ধরে নিয়েছি। সাধারণ মানুষও বজ্রপাতকে এখনো অভিশাপ হিসেবেই দেখছে। অথচ রাষ্ট্র চাইলে কৃষকদের রক্ষার জন্য আধুনিক উদ্যোগ নিতে পারে। আবার এমন গরমে সরকারকে কৃত্রিম বৃষ্টি নামানোর উচ্চাভিলাষী সিদ্ধান্তই নিতে হবে।
এখন মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে কৃত্রিমভাবে বৃষ্টি নামানো হচ্ছে। চাইলে বৃষ্টিকে নির্দিষ্ট স্থানেও নামানো যায় যেটা চীন অলিম্পিক গেমসে করে তাক লাগিয়ে দিয়েছিল। তবে দ্রুতই সারাদেশে ব্যাপকহারে বৃক্ষরোপণ ও জলাশয় তৈরি করার উদ্যোগ নিতে হবে। প্রাকৃতিক যেকোনো দুর্যোগ থেকেই বাঁচাতে বৃক্ষ ভালো ভূমিকা রাখে। জলাশয় শুধু গরম থেকেই নয়, আমাদের বন্যা থেকেও রক্ষা করতে ভূমিকা রাখবে।
লেখক: কবি, প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট
মানবকণ্ঠ/আরএইচটি
Comments