Image description

বাংলা বর্ষপঞ্জি অনুসারে চৈত্রের বিদায় শেষে আসে বৈশাখ। আর এই বৈশাখ মাসের অন্যতম সাধারণ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে ভেপসা গরম অনুভূত হওয়া। কিন্তু এ বছর বর্ষবরণের পর থেকেই দেশের বিভিন্ন জেলায় বয়ে যাচ্ছে তীব্র তাপপ্রবাহ। এই তীব্র গরম আবহাওয়া সহসাই কমার কোনো ইঙ্গিত নেই। বরং বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চলতি মাসেই তাপমাত্রা আরও বাড়তে পারে। আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে, সামনের দিনগুলোতে তাপমাত্রা ৪২-৪৪ ডিগ্রি সেলসিয়াসে ওঠানামা করতে পারে। অর্থাৎ হিট অ্যালার্ট বহাল থাকবে।

তাপপ্রবাহের কারণে ইতোমধ্যে স্কুল, কলেজ বন্ধ ও দু’একটি বিশ্ববিদ্যালয় সশরীরে ক্লাস পরিচালনা বন্ধ রাখার ঘোষণা দিয়েছে। হঠাৎ করে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টির পেছনে অবশ্য মানবসৃষ্ট অনেক কারণ রয়েছে যার অন্যতম হচ্ছে নির্বিকারে বৃক্ষনিধন। পত্র-পত্রিকা কিংবা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নির্বিকারে বৃক্ষ নিধনের অহরহ খবর পাওয়া এখন নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। উন্নয়নের নামে বৃক্ষ নিধন জনসাধারণের কাছে যেমন হুমকি স্বরূপ দেখা দিয়েছে ঠিক তেমনি বিশেষজ্ঞদের ভাবিয়ে তুলেছে। খেয়াল করলে দেখবেন, জাতীয় বননীতি অনুযায়ী দেশের মোট স্থলভাগের অন্তত ৩৩ শতাংশ গাছ এবং অরণ্যবেষ্টিত রাখার কথা বলা  হয়েছে, অথচ আমাদের স্থলভাগে তার অর্ধেকের চেয়েও কম আছে। ফলে নতুন করে দেখা দিচ্ছে তীব্র তাপদাহ। কেবলই তাপদাহ নয়, বৃক্ষ নিধনের কারণে আজকাল বজ পাতের সংখ্যাও অত্যাধিক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। বৃক্ষ নিধন কিভাবে তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে সে  সম্পর্কে জানতে গেলে, একটি গবেষণার কথা তুলে ধরা দরকার।

বৃক্ষ নিধনের পরিবেশগত প্রভাবে তাপমাত্রা বৃদ্ধি ও হিট আইল্যান্ড এফেক্ট বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ (বিস), অস্ট্রেলিয়ার কার্টিন বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবহাওয়া বিভাগের এক যৌথ গবেষণার তথ্য মতে, ঢাকা শহরে গ্রামের থেকে সাড়ে তিন ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা বেশি থাকে। গবেষণার তথ্যমতে, ঢাকার উষ্ণতম স্থানের সঙ্গে শহরের বাইরের প্রাকৃতিক পরিবেশসমৃদ্ধ এলাকার সঙ্গে দিন-রাতের ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রার পার্থক্য যথাক্রমে ৭ ও ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আর এই তথ্যানুসারে সহজেই  অনুমান করা যাচ্ছে যে, বৈশাখের শুরুতে তীব্র এই তাপপ্রবাহের অন্যতম কারণ হচ্ছে বৃক্ষ নিধন। ফলে নিজেদের টিকে থাকার সংগ্রামে অবশ্যই আমাদের বৃক্ষ নিধন বন্ধের জন্য জোরালো পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে এবং ব্যক্তিগত উদ্যোগ থেকে সামাজিক উদ্যোগে বৃক্ষরোপণ অভিযান পরিচালনা করতে হবে। বৃক্ষরোপণই পারে তীব্র তাপপ্রবাহের হাত থেকে আমাদের শিশু থেকে বৃদ্ধ সকলকে রক্ষা করতে। বৃক্ষরোপণ অভিযান পরিচালনা করলে একদিকে যেমন তাপমাত্রা সহনশীল পর্যায়ে নেমে আসবে ঠিক তেমনি অক্সিজেন উৎপাদন অনেকাংশে বৃদ্ধি পাবে এবং কার্বন ডাই-অক্সাইড শোষিত হবে। ফলে বৃক্ষনিধন রোধকল্পে নতুন নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে। ব্যক্তির ইচ্ছে মতো বৃক্ষ নিধনে নিরুৎসাহিত করার পাশাপাশি বৃক্ষ নিধনকে কঠোরভাবে দমন করতে হবে। ‘গাছ লাগান, পরিবেশ বাঁচান’ এই সেøাগানকে নতুন করে প্রত্যেক মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে হবে। যাতে করে প্রত্যেকে স্বেচ্ছায় নিজের বেঁচে থাকার সংগ্রামে একজন সফল সৈনিক হিসেবে বৃক্ষ রোপণের দিকে অগ্রসর হয়, কবির কণ্ঠে কণ্ঠ রেখে বলতে পারে, ‘এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য ক’রে যাব আমি নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।’ (ছাড়পত্র, সুকান্ত ভট্টাচার্য)

বলা বাহুল্য যে, বৃক্ষরোপণ অভিযান পরিচালনা করার জন্য শহর এলাকায় পরিকল্পিত উন্নয়নের মডেল তৈরি করে বৃক্ষ রোপণের জন্য যথেষ্ট পরিমাণ জায়গা নির্বাচন করতে হবে। যেসব এলাকায় নতুন করে বৃক্ষ রোপণ করা প্রায় অসম্ভব কাজ হিসেবে দাঁড়িয়েছে, সেসব এলাকায় ছাদ কৃষির ধারণা পৌঁছে দিতে হবে। অবশ্য যদি এই ক্ষেত্রে সরকারি প্রণোদনা ও বিভিন্ন মেলার আয়োজন করা যায় তবে কাজটি আরো ত্বরিতগতিতে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে। শহর ছাড়া গ্রামে নিজের ইচ্ছাধীন ভূমির শ্রেণি পরিবর্তন করা রোধ করতে হবে। বৃক্ষনিধন করে রাস্তাঘাট, বসত-ভিটা নির্মাণে নিরুৎসাহিত করতে হবে। যদি এই কাজগুলো বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয় তবে আগামী বছরগুলোতে হয়তো এমন সময়ে শহর থেকে গ্রামে কেউই তীব্র তাপদাহের যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ হবে না।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

মানবকণ্ঠ/এসআরএস