Image description

১৯২২ সালে জন্মগ্রহণ করেছিলেন তিনি। আর গত শনিবার তার প্রয়াণ হলো। তার জীবন একদম ছোট নয়। তবে জীবনকে বয়স দ্বারা নির্বাচন করাও যায় না। ক্ষুদিরাম বসু, বিনয়-বাদল -দীনেশ কার জীবন কত বড়। বেঁচে ছিলেন কত কম বয়স কিন্তু তার মধ্যে দেশমাতৃকার যে ঋণ তিনি শোধ করেছেন তার সবকটিই বিরল। টংক বিদ্রোহ, হাজং বিদ্রোহ এবং ব্রিটিশ ও পাকিস্তানবিরোধী আন্দোলনে সরব ছিলেন এই বীর নারী। আমৃত্যু এই মহীয়সী নারী আন্দোলন-সংগ্রামে ছিলেন সোচ্চার। মানুষের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে তিনি ছিলেন একজন সংসপ্তক।

টংক -তেভাগা- নানকার কোন আন্দোলনই স্বাধীনতা সংগ্রাম থেকে আলাদা কিছু নয়। এক একটা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে মানুষ বুঝতে শিখেছে সংগ্রাম ছাড়া স্বাধীনতা অর্জন সম্ভব না। সেদিক থেকে টংক আলাদা কোনো সংগ্রাম নয়। টংক আন্দোলন বাংলার কৃষকদের অধিকার আদায়ের একটি অন্যতম আন্দোলন। তখনও পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হয়নি। কমরেড মণিসিংহ ভারত থেকে দুর্গাপুর মামা বাড়িতে এসেছেন। মামাবাড়ি আসলেও দরিদ্র কৃষকরাতো জানতেন তিনি কে? তাই তার কাছে বলতেন সব অত্যাচার-অনাচার -দুঃখ-কষ্টের কথা। অতঃপর কমরেড মনিসিং হাজংদেও  নিয়ে সব কৃষকদের নিয়ে শুরু করেন শুরু করেন টংক প্রথা বা ধান কড়াড়ি খাজনা বাতিল আন্দোলন।

আন্দোলনে যোগ দেন সীমান্তের কুল্লাগড়া ইউনিয়নের লঙ্কেশ্বর হাজং, রাশিমণি হাজংসহ আদিবাসীরা। এরই জেরে সে বছরের ৩১ জানুয়ারি লঙ্কেশ্বর হাজংসহ বেশ ক’জন হাজং বিদ্রোহী নেতাকে ধরে নিতে ব্রিটিশ ফন্ট্রিয়ার পুলিশ আসে বহেরাতলী গ্রামে। তাদের না পেয়ে লঙ্কেশ্বর হাজংয়ের সদ্য বিয়ে করা স্ত্রী কুমুদিনী হাজংকে তুলে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। এ খবর এক কৃষকদের সভায় রাশিমণি হাজংয়ের কাছে পৌঁছে দেয়। ছুটে যান তিনি কুমুদিনী হাজংয়ের বাড়িতে।

নারীকে নিয়ে যাওয়া মানে মান নিয়ে যাওয়া উল্লেখ করে তিনি ঝাঁপিয়ে পড়েন। হাতে থাকা দা দিয়েই পুলিশের ওপর হামলা চালান। পরে পুলিশের বন্দুকের গুলিতে তিনিসহ দুজন হাজং নেতার মৃত্যু হয়। প্রাণে বেঁচে যান গৃহবধূ কুমুদিনী হাজং। অর্থাৎ তাকে ঘিরেই আন্দোলন ভয়ংকর রূপ নেয়। এবং এখানে একটা কথা প্রযোজ্য যে একটি হাজং পরিবারের স্বামী-স্ত্রী দুজনই আন্দোলনের কর্মী।

কুমুদিনী হাজং এই আন্দোলনের সংগে মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছিলেন। সুসং-দুর্গাপুর এলাকার কৃষক হাজং সম্প্রদায় জীবন দিয়ে আন্দোলন-সংগ্রাম করেছে। তাদের ওপর অত্যাচারও হয়েছে। কিন্তু পরবর্তীতে এসব কথা কেউ মনে রেখেছে বলে জানা নেই। ব্রিটিশ ও পাকিস্তানি শাসনামলের ঐতিহাসিক টংক আন্দোলন ও হাজং বিদ্রোহের সাক্ষী ছিলেন কুমুদিনী হাজং। বিবাহিত জীবনের শুরু থেকেই আন্দোলন সংগ্রামে কেটেছে তার জীবন। কমরেড মনিসিংহের মতো কিংবদন্তি তুল্য কমিউনিস্ট নেতার সান্নিধ্য পেয়েছেন তিনি। ফলে সংগ্রাম ছিলো তার জীবনে নৈমিত্তিক।

আদিবাসী হাজং পরিবারে কুমুদিনী হাজং আন্দোলন সমংগ্রামের মধ্য দিয়ে মানুষের অন্তরে জায়গা করে নিয়েছিলেন। এই স্বশিক্ষিত নারী আন্দোলন সংগ্রাম দিয়ে নিজেকে এক ডিসকোর্সে পরিণত করে গেছেন। তার জীবন থেকে এ শিক্ষা নেয়া যায় যে আন্দোলন করতে শহরেও থাকতে হয় না। বিশ্ববিদ্যালয়েও যেতে হয় না। বদলানোর মানসিকতা থাকলে যেকোন জায়গায় বসে সংগ্রাম করা যায়। তিনি যেন সেই পথ রেখা এঁকে দিয়ে গেলেন। যারা তার আশপাশের এলাকায় যেত তার সঙ্গে দেখা- করে আসতো। তার কাছে গেলে তিনি খুব খুশি হতেন। বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রামের স্মৃতিচারণ করতেন।

তার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে একথাই তিনি বুঝিয়ে গেলেন তিনি জন্ম নিয়েছিলেন এবং একটি জীবন সংগ্রাম করেই কাটিয়ে দিলেন। ওই সময়ে তারা কত আধুনিক ছিলেন যে, স্বামী-স্ত্রী এক সঙ্গে লড়াই সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। লড়ার ভিতরে কোনো খাদ ছিলো না। তাই তার জীবন সংগ্রাম মানুষকে উজ্জীবিত করবে দিনের পর দিন। তার জীবন সংগ্রামের এই অধ্যায়টি বিশাল। সংগ্রামী কুমুদিনী হাজং বেঁচে থাকবেন তার জীবন সংগ্রাম ও বাঙালির ঐতিহাসিক সংগ্রামের আলেখ্য হয়ে।

মানবকণ্ঠ/এআই