Image description

শেরে-ই-বাংলা আবুল কাশেম ফজলুল হক বাংলার অবিসংবাদিত এক নেতা। শেরে বাংলা বা শের-ই-বাংলা শব্দের অর্থ বাংলার বাঘ। তিনি জন্মগ্রহণ করেন ২৬ অক্টোবর, ১৮৭৩ সালে ঝালকাঠি জেলার সাটুরিয়া গ্রামে নানাবাড়িতে। তার পৈত্রিক ভিটা বরিশাল জেলার বানারীপাড়া উপজেলার অন্তর্গত চাখার গ্রামে। রাজনৈতিক মহল এবং সাধারণ মানুষের নিকট তিনি ‘শেরে বাংলা’ এবং ‘হক সাহেব’ নামেই বেশি পরিচিত ছিলেন। 

কৃষক-প্রজা আন্দোলন, বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব আইন, জমিদারি প্রথা বাতিল ও ঋণ সালিশি বোর্ড প্রবর্তনের জন্য তিনি বাংলার দারিদ্র্য-নিপীড়িত কৃষক সমাজের কাছে চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন। সফল কর্মজীবনে রাজনৈতিক অনেক পদে তিনি অধিষ্ঠিত ছিলেন, যাদের মধ্যে কলকাতা সিটি কর্পোরেশনের মেয়র, অবিভক্ত বাংলার শিক্ষামন্ত্রী ও পরে প্রধানমন্ত্রী, পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী, পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর অন্যতম। 

এই মহান নেতার কিছু মূল্যবান কথা চিরস্মরণীয় বাণী হয়ে আমাদেরকে যুগে যুগে অনুপ্রাণিত করবে। তার উল্লেখযোগ্য কিছু বিবৃতি এখানে তুলে ধরা হলো: (১) জাতির স্বার্থই হবে ব্যক্তির স্বার্থ। জাতির কল্যাণই হবে ব্যক্তির কল্যাণ। (২) যে জাতি তার বাচ্চাদের বিড়ালের ভয় দেখিয়ে ঘুম পাড়ায়, তারা সিংহের সাথে লড়াই করা কিভাবে শিখবে? (৩) আপনি যদি কোনো ভালো কাজ করেন তাহলে লোকে আপনার সমালোচনা করবে। আমগাছে আম ধরে বলেই লোকে ঢিল মারে, ফজলি আমগাছে আরও বেশি করে মারে, শেওড়া গাছে কেউ ঢিল মারে না। 

পাশাপাশি তার চরিত্র, প্রজ্ঞা, মেধা ও রাজনৈতিক গুণাবলি নিয়েও প্রচলিত আছে অনেক মনীষীর মূল্যবান মন্তব্য। তার মূল্যায়নে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় বলেন, ‘ফজলুল হক মাথার চুল থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত খাঁটি বাঙালি। সেই সঙ্গে ফজলুল হক মাথার চুল থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত খাঁটি মুসলমান। খাঁটি বাঙালি আর খাঁটি মুসলমানের এমন অপূর্ব সমন্বয় আমি আর দেখি নাই।’ 

তিনি ছিলেন একদিকে কুসুমের ন্যায় কোমল অন্যদিকে বজ্রের ন্যায় কঠোর। পরিস্থিতি বুঝে তিনি সিদ্ধান্ত নিতেন। একবার পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে অধিবেশন চলাকালে ঘটনাক্রমে তার বিরোধী এক নেতাকে পরোক্ষভাবে তিনি মাংকি বলে কটাক্ষ করায় ওই নেতা ক্রোধে অগ্নিশর্মা হয়ে ফলজুল হকের বক্তব্য প্রত্যাহারের দাবি জানান। তখন তিনি উত্তরে বলেছিলেন, যদি আসলেই ওই নেতা নিজেকে সত্যিকার অর্থে এই পদবির জন্য যোগ্য মনে করে থাকেন তবে তিনি তার বক্তব্য প্রত্যাহার করে নিলেন। 

১৯৫৪ সালে প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের পক্ষে প্রচারাভিযানে ফজলুল হক বরগুনাতে তার নির্বাচনী এলাকায় লঞ্চ নিয়ে গেলে বিরোধী লোকজন ঘাটে নৌযান ভিড়াতে বাধা দেয়। তখন তিনি তাদেরকে শান্ত হতে বললেন এই শর্তে যে, তিনি সেখানে ভোট চাইতে যাননি। গিয়েছিলেন তাদের সাথে একত্রে বসে এক বেলা ডাল-ভাত খাওয়ার উদ্দেশে। উপস্থিত জনতা রাজী হলে তিনি সেখানে খানা-পিনার আয়োজন করে নির্বাচনে তার প্রতিপক্ষ নেতাকে আমন্ত্রণ জানাতে অনুরোধ করলেন উপস্থিত জনতাকে। কিন্তু ওই নেতা জনগণের সাথে একত্রে মাটিতে বসে খেতে অস্বীকৃতি জানালে শেরে বাংলা বললেন তারা কেমন নেতার সমর্থনে তাকে ঘাটে লঞ্চ ভিড়াতে বাধা দিলেন যিনি তার দলীয় কর্মীদের সাথে এক জায়গায় বসে খেতে দ্বিধাবোধ করেন। তিনি কি করে সাধারণ জনগণের বন্ধু হবেন। অতঃপর তিনি তার মিশন শেষ করে চলে এলেন এবং ওই নির্বাচনে উক্ত কেন্দ্রে সর্বোচ্চ ভোট পেয়ে তার নির্বাচনী আসনে বিপুল ব্যবধানে জয়ী হলেন। এই ছিল তার প্রজ্ঞা ও উপিস্থিত বুদ্ধি। 

তিনি হঠাৎ করেই একদিনে শেরে বাংলা হয়ে উঠেননি। তিনি ছিলেন একজন সত্যিকারের দেশপ্রেমিক। তৎকালীন পূর্ববাংলার মুসলমানদের শিক্ষা বিস্তারের ক্ষেত্রে তার অবদান অপরিসীম। তিনি প্রতিষ্ঠা করেন বহু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু হচ্ছে- আদিনা ফজলুল হক কলেজ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, ফজলুল হক কলেজ, চাখার, বরিশাল; লেডী ব্রাবোর্ণ কলেজ, কলকাতা, ভারত; শেরে-ই-বাংলা কৃষি কলেজ (পরবর্তীতে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়), শেরে বাংলা নগর, ঢাকা; ফজলুল হক ইনস্টিটিউশন, চাখার, বরিশাল; ওয়াজেদ মেমোরিয়াল উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়, চাখার, বরিশাল। এছাড়াও অগণিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপনায় তার রয়েছে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহযোগিতা। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সময় তিনি ছিলেন ব্রিটিশ ভারতের শিক্ষামন্ত্রী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে গঠিত ব্রিটিশ সরকারের নাথান কমিশনকে তিনি বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করেন। পরবর্তীতে এই বিদ্যাপীঠটি পূর্ববাংলার গণমানুষের শিক্ষা বিস্তারের ক্ষেত্রে অনবদ্য ভূমিকা পালন করে। এক সময় এই বিশ্ববিদ্যালয়টিই বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের সূতিকাগারে পরিণত হয়। পৃথিবীর ইতিহাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ই হচ্ছে একমাত্র বিদ্যাপীঠ যা একটি স্বাধীন দেশের জন্ম দিয়েছে। 

তিনি ছিলেন একাধারে অসম্ভব ধার্মিক একজন মুসলমান পাশাপাশি অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী এক মহামানব। তিনি তার অর্জিত সম্পদ অকৃপণ হস্তে মানব কল্যাণে ব্যয় করতেন। কথিত আছে তিনি যখন কলকাতা সিটি কর্পোরেশনের প্রথম মুসলিম মেয়র তখন বিদ্যুৎ পরিদর্শক এলেন তার বাসার বিদ্যুৎ বিল গ্রহণের নিমিত্তে। একই সময় এক ব্রাহ্মণ এলেন তার মেয়ের বিয়েতে সহযোগিতার উদ্দেশ্যে। তিনিও বাসায় প্রবেশ করলেন কলকাতা হাইকোর্টে প্র্যাকটিস শেষে ৪০০ টাকা হাতে নিয়ে। বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ না করে পুরো টাকাটাই দান করলেন ব্রাহ্মণ ভদ্রলোককে। তখন বিদ্যুৎ পরিদর্শক খালি হাতেই হাসিমুখে চলে গেলেন। এই ছিল তার মহানুভবতা, ধার্মিকতা ও অসাম্প্রদায়িকতা। 

এমন নেতা এখনকার জমানায় আসলেই বিরল। তিনি ছিলেন হিন্দু-মুসলমান সবার নিকট আস্থাভাজন এক মহান নেতা। তিনিই একমাত্র নেতা যিনি একই সাথে মুসলিম লীগের সভাপতি ও কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জওহর লাল নেহেরু ব্রিটিশ শাসনামলে একসময় ছিলেন তার একান্ত সচিব। 

বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক বিকাশ ও উত্থান তারই হাত ধরে। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে যুক্তফ্রন্টের নিরঙ্কুশ বিজয় ও প্রাদেশিক সরকার গঠনে তারা অনবদ্য ভূমিকা রাখেন। এই নির্বাচনই তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে মুসলিম লীগকে চিরতরে নির্বাসিত করে এবং এই অঞ্চলের রাজনীতিবিদদের কেন্দ্রীয় পাকিস্তান সরকারের নিকট এক চ্যালেঞ্জ হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করেন। 

বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনেও তিনি ছিলেন অন্যতম পথিকৃৎ। তিনি ১৯৪০ সালের ২৩ মার্চ পাকিস্তানের লাহোরে মুসলিম লীগের সাধারণ অধিবেশনে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের মুসলিম অধ্যুষিত রাজ্যগুলোকে নিয়ে স্বাধীন মুসলিম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবি জানান যা লাহোর প্রস্তাব নামে খ্যাত। এই প্রস্তাবে শুধু বাংলা ও আসাম নিয়েই ভিন্ন একটি স্বাধীন মুসলিম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার উল্লেখ থাকলেও পাক-নেতাদের ষড়যন্ত্রমূলক আচরণের কারণে তা আর সম্ভব হয়ে ওঠেনি। ফলে স্বাধীন পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে তিনি অনেকটা নিরুত্সাহিত বোধ করেন। পরবর্তীতে অখণ্ড পাকিস্তান রাষ্ট্রে ভাষা আন্দোলন থেকে সৃষ্ট ক্ষোভ ও সংগ্রাম নতুন উদ্যমে পূর্ববাংলায় স্বাধিকার আন্দোলনের জন্ম দেয় এবং শেষ পর্যন্ত রক্তক্ষয়ী এক সংগ্রামের মধ্য দিয়ে পৃথিবীর মানচিত্রে সুজলা-সুফলা, শস্য-শ্যামলা স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। 

এই মহামানব ইহলোক ত্যাগ করেন ২৭ এপ্রিল ১৯৬২ সালে, ঢাকায় ৮৮ বছর ৬ মাস বয়সে। তাকে সমাধিস্থ করা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান অনুষদ সংলগ্ন হাইকোর্ট প্রাঙ্গণে যা তিন নেতার মাজার হিসাবে সর্ব সাধারণের নিকট পরিচিত। 

একজন চাখারবাসী হিসাবে বরিশালের কৃতিসন্তান শের-ই-বাংলা এ কে ফজলুল হকের ৬২তম মৃত্যুবার্ষিকীতে তার বিদেহী আত্মা ও অমর স্মৃতির প্রতি জানাই সালাম ও গভীর শ্রদ্ধা।

লেখক: শিক্ষক ও গবেষক।


মানবকণ্ঠ/এফআই