Image description

সম্প্রতি সোমালিয়ার জলদস্যুদের দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে ২৩ নাবিকসহ বাংলাদেশি সামুদ্রিক জাহাজ এমভি আবদুল্লাহ। এই জাহাজটি মোজাম্বিক থেকে দুবাইতে কয়লা নিয়ে যাওয়ার পথে জলদস্যুদের কবলে পড়ে। পত্রিকার খবর অনুযায়ী জাহাজটি সোমালিয়ার উপকূল থেকে ৫০০ নটিক্যাল মাইল দূরে ছিল। জাহাজটি একশ সশস্ত্র জলদস্যু কর্তৃক আক্রান্ত হয়। জাহাজটি দখল করার পর সোমালিয়ার উপকূলের দিকে তাদের নিরাপদ আশ্রয়ে নেওয়া হয়। এইভাবে সামুদ্রিক জাহাজ আক্রমণ একটি বর্বরতম ঘটনা। এর পূর্বে ২০১০ সালেও এমভি জাহান মণি নামের আরেকটি বাংলাদেশি জাহাজ সোমালিয়ান জলদস্যুরা দখল করেছিল। দীর্ঘ তিন মাস আটক রাখার পর ২৬ জন নাবিককে ছেড়ে দিয়েছিল। এভাবেই গত কয়েক দশক ধরে ভারত মহাসাগরে সোমালি জলদস্যুরা নিষ্ঠুর ও নির্মম কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে। জলদস্যুদের এই নির্মম কর্মকাণ্ডের উদ্দেশ্য কী? তাদের উদ্দেশ্য হলো বিদেশি জাহাজ দখল নিয়ে মুক্তিপণ আদায় করা। আর এটি তাদের একটি লাভজনক ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। ২০০৫ সালে ‘এমভি ফেসটি’ নামে একটি পেট্রোলিয়াম ট্যাংকার আটক করে ৩ লাখ ১৫ হাজার মার্কিন ডলার মুক্তিপণ আদায় করেছিল তারা। ‘এমভি পানজিয়া’ নামের একটি জাহাজ সোমালিয়ার জলদস্যু কর্তৃক আক্রান্ত হয়েছিল, যা সোমালিয়ার উপকূল থেকে ৯০ নটিক্যাল মাইল দূরে খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল। ২০০৮ সালে ভারত মহাসাগরে একের পর এক বাণিজ্যিক জাহাজের ওপর আক্রমণ করে তারা। জাহাজের এক নাবিককে জিম্মি করে রেখেছিল ৪৭ দিন পর্যন্ত। তারপর ৬ লাখ ৭৮ হাজার মার্কিন ডলার মুক্তিপণ পেয়ে তারা তাকে ছেড়ে দেয়। ২০১৭ সালে ইরানের মাছ ধরার একটি জাহাজও তারা আক্রমণ করেছিল। তাদের হাতে জিম্মি অবস্থায় ৬২ জনের বেশি মারা গেছে। এছাড়া কখনো কখনো হত্যার খবর পাওয়া যায়। এভাবেই চলছে সামুদ্রিক এই জলদস্যুদের নির্মম কর্মকাণ্ড।

এমভি আবদুল্লাহর কী হতে চলছে? ঘটতে পারে কি কোন হত্যাকাণ্ড? কী পরিমাণ মুক্তিপণ দাবি করতে পারে সোমালিয়ার এই জলদস্যুগণ? এই প্রশ্নগুলো মাথায় ঘুরপাক খেলেও সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলোÑ শুধুমাত্র সোমালিয়ার জলদস্যুরাই বারবার জাহাজ ছিনতাই করে কেন? এর পিছনে কী কারণ রয়েছে? পাশাপাশি তারা কি শুধু বাংলাদেশি জাহাজই আক্রমণ করে? তাদের দমন করতে জাতিসংঘের ভূমিকা কী? এসব বিষয়ে আলোচনা করাই হলো এই লেখার মূল উদ্দেশ্য। তাই শুরুতে জেনে নেওয়া যাক সোমালিয়ার জলদস্যুরা কেন বারবার জাহাজ ছিনতাই করে।

বৈশ্বিক সমুদ্র বাণিজ্যের ক্ষেত্রে একটি ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা হলো সোমালিয়ার উপকূল। আরব সাগর আর লোহিত সাগরের ঠিক মাঝামাঝিতে সোমালিয়ার অবস্থান। সোমালিয়া জলদস্যু কর্তৃক জাহাজ ছিনতাইয়ের ঘটনা ২০০০ সালের শুরুর দিক থেকে পাওয়া যায়। সোমালিয়া আফ্রিকার একটি দারিদ্র্যপীড়িত দেশ। দস্যুবৃত্তির কারণে সোমালিয়ার থেকেও বেশি লাভবান হয় পশ্চিমা কোম্পানিগুলো। সোমালিয়ার জলদস্যুতা শুরু হয় বিগত দশকের ৯০ এর দশকে। সে সময় সোমালিয়ার প্রসিডেন্ট ছিলো সামরিক স্বৈরশাসক মোহাম্মদ সাইদ বারি। তার আমলে দেশটিতে ভয়াবহ রাজনৈতিক অস্থিরতা শুরু হয়।

সোমালিয়া দেশটি বহু গোত্র ও উপগোত্রে বিভক্ত। প্রতিটি গোত্রের নিজস্ব ঐতিহ্য, সামাজিক কাঠামো ও আঞ্চলিক সীমানা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। সামরিক স্বৈরশাসক মোহাম্মদ সাইদ বারি কিছু কিছু গোত্রকে প্রাধান্য ও নানারকম সুযোগ সুবিধা দিলে অন্যরা তার ওপর ক্ষেপে ওঠে। পাশাপাশি ১৯৮০'র দশকে দেশটিতে ভয়াবহ খরা শুরু হয়। দেখা দেয় খাদ্য সংকট। এর ফলে দেশটিতে আগে থেকেই মানবিক সংকট তৈরি হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে সোমালিয়া রাজনৈতিকভাবে টিকে থাকাই ছিল বড় চ্যালেঞ্জ।

অন্যদিকে স্বৈরশাসক মোহাম্মদ সাইদ বারি সমগ্র দেশের কর্তৃত্ব নিতে বারবার ব্যর্থ হচ্ছিল। কারণ সোমালিয়ার উত্তর দিকে সোমালি ন্যাশনাল মুভমেন্ট বা এসএনএম এবং দক্ষিণ দিকে ইউনাইটেড সোমালি কংগ্রেস বা ইউএসসি নামে দুটি আলাদা সশস্ত্র দল দেশটির বিস্তৃত অঞ্চল নিজদের দখলে নিয়ে নেয়। প্রধান দুটি সামরিক দল ছাড়াও দেশটিতে আরও বেশকিছু ছোট ছোট দল ছিল। সব দল যখন সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয় তখন দেশজুড়ে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। অবশেষে ১৯৯১ সালে ইউনাইটেড সোমালি কংগ্রেস দেশটির রাজধানী মোগাদিসু দখল করে নেয়। এর ফলে সামরিক স্বৈরশাসক মোহাম্মদ সাইদ বারি সরকারের পতন ঘটে। ৯০ এর দশকের শেষ দিকে দেশজুড়ে চলা ভয়াবহ গৃহযুদ্ধের শেষে সোমালিয়া যখন ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হয় তখন বিদেশিরা এর সুযোগ কাজে লাগায়।

সোমালিয়ার সরকার ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার পর থেকে সোমালিয়ার সমুদ্র সীমায় ইউরোপীয় বহু জাহাজ ঘোরাফেরা করতে শুরু করে। এই জাহাজগুলো সোমালিয়ার উপকূল খাতে তেজস্ক্রিয় বর্জ্য ফেলতে থাকে। এর ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে সোমালিয়ানরা শুরুতে বুঝতে পারেনি। যখন উপকূলীয় অধিবাসীরা নানা রকম রোগে অসুস্থ হতে শুরু করলো তখনই তারা তেজস্ক্রিয় বর্জ্যের প্রভাব সম্পর্কে বুঝতে পারলো। প্রথমে তারা নানানরকম অদ্ভুত রোগে আক্রান্ত হয়। একপর্যায়ে সোমালি গর্ভবতী নারীরা বিকলাঙ্গ শিশু জš§ দিতে থাকে।

আবার ২০০৫ সালের সুনামির পর হাজার হাজার পরিত্যক্ত ও ফুটন্ত ব্যারেলে সোমালি উপকূল ভরে যায়। এসব বর্জ্যের বেশির ভাগ আসে ইউরোপীয় হাসপাতাল ও কারখানা থেকে। ইতালিয়ান মাফিয়াদের মাধ্যমে সস্তায় তারা এসব বর্জ্য সোমালি উপকূলে ফেলতে থাকে। নানা ধরনের পারমাণবিক উপাদান, সিসা ইত্যাদি পানিতে মিশে যায়। ফলে উপকূলীয় জনগণ মারাত্মক তেজস্ক্রিয়তায় ভুগতে থাকে। কিন্তু ইউরোপীয় সরকারগুলো উপকূলে এসব তেজস্ক্রিয় বর্জ্য ফেলা বন্ধ করার পদক্ষেপ নেয়নি। সোমালীয়দের ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থাও করেনি। একই সময়ে ইউরোপের কিছু কিছু সামুদ্রিক জাহাজ সোমালিয়ার সমুদ্র লুট করতে শুরু করে। 

হতদরিদ্র সোমালিয়ার প্রধান সম্পদ তাদের সামুদ্রিক মাছের ভাণ্ডার। ইউরোপ থেকে আসা এসব অত্যাধুনিক মাছ ধরার জাহাজগুলো প্রতিবছর প্রায় ৩০০ মিলিয়ন সমমূল্যের সামুদ্রিক মাছ সোমালিয়া থেকে ধরে নিয়ে যায়। অন্যদিকে সোমালিয়ার জেলেরা তাদের ছোট ছোট নৌকা ব্যবহার করে তেমন কোনো মাছ ধরতে পারে না। স্থানীয়রা বুঝতে পারলো তাদের সমুদ্র দিন দিন মাছ শূন্য হয়ে পড়ছে। এজন্য সোমালিয়ার এসব সাদাসিদে জেলেরা তাদের ছোট ছোট স্পিড বোট নিয়ে মাছ ধরার জাহাজগুলোকে তাড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। পাশাপাশি বেআইনিভাবে মাছ ধরা এবং উপকূল দূষণ থামানোর জন্য ঐসব জাহাজগুলোর ওপর ট্যাক্স বসানোর চেষ্টাও করে। কিন্তু কোন কাজ হচ্ছিল না। ফলে তারা ন্যাশনাল ভলান্টিয়ার কোস্ট গার্ড অব সোমালিয়া এবং সোমালি মেরিন নামে আলাদা দুটি বেসামরিক উপকূল প্রতিরক্ষা বাহিনী গড়ে তোলে। এসব বাহিনী বর্জ্য ফেলা জাহাজগুলোকে আটক করতে সক্ষম হয়।  বর্জ্যবাহী জাহাজ আটকের মধ্য দিয়ে তাদের আত্মবিশ্বাস দৃঢ় হয়।

এভাবে জাহাজ আটক করে তারা বুঝতে পারলো যে, জাহাজ তাড়িয়ে দেওয়া এবং ট্যাক্স আরোপ করা থেকে জাহাজ আটক করে মুক্তিপণ আদায় করতে পারলে বেশ লাভজনক হবে। এভাবে তাদের একটা অংশ জাহাজ ও নাবিকদের  আটক করে মুক্তিপণ আদায়ের মাধ্যমে ভয়ংকর মাফিয়া নেটওয়ার্ক গড়ে তোলে। সমুদ্র বিষয়ে পর্যাপ্ত জ্ঞান ও দক্ষতা থাকার ফলে স্থানীয় জেলেরা এবং পূর্ববর্তী সরকার ও স্থানীয় সম্প্রদায়ের হয়ে যুদ্ধ করা সাবেক সেনাসদস্যরা মিলে কুখ্যাত জলদস্যু দল গড়ে তুলতে থাকে। এসব জলদস্যু স্থানীয়দের কাছে বেশ জনপ্রিয়। প্রায় ৭০ ভাগ সোমালি মনে করে এটা তাদের সমুদ্র রক্ষার জাতীয় কৌশল।

এশিয়ার দেশগুলো ইউরোপের সাথে বাণিজ্য করতে চাইলে ভারত ও আরব সাগর দিয়ে সুয়েজ খাল অতিক্রম করাই সবচেয়ে সহজ জলপথ। তাই এই পথে চলা জাহাজগুলোকে সোমালিয়ার উপকূল অতিক্রম করতে হয়। ১৯৯১ সালের পর থেকে জলদস্যুতা শুরু হলেও ২০০৫ সাল থেকে মূলত সোমালি জলদস্যুরা বৃহৎ পরিসরে সংঘবদ্ধভাবে আক্রমণ শুরু করে। এই সময় থেকেই তারা মোবাইল ফোন, স্যাটেলাইট ফোন, জিপিএস, সোলার সিস্টেম, আধুনিক স্পিডবোট, এসল্ট রাইফেল, শর্ট গান , গ্রেনেড লঞ্চারসহ অত্যাধুনিক সরঞ্জাম ব্যবহার করে জলদস্যুতা শুরু কেের। গভীর সমুদ্রে দস্যুবৃত্তির ক্ষেত্রে তারা একটি মাদার শিপ থেকে অভিযান পরিচালনা করে। এজন্য সোমালিয়ার উপকূলে যাতে ইউরোপীয় জাহাজগুলো নতুন করে তেজস্ক্রিয় বর্জ্য ফেলতে না পারে সেদিকে মনোযোগ দেওয়া প্রয়োজন। পাশাপাশি  আর্থিক টানাপোড়েনে থাকা সোমালিয়ার নাগরিকদেরকে সহযোগিতা করাও জাতিসংঘের গুরুত্বপূর্ণ কর্তব্য। সব ধরনের অসুস্থতা থেকে মুক্তি দেওয়ার জন্য বিশ্ব স্বাস্থ সংস্থার মনোযোগ প্রয়োজন। পাশাপাশি পশ্চিমারা যাতে অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে সহযোগিতা করতে না পারে সেজন্য জাতিসংঘকে পদক্ষেপ নিতে হবে। জলদস্যুদের দস্যুবৃত্তির জন্য কঠোর শাস্তির বিধান করতে হবে। এভাবে জাতিসংঘ যদি প্রতিটি ক্ষেত্রে পদক্ষেপ গ্রহণ করে তাহলেই সোমালিয়াকে জলদস্যুহীন করা সম্ভব হবে, সম্ভব হবে সামুদ্রিক জাহাজের নিরাপত্তা এবং নিশ্চিত হবে সমুদ্রে শান্তি প্রতিষ্ঠা। সবশেষে এটাই প্রত্যাশা ফিরে আসুক ‘এমভি আবদুল্লাহ’, ভালোভাবে সুস্থ থাকুক ‘এমভি আবদুল্লাহ’র সকল নাবিক।

 লেখক: শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়