Image description

স্বাধীনতা শব্দটির ব্যাপকতা অনেক বিশাল। আসলে যে জাতি কখনো পরাধীন ছিল না তারা কখনই স্বাধীনতার মর্ম বুঝতে পারবে না। পরাধীন ছিল বলেই বাঙালিরা, আমাদের পূর্বপুরুষরা বুঝতে পেরেছিল স্বাধীনতা কতটা প্রয়োজন। স্বাধীনতার স্বাদ নেওয়ার জন্য তারা জীবন দিতেও পিছপা হননি। আসলে বাঙালি জাতির জন্য স্বাধীনতা সবসময়ই অন্যরকম এক অনুভূতির নাম। নয়তো কোথায় কোনো জাতি শুধু স্বাধীনতার জন্যই ৩০ লাখ প্রাণ উৎসর্গ করেছিল এমন ইতিহাস কোথাও দেখা যায়নি। ১৯৭১ সালে নয় মাস যে যুদ্ধের কারণে আজ আমরা স্বাধীন সেখানেও তরুণদের অংশগ্রহণ ছিল সর্বাধিক। বাংলার মাটি ও মানুষ পরাজিত হতে জানে না। বিশ্বায়নের এ যুগেও রক্তের পলিতে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে বাংলাদেশÑএমন প্রত্যাশা জাতির।

১৯৪৭ সালে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তানের জšে§র আগে থেকেই বঞ্চিত ও শোষিত বাঙালি জনগোষ্ঠী নিজের ভাষায় কথা বলার জন্য সংগ্রাম শুরু করেছিল। ১৯৪৮ ও ১৯৪৯ সাল থেকে নিয়ে এই আন্দোলন চূড়ান্ত রূপ লাভ করে ১৯৫২-এর ২১ ফেব্রুয়ারি। তবে ভাষার অধিকারের জন্য বাঙালিকে অপেক্ষা করতে হয়েছিল আরো ৫টি বছর। ১৯৫৬ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান সংবিধান উর্দুর পাশাপাশি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছিল। দীর্ঘ সংগ্রামের পর এলো বাংলা ভাষায় কথা বলার স্বাধীনতা, আর এই ভাষা আন্দোলনের হাত ধরে স্বাধীন বাংলাদেশের ভিত গড়ে উঠেছিল। বাহান্নর ভাষা আন্দোলনই একাত্তরের সূচনা! ১৯৫২-র ভাষা আন্দোলন তখনকার পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যবিত্ত শিক্ষিত বাঙালিদের আন্দোলন ছিলো। সংগ্রামে যদি পূর্ববর্তী প্রজš§ পরাজিত হতো তাহলেও বাংলাভাষা শেষ হয়ে যেতো না; বাংলাদেশের মানুষ বাংলাতেই কথা বলতো এবং শিক্ষিতদেরকে সরকারি চাকরি বা সরকারি সুবিধার জন্যে উর্দুই শিখতে হতো! এখন যেমন ইংরেজি শিখতে হয়! রাষ্ট্রভাষা উর্দু হলে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিরা কি বাংলা ভুলে যেতো? ইংরেজ শাসনামলে ভারতবর্ষের সরকারি ভাষা ছিলো ইংরেজি এবং তারও আগের মুসলিম শাসনামলে দাপ্তরিক ভাষা ছিলো ফার্সি। তাতে তো বাংলা বা ভারতবর্ষের অন্য কোন ভাষা লোপ পায়নি! পুরোটাই আসলে অর্থনীতি, রাজনীতি ও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার সঙ্গে জড়িত। রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলাকে প্রতিষ্ঠা করাই ভাষা আন্দোলনের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল এমনটা নয়! বরং এটা বৃহত্তর অর্থে বাঙালিদের স্বাধিকারের দাবি! কথিত মুখের ভাষাকে রাষ্ট্রভাষায় স্বীকৃতি দেয়ার অধিকার আদায়ের শতভাগ ন্যায়সংগত দাবি। নিজের মুখের ভাষায় কথা বলতে পারার স্বাধীনতা ছিনিয়ে নেয়া হেলার ব্যাপার না! বাঙালি অর্থনৈতিক, রাজনেতিক ও রাষ্ট্রীয় আর কোন ধরনের নিপীড়নই মেনে নিতে পারছিলো না!

ভাষা আন্দেলন সাফল্যই বাঙালির মনের ভিতরের লুকিয়ে থাকা আগুন দপ করে জ্বালিয়ে দিয়েছিল। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি মাতৃভাষার অধিকারের দাবিতে রক্ত দিয়েছিল রফিক, সালাম, বরকত, সফিউর, জব্বাররা। তাদের রক্তে শৃঙ্খলমুক্ত হলো পূর্ববাংলায় বাংলা। বাঙালি জাতিসত্তা বিকাশের সংগ্রামের সূচনা সেদিনই ঘটেছিল। এরপর এক এক করে ১৯৫৬ সালে সরকারি ভাষায় বিতর্ক, আইয়ুব খানের শাসন, পাকিস্তানে পাঞ্জাবি ও পশতুনদের দেনা বাঙালিদের ওপর জোরপূর্বক চাপিয়ে দেয়া, সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও সামরিক এবং বেসামরিক চাকরির ক্ষেত্রে বাঙালিদের নগণ্য সুযোগ দেওয়া, জাতীয় রাজস্ব এবং সরকারি সাহায্যের দিক থেকে বাঙালিদের সামান্য অংশ বরাদ্দ ইত্যাদি কারণে। এবং জাতিগতভাবে পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে বৈষম্যে বাঙালিদের মধ্যে চাপা ক্ষোভের জš§ দিল! পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি ভাষা আন্দোলনের চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে আরো বড় অধিকার আদায় ও গণতন্ত্রের দাবিতে ছয় দফা আন্দোলন শুরু করলো। এ আন্দোলনই পরবর্তীতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ হয়ে উঠলো! ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের উদ্দেশ্য কি ছিল? পাকিস্তান রাষ্ট্রটির মৌলিকনীতি ও ধারণার বিপরীতে অসাম্প্রদায়িক, কল্যাণমুখী, মানবিক ও প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে এদেশের মানুষের মৌলক অধিকার ও ন্যায়সংগত অধিকার নিশ্চিত করা, জাতীয় পরিচয় প্রতিষ্ঠা, শোষণ, বৈষম্য, অন্যায়ের অবসান ঘটনা ও সাধারণের ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা। বাহান্ন ও একাত্তর তাই একই আদর্শ ও উদ্দেশ্য গাথা। বাহান্নর ভাষা আন্দোলন ও একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ পূর্ববাংলার বাঙালির স্বাধিকারের আন্দোলন এবং বাংলাদেশের জšে§র দুই স্তম্ভ। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান ও ভারত আলাদা স্বাধীনতা লাভ করলেও বাঙালির সার্বিক মুক্তি ঘটেনি।

২৫ মার্চ ১৯৭১, বাঙালির রক্তাক্ত ইতিহাসের কালো অধ্যায়। পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ২৫ মার্চ গভীর রাতে ঘুমন্ত নিরীহ বাঙালির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, চালায় ইতিহাসের বর্বরোচিত গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ অপারেশন সার্চলাইট নামের বর্বর অত্যাচার। এ হায়েনার দল রাজারবাগ পুলিশ লাইন, পিলখানা, ইপিআর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন জায়গায় নিরস্ত্র জনগণের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। পুরো ঢাকা শহরে চালায় ধ্বংসযজ্ঞ। ২৫ মার্চ ১৯৭১ ইতিহাসের কালরাত্রি হিসেবে থেকে যায় বাঙালির জীবনে, কিন্তু সে কাল অধ্যায় ছাপিয়ে ২৬ মার্চ সূচিত হয় স্বাধীনতার গৌরবময় অধ্যায়। ২৬ মার্চ জ্বলে ওঠে স্বাধীন বাংলার স্বর্ণশিখা। মুক্তিপাগল জনতা ঝাঁপিয়ে পড়ে স্বাধীনতার সংগ্রামে। ২৬ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণা এলেও স্বাধীনতার বীজ রোপিত হয়েছিল মূলত ৭ মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দিয়েছিলেন স্বাধীনতার সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার ডাক। তার বজ কণ্ঠের সেই ডাক বাঙালির জীবনে আজো অমলিন ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। মার্চ বাঙালি জাতির জন্য মহাগুরুত্বপূর্ণ একটি মাস। তাই এই মাসটিকে তিলে তিলে উপলব্ধি করা আমাদের প্রয়োজন। জাতি হিসাবে আমরা এতটা অকৃতজ্ঞ নই। কারো কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে কার্পণ্য করি না। যদিও এই কালচারটা তৈরি করতে অনেক বছর লেগেছে। আবার সবার মনের উদারতা যে এক রকম তা-ও কিন্তু নয়। সত্তরের সাধারণ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়া সত্ত্বেও পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী আওয়ামী লীগের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে টালবাহানা শুরু করলে গর্জে ওঠে গোটা বাংলাদেশ। একাত্তরের ঐতিহাসিক ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে জাতির উদ্দেশে গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ডাক দেন অসহযোগের।

তিনি বলেন, তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো, শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে। ওই ভাষণটাই মূলত স্বাধীনতার ঘোষণা। সারা দেশ উত্তাল হয়ে ওঠে। প্রত্যেক বাঙালিই বুঝতে পারে সামনে আমাদের কঠিন সময়। স্বাধীনতা সংগ্রামীরা মুক্তির যে শিখাটি প্রজ্বলিত করেছেন তাকে অনির্বাণ রাখতে তরুণ সমাজের দায়িত্বই সমধিক। তাদের স্বাধীনতার সংগ্রামের আদর্শ, শহীদদের আত্মদান, দেশপ্রেম ও দেশ গড়ার প্রত্যয় নিয়ে উদ্বুদ্ধ করতে পারলে তারাই সন্ত্রাস, দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশের ভিত রচনা করবে। বাংলাদেশের ইতিহাসকে কি কখনো বিকৃত করা যাবে? মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং যে বিরাট সংগ্রামী ঐতিহ্যের অধিকারী এই বাঙালি জাতি, তাদের নিয়ে কি কোনো ধূম্রজাল সৃষ্টি করা কারও পক্ষে সম্ভব হবে? জাতি অর্জন করেছিল একটি জাতীয় পতাকা ও জাতীয় সঙ্গীত। স্বাধীনতা মানে ইচ্ছার স্বাধীনতা, রাজনীতির স্বাধীনতা এবং অবশ্যই অর্থনৈতিক মুক্তি। বঙ্গবন্ধু ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণে স্পষ্টভাবেই উচ্চারণ করেছিলেন! ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র ছিল অলিখিত ১২ নং সেক্টর- কেননা এখান থেকে প্রচারিত অনুষ্ঠান মুক্তি যোদ্ধাসহ সব বাঙালিকে দিয়েছে স্বাধীনতার মনোবল আর সাহস ‘মোরা একটি ফুলকে বাঁচাব বলে যুদ্ধ করি, পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে’ এ সব কালজয়ী গান দৃঢ় করেছে স্বাধীনতার চেতনাকে। দীর্ঘ নয় মাস পর একসাগর রক্তের বিনিময়ে আমরা পেয়েছি বাংলার স্বাধীনতা, স্বাধীন মানচিত্র, সার্বভৌম বাংলাদেশ। ২৬ মার্চ বাঙালির আত্মশক্তি ও আত্মপ্রত্যয় অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার দিন। আজ স্বাধীনতার সাড়ে চার দশক পেরিয়েছে। এখনো হতাশাগ্রস্ত আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অনেক সিপাহসালার। এখনো আমরা মাথা উঁচু করে ন্যায়সঙ্গত অধিকারের কথা বলতে ব্যর্থ হচ্ছি। অথচ স্বাধীনতা মানেই তো ন্যায়সঙ্গত অধিকার ফিরে পাওয়া। স্বাধীনতা মানেই তো দেশের কল্যাণে নিজের কল্যাণ খোঁজা। স্বাধীনতা মানেই নিরাপত্তার গ্যারান্টি।

স্বাধীনতা মানেই বিশ্বাসের পতাকা হাতে নির্ভয়ে ও নির্বিঘ্নে সামনে এগিয়ে চলা। স্বাধীনতা মানেই তো আমার স্বদেশ আমার জীবন। স্বাধীনতা মানেই আমার সবুজ স্বপ্নের বিনির্মাণ। ছেলেহারা মায়ের মতো আজো আমরা দৃপ্ত শপথে সে পথেই চেয়ে আছি। আমার মনে হয় এ দেশের তরুণসমাজ যথেষ্ট সৃজনশীল ও প্রতিভাবান। তরুণদের ভাবনাগুলো যথাযথভাবে কাজে লাগাতে পারলে, কর্মসংস্থানের ক্ষেত্র বাড়াতে পারলে এবং তরুণসমাজকে দক্ষ জনশক্তিতে রূপান্তর করতে পারলে কাক্সিক্ষত স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তোলা সম্ভব। তরুণদের মধ্যে স্বাধীনতার চেতনা উদ্বুদ্ধ করতে পারলে, স্বাধীনতার মর্মার্থ ও গুরুত্ব তরুণদের মধ্যে উপলব্ধি করাতে পারলে বাঙালির স্বাধীনতা দিবস পালন সার্থক হবে বলে মনে করি। সবাই নিজ নিজ জায়গায় ভূমিকা রাখতে পারলে তবেই বাংলাদেশকে উন্নতির স্বর্ণশিখরে নিয়ে যাওয়া সম্ভব।

লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট

মানবকণ্ঠ/এসআরএস