Image description

লাখো লাখো রোহিঙ্গা শরণার্থী যখন বাংলাদেশে স্রোতের মতো আসছিলেন তখন অনেক বাংলাদেশি ভাই-বোন ফেসবুকে সেøাগান তুলেছিলেন বয়কট মিয়ানমার। মিয়ানমারের কোনো জিনিস আমরা ক্রয় করব না। যারা এই কথাগুলো লিখেছিলেন তাদের অনেককে টেকনাফের শপিং সেন্টার হতে বার্মিজ টক ঝাল মিষ্টি আচার কিনতে দেখা গেছে। মিয়ানমার থেকে টেকনাফ স্থলবন্দর দিয়ে নিয়মিত বাংলাদেশে আদা, রসুন ও পেঁয়াজ আমদানি হয়। এর বাইরে মাছ, কাঠ, আচার, মসলা, নারকেল, ইলেকট্রিকসহ নানা পণ্য দেশে আসে।

ভারতের রপ্তানি বন্ধের ঘোষণায় দেশে অসহনীয় হয়ে পড়ে পেঁয়াজের বাজার। চাহিদার তুলনায় উৎপাদন, আমদানি ও সরবরাহ পর্যাপ্ত থাকলেও খুচরা বাজারে বাড়তি দামে ক্রেতাদের পেঁয়াজ কিনতে হয়। যার প্রেক্ষিতে ক্রেতাদের চাহিদার কথা মাথায় রেখে মিয়ানমার থেকে বিভিন্ন সময় পেঁয়াজ আমদানি করতে হচ্ছে। কয়েকমাস আগে ভারতবিরোধী অবস্থান নিয়ে মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন চীনপন্থি নেতা মোহাম্মদ মুইজু। মুইজু ক্ষমতায় বসার পর তিনি প্রথম ইন্ডিয়া আউট প্রচারাভিযান শুরু করেন। এরপরই তিনি ভারতকে তার সামরিক বাহিনী প্রত্যাহারের চাপও দেয়। তখন ভারতের সাথে মালদ্বীপের সম্পর্কে ফাটল ধরে। মুইজ্জু তার অবস্থান থেকে এখন অনেকটাই সরে এসেছেন। সম্প্রতি ভারতের কাছে ঋণ পুনর্তফশীলকরণের আবেদন জানিয়ে মুইজ্জু বলেন, ‘ভারতের থেকে বড় অঙ্কের ঋণ নেওয়া হয়েছে পূর্বসূরিদের আমল থেকে। তাই আমরা আলোচনা করছি, যাতে ঋণ মেটানোর ক্ষেত্রে নরম পদক্ষেপ করা হয়। আমাদের আশা, এর প্রভাব কোনো প্রকল্পে পড়বে না।’ ভারত মালদ্বীপের ‘ঘনিষ্ঠ সহযোগী’ হিসাবেই থাকবে বলে জানান তিনি। মালদ্বীপ থেকে অনুপ্রেরণা পেয়ে বেশ কিছু সরকারবিরোধী মানুষকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে হ্যাশট্যাগ ‘ইন্ডিয়াআউট’, ‘বয়কট ইন্ডিয়ান প্রোডাক্টস’সহ ভারতবিরোধী নানা ধরনের প্রচারণা করতে দেখা যাচ্ছে।

বাংলাদেশের সড়ক পরিবহনমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের মঙ্গলবার সাংবাদিকদের স্পষ্ট করেই বলেছেন, ভারতবিরোধী এই অবস্থানের কারণে ভারতের সাথে কোনো টানাপড়েন হবে বলে তারা মনে করেন না। তিনি আরো বলেন, ভারতীয় পণ্য বয়কটের নামে বিএনপি দেশের বাজারব্যবস্থাকে অস্থির করার গভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে। বিএনপির ডাকে জনগণ সাড়া দেবে না। বাংলাদেশের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বড় অংশই ভারত থেকে আসে। এর সুবিধাও আছে। দূর দেশ থেকে আমদানি খরচ বেশি। কাজেই ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক নষ্ট করার দুরভিসন্ধি বিএনপির মানসিক বৈকল্যেরই বহিঃপ্রকাশ।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, ‘আমরা রাজনৈতিকভাবে এমন কোনো সিদ্ধান্ত এখনো নেই নাই। যারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এমন আন্দোলনের ডাক দিয়েছে সেটা তাদের অধিকার। দলের পক্ষ থেকে এমন কোনো সিদ্ধান্ত নেয়া হয়নি,’ পেঁয়াজ, রসুন, আদা, এলাচ, দারুচিনি, জিরা, আলু, জীবন রক্ষার ওষুধ, মোটরসাইকেল, কাঁচামরিচ, মাছ, কাপড়, চাল এবং বিভিন্ন ধরনের কাঁচামাল ভারত থেকে আমদানি করা হয়। বাংলাদেশে বাৎসরিক পেঁয়াজের চাহিদার ৪০ শতাংশ আমদানি করতে হয়, যার ৯৫ শতাংশ আসে ভারত থেকে। ভারত বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি আবদুল মাতলুব আহমাদ বিবিসি বাংলাকে বলেন, ভৌগলিক অবস্থানের কারণেই ভারত থেকে বাংলাদেশে পণ্য বেশি আমদানি করা হয়। কারণ যেসব পণ্য ভারত থেকে আমদানি করা হয়, সেগুলো অন্য দেশ থেকে আনতে গেলে খরচ ২০ থেকে ৪০ শতাংশ বেড়ে যাবে। পচনশীল পণ্যের ক্ষেত্রে সময় গুরুত্বপূর্ণ। পণ্য আগে বাজারে ছাড়া গেলে ব্যবসাও ভালো হয়। ফলে বাংলাদেশে ভারতীয় পণ্য বর্জনের এই ক্যাম্পেইনের প্রভাব দেখতে দেখতে পাচ্ছেন না এই আমদানিকারক। প্রচারণায় যেসব পণ্য বর্জনের কথা বলা হচ্ছে, দুই দেশের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে সেগুলোর অনুপাত খুবই সামান্য। ব্যবসায়ীরা আরও বলছেন, এসব পণ্য ভারত থেকে মোট আমদানির খুবই অল্প অংশ। স্থলবন্দরের ক্লিয়ারিং অ্যান্ড ফরোয়ার্ডিং-সিএন্ডএফ এজেন্টরা বলছেন, তিন মাস আগে যেখানে দিনে তিনশো থেকে সাড়ে তিনশো ট্রাক বাংলাদেশে প্রবেশ করতো। এখন কোনো কোনো দিন সেই সংখ্যা ৪০০ ছাড়িয়ে যায়। ছোটবেলায় বইতে পড়তাম মাছে-ভাতে বাঙালি। কৃষকের পুকুর ভরা মাছ এবং গোয়াল ভরা গরু ছিল। সময়ের স্রোতে সবকিছু ইতিহাস হয়ে গেছে। অতি জনসংখ্যার প্রভাব এবং কৃষি উপকরণের দাম বৃদ্ধি পাওয়াতে কৃষি উৎপাদন দিন দিন কমে যাচ্ছে। বিশ্বে মাছ উৎপাদনে শীর্ষ দেশগুলোর একটি হচ্ছে বাংলাদেশ। অথচ সেই বাংলাদেশে রুই-কাতলের মতো বড় মাছও আমদানি করা হয়। শুধু তা-ই নয় এর সঙ্গে প্রচুর বাইম মাছ এমনকি ছোট জাতের কাঁচকি মাছও ভারত থেকে আসার খবর পাওয়া গেছে। ভারতের পাশাপাশি মিয়ানমার থেকেও রুই মাছ আনা হয়।

মৎস্য অধিদপ্তরের হিসেবে ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশে মাছ আমদানি হয়েছে ৫৭ হাজার মেট্রিক টন। এরমধ্যে শুধু বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে ভারত থেকে আমদানি হয়েছে ২৪ হাজার মেট্রিক টন। কয়েকদিন আগে গ্রামের বাড়িতে ছেলের উপনয়ন উপলক্ষে রূপচাঁদা মাছ কিনলাম। বিক্রেতা আমাকে জানালেন এই মাছগুলো চীন থেকে এসেছে। আমি মনে মনে ভাবলাম আমাদের বিশাল সমুদ্রসীমা,  চারদিকে জালের মতো ছড়িয়ে আছে অনেক নদ-নদী অথচ আমাদেরকে বাইরের দেশ থেকে মাছ কিনে খেতে হচ্ছে এটা সত্যি দুর্ভাগ্যজনক। সংবাদ মাধ্যমের এক রিপোর্টে দেখলাম পাঁচ বছর আগে বাংলাদেশের বাজারে ৬০ হাজার ৫৮৩ কোটি টাকার মেশিনারিজসহ বিভিন্ন ধরনের পণ্য সরবরাহ করেছিল চীন। ২০২৩ সালে সেখান থেকে এসেছে ১ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকার পণ্য। অর্থাৎ পাঁচ বছরের ব্যবধানে দেশের আমদানি পণ্যের বাজারে চীনের অংশীদারত্ব বেড়েছে ৫০ শতাংশেরও বেশি। চীন থেকে বাংলাদেশ শিল্প-কারখানার যন্ত্র, কেমিক্যাল, বস্ত্র খাতের কাঁচামাল, ইলেকট্রনিক পণ্য ও আসবাবপত্র আমদানি করে। আবার পোশাক তৈরির বেশির ভাগ কাঁচামালও আসে চীন থেকে। যদিও আমদানির বিপরীতে চীনে নামমাত্র পণ্য রপ্তানি করে বাংলাদেশ। ফলে দেশটির সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি সর্বোচ্চ। পণ্য আমদানিতে চীনের পরই ভারতের অবস্থান। পাঁচ বছর আগে ভারত থেকে ২৬ হাজার ৬৪৮ কোটি টাকার ৪৭ লাখ টন পণ্য আমদানি করেছিল। ২০২৩ সালে আমদানি হয়েছে ২ কোটি ৮৭ লাখ টন। যার অর্থমূল্য ৮৯ হাজার ৬৭২ কোটি টাকা। সে হিসাবে পাঁচ বছরের ব্যবধানে ৭০ শতাংশ অংশীদারত্ব বেড়েছে ভারতের। চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ প্রায় ১৩ হাজার মিলিয়ন মার্কিন ডলার।

চীন ও ভারতের সঙ্গে বিশাল বাণিজ্য ঘাটতি কমিয়ে আনতে উপযুক্ত পদক্ষেপ নিতে হবে।  চীন, ভারতসহ যেসব দেশ থেকে সবচেয়ে বেশি আমদানি হয়, সেসব দেশই কিন্তু পণ্য রপ্তানির চমৎকার বাজার হতে পারে। যদি চীনের প্রয়োজন মাথায় রেখে রপ্তানি বাড়াতে পারি, তাহলে বাণিজ্য ঘাটতি কমবে। রপ্তানিকারকদের সক্ষমতা, উৎপাদিত পণ্যের বৈচিত্র্যকরণ ও গুণগত মান বাড়ানোতেও নজর থাকা জরুরি। উদ্যোক্তার দক্ষতা বৃদ্ধির পাশাপাশি পণ্যে বৈচিত্র্য আনতে নীতি সহায়তা দেয়া হচ্ছে। পাশাপাশি কোন দেশে কোন পণ্যের চাহিদা রয়েছে, তার সম্ভাব্যতাও যাচাই করতে হবে। সরকারকে আমদানিনির্ভরতা কমানোর জন্য দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করতে হবে। সবকিছুর মূলে আমাদের দেশপ্রেমকে জাগ্রত করতে হবে। যেখানে সাধারণ ক্রেতাদের জিম্মি করে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বাড়ানো হয় সেখানে নিজেরা কিভাবে স্বয়ংসম্পূর্ণ হবো তা ভাবনার বিষয়। দেশের মুদ্রা যাতে বাইরে চলে না যায় তার জন্য সবাইকে কাজ করতে হবে। আগামী দিনগুলোতে আমদানির তুলনায় রপ্তানি বাড়ুক এটাই প্রত্যাশা। দেশের একজন নাগরিক হিসেবে বাংলাদেশকে অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধশালী একটি দেশ হিসেবে দেখতে চাই।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

মানবকণ্ঠ/এসআরএস