Image description

১৬ বছরের মেয়ে, গ্রেটা থানবার্গ। পরিবেশ আন্দোলনের নামে স্কুল পালানো ব্রিটেনের এই ষোলো বছরের মেয়ে বিশ্ববরেণ্য হয়ে গেল। ২০০৩ সালের ৩ জানুয়ারি জন্ম গ্রহণ করা এই কিশোরীর ‘স্কুল স্ট্রাইক ফর ক্লাইমেট’(সুইডেনের ভাষায়, সারা বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি করতে সক্ষম হলো। গ্রেটার দাবি ছিল একটাই। ২০১৮ সালের প্যারিস চুক্তি মেনে জলবায়ু পরিবর্তনের মোকাবিলা করতে হবে। এজন্য সে ২০১৮-র সালের নভেম্বর মাস থেকে প্রতিদিন স্কুল বাদ দিয়ে সুইডেন পার্লামেন্টর সামনে ধর্নায় বসতো।

বিশ্বের অনেক দেশের স্কুল পড়ুয়াদের এই ছাত্র আন্দোলনে শামিল হওয়ার আহ্বান জানিয়ে অনুরোধ করে আসছিল। সেটা ডিসেম্বর, ২০১৮-এর ঘটনা। এ ডাকে সাড়া দিয়ে বিশ্বের কুড়ি হাজারেরও বেশি ছাত্র-ছাত্রী আন্দোলনে শামিল হয়েছিল। ওই বছরের মার্চ মাসে (১৫/০৩/২০১৯) এর এই আন্দোলনে সমর্থন জানিয়ে ১১২টা দেশের এক কোটি চৌদ্দ লক্ষ ছাত্র-ছাত্রী প্রতিবাদী আন্দোলনে শামিল হয়। বিশ্বের ২৭০-টা দেশ থেকে আন্দোলনের সমর্থন সে পেয়েছে। বলাবাহুল্য, বিশ্বে জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে ১৯৭২ সাল থেকেই সব সময় বিশাল আকারে কনফারেন্স/সেমিনার, সিম্পোজিয়াম হয়ে আসছে।

১৯৭২ সালের স্টকহোম কনফারেন্স সেমিনার, ১৯৯২ সালের বসুন্ধরা সম্মেলন, ১৯৯৭ সালের কিয়োটা প্রটোকল, ২০০৭ সালের  বালি অ্যাকশন প্ল্যান ইত্যাদি। এছাড়াও ১৯৯৫ সাল থেকে প্রতি বছরেই তো কনফারেন্স অব পার্টিস (ঈঙচ) হয়ে আসছে। কেন জানি ওর মনে হল, এগুলো তো সবই লোক দেখানো। গোটা পৃথিবীটাই তো ‘হেভ’ আর ‘হেভ নট’ এই দুই ভাগে বিভক্ত। জলবায়ু মোকাবিলায় কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। ছোট্ট এইটুকু মেয়ে ইউরোপের বিভিন্ন জায়গায় সভা-সমিতি করে শুধু এই বার্তাটুকুই জানান দিয়েছে যে জলবায়ু পরিবর্তনের মোকাবিলায় আমাদের এই প্রজন্ম সম্পূর্ণভাবে বিফল। নিজেকে কেউকেটা বলে দাবি করেনি, বলেছে, আমি বৈজ্ঞানিক নই, কিন্তু পরিবেশ এবং জলবায়ু মোকাবিলায় বিগত কয়েক দশক ধরে বৈজ্ঞানিকরা যে সব কথা বলে আসছেন, সাধারণ জনতা সেটা গ্রহণ করছেন না। এই বিপর্যয় তারই কুফল। এখানে বলে নেওয়া উচিত, সুইডেনের জলবায়ু বিষয়ক আইন আগে থেকেই মজবুত ছিল এবং এই আন্দোলনের ফলে তা আরও শক্তিশালী হয়েছে এবং আগামী ২০৪৫ সালে সে দেশ ‘কার্বন নিউট্রাল’ হবে বলে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছে। 

আমাদের দেশেও বিভিন্ন সময়ে পরিবেশ আন্দোলনে মহিলাদের সক্রিয় ভূমিকা ভূয়সী প্রশংসার দাবি রাখে। ১৯৬৩ সালের চীন-ভারত সংঘর্ষের পর পরই উত্তরপ্রদেশের হিমালয় পাহাড় ঘেরা অঞ্চলে দ্রুত উন্নয়নের জোয়ার আসে। উন্নয়ন এবং সংরক্ষণ সবসময়ই পরস্পরবিমুখ। দ্রুত উন্নয়নের ফলে বিদেশি কোম্পানিগুলো সেদেশে চলে আসে। শুরু হয় ব্যাপক ‘বন-ধ্বংস-যজ্ঞ’। অরণ্যঞ্চলে বাস করা স্থানীয়দের জীবিকা বরাবরই জঙ্গল-নির্ভর। যেহেতু বিশাল বিশাল গাছ কেটে ফেলা হবে, তাই সরকারি নির্দেশে স্থানীয়দের ‘অরণ্যের অধিকার’ কেড়ে নেওয়া হয় তীব্র থেকে তীব্রতর প্রতিবাদ। ১৯৬৩ সাল থেকে দফায় দফায় আন্দোলন চলে। চন্দী প্রসাদ ভাট-এর উদ্যোগে স্থাপিত ‘দশলি গ্রাম স্বরাজ মগুল’-এর নেতৃত্বে পরবর্তীতে স্থানীয় নেত্রী গৌরা দেবী আন্দোলনের দায়ভার সমঝে নেন। পিছন থেকে আন্দোলনের নেতৃত্ব তথা রূপরেখা তৈরিতে সহায়ক ছিলেন সুন্দরী লাল বহুগুণা ব্যাপকহারে মহিলারাও এ আন্দোলনে শামিল হন। বিদেশি কোম্পানির কন্ট্রাক্টরের লোকগুলো গাছ কাটতে গিয়ে  দেখেন, গাছের বেড়িগুলো স্থানীয় মহিলারা হাতে হাত দিয়ে বেষ্টন করে রেখেছেন। 

কীটনাশকের ব্যবহারের বিরুদ্ধে ১৯৯১ সাল থেকে ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য বন্দনা শিবা-কে টাইমস ম্যাগাজিন ‘এনভায়রনমেন্টাল হিরো’ উপাধিতে ভূষিত করেছিল ২০০৩ সালে। পাঞ্জাব প্রদেশের এই মহিলা তাঁর বিখ্যাত বই দেখিয়ে দিয়েছেন যে কৃষিক্ষেত্রে হরেক রকমের কীটনাশক ব্যবহƒত হয় এবং এদের অধিকাংশই মাটি ও পানির মধ্য দিয়ে বাহিত হয়ে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে আমাদের খাদ্যদ্রব্যে এসে পড়ে এবং ক্যান্সার, কিডনি, লিভার ও হৃদযন্ত্রের বিভিন্নভাবে ক্ষতি করে। দেশজুড়ে জৈব আন্দোলন গড়ে তোলার লক্ষ্যে ১৯৯১ সালে তিনি ‘নবধান্য’ নামক একটি সংস্থা গঠন করেন। একঝাঁক ছেলে ছোকরা প্রায়ই দেখা যায় রাস্তার ধারে নালা-নর্দমা থেকে আবর্জনা, শিশি, বোতল ইত্যাদি জোগাড় করে বস্তায় পুড়ে নিয়ে যায়। এগুলো বিক্রি করে জীবিকা চলে। ব্যাঙ্গালুরু ভিত্তিক ‘গ্রিন ফোর্স’ নামক এক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের প্রধান নলিনী শেখর প্রায় ৭৫০০ ছেলে ছোকরাদের এরকম উন্নয়নকল্পে কাজ করে যাচ্ছেন।

বিধিবদ্ধ প্রথায় আবর্জনা সংগ্রহ করে কীভাবে এদের স্বাস্থ্য তথা জীবিকা উন্নয়ন করা যায়, এটাই নলিনীর প্রধান কাজ। নর্দমা বাঁচাও আন্দোলনের পুরোধা মেধা পর্যটকদের বিষয়ে তো অনেকেরই জানা। সর্দার সরোবর ডাম নির্মাণের বিরুদ্ধে শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের জন্য ১৯৯২ সালে গোল্ডম্যান পুরস্কারে ভূষিত হয়েছিলেন। বলাবাহুল্য, এই নদীবাঁধ নির্মিত হলে ৩৭,০০০ হেক্টর কৃষি ভূমি ও বনাঞ্চল পানির নিচে তলিয়ে যেত। তিন লক্ষ বিশ হাজার লোক, যাদের অধিকাংশই উপজাতি সম্প্রদায়ের এরা সবাই বাস্তুচ্যুত হয়ে যেত এবং এদের জীবিকা বিপন্নের মুখে পড়ত। ১৯৮৫ থেকে ১৯৯৩-৯৪ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে লাগাতার আন্দালন চালিয়ে গেছেন এবং এক সময় পুলিশের অত্যাচারে তাঁর জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল। ১৯৯১ সালে ২২ দিনব্যাপী অনশন ধর্মঘটে প্রায় মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছেন তিনি। এরপর যার নাম উল্লেখ করতে হয়, তিনি হচ্ছেন মানেকা গান্ধী।

১৯৯৫ সাল থেকে তিনি এর চেয়ার-ওমেন। ১৯৯২ সালে তিনি চবড়ঢ়ষব ভড়ৎ অহরসধষং নামক একটি সংস্থা গঠন করেন এবং বন্যপ্রাণীদের স্বার্থ সুরক্ষা তথা উন্নতির জন্য এটাই সেদেশের সবচেয়ে বড় সংগঠন। ‘ডাউন টু আর্থ’ নামক পাক্ষিক ম্যাগজিনটির নাম অনেকেই জানেন। যে প্রতিষ্ঠান এই পত্রিকাটি বের করে, তার নাম সেন্টার ফর সায়েন্স অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট।এই সেন্টার ফর সায়েন্স অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট-এর পুরোধা হিসাবে রয়েছেন সুনীতা নারায়ণ। ড.অনিল আগারওয়াল দ্বারা প্রতিষ্ঠিত এই সংগঠনের  বর্তমান কর্ণধার সুনীতা নারায়ণ একজন প্রথিতষশা পরিবেশবিদ এবং সবুজ উন্নয়নের অর্থাৎ এর  প্রবর্তক এবং প্রচারক। সালামরাদা ধিমাক্কা নামক দক্ষিণ ভারতীয় এই মহিলা ২০১৬ সালে বিবিসি কর্তৃক পৃথিবীর প্রথম ১০০ প্রভাবশালী মহিলা হিসাবে স্বীকৃতি পান। কর্নাটক রাজ্যের দু’টি ছোট্ট শহর  হুলিকুল এবং কুদুর। দু’টি শহরই একটি জাতীয় সড়ক দ্বারা যুক্ত। সেই জাতীয় সড়কের দুপাশে এ যাবৎ ২৮৪টিরও বেশি বটগাছ রোপণ করেছেন এবং এ কাজটি তিনি এখনও করে যাচ্ছেন। তার এই কৃতিত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ জাতীয় নাগরিক অভিধায় ভূষিত হয়েছেন।

গল্প কিংবা কবিতা লিখেও যে পরিবেশপ্রেমী হওয়া যায়, তার উদাহরণ করল মহিলা কবি সুগথা কুমারী। বিখ্যাত কবিতা বাংলায় বৃক্ষ গাথা ‘সেভ সাইলেন্ট ভেলি’আন্দোলনের সমর্থন জুগিয়েছিলেন। আরেকজন মহিলা কর্মী হচ্ছেন রাধা ভাট। ২০০৮ সালে একসাথে অনেক নদীবাঁধ নির্মাণের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ‘উত্তরাখণ্ড নদী বাঁচাও অভিযান’ গড়ে তোলেন এবং প্রায় ২০০০-এর বেশি জায়গা হেঁটে নদীবাঁধ নির্মাণের বিরুদ্ধে বিপুল জনমত গড়ে তোলেন। শেলি ওয়াকার ভারতের মাইশোর শহরে এসেছিলেন ভাষা এবং যোগ শিখতে। সেটা ১৯৭৫ সাল। সে-সময় একদিন মাইশোরের চিড়িয়াখানা দেখতে গিয়েছিলেন। সেখানে  চিড়িয়াখানায় আবদ্ধ জন্তুদের নির্মম এবং করুণ অবস্থা দেখে আতঙ্কে শিউরে ওঠেন তিনি। পরবর্তীতে দেশের আরও অন্যান্য চিড়িয়াখানা ঘুরেও মোটামুটি একই দৃশ্য দেখতে পান।

এসবের পর ১৯৮৫ সালে কৈম্বেটোর শহরে স্থাপন করেন জু আউট রিচ অর্গানাইজেশন নামক একটি সংস্থা। আজ প্রায় ৩৬ বছর ধরে তার এই সংস্থা ভারত তথা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় জৈব বৈচিত্র্য সংরক্ষণে উল্লেখযোগ্য কাজ করে যাচ্ছে। এ তো গেলো পুরো ভারতের কথা। উত্তরপূর্ব ভারতের মহিলাদের মধ্যে মণিপুরের মহিলা পরিবেশ কর্মী, সাগ্লাইডার টন্টাং, নাগাল্যান্ডের সাংবাদিক বেনো হারালু, অসমেরই পূর্ণিমা দেবী বর্মণ পরিবেশ নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন। এই গুণসম্পন্ন মহিলাদের পরিবেশে হস্তক্ষেপ যে প্রকৃতির সহায়ক হবে, সে আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট

মানবকণ্ঠ/এআই