Image description

রমজান আরবি মাসগুলোর মধ্যে নবম ও সর্বাপেক্ষা পবিত্র, মহান সৃষ্টিকর্তার নৈকট্যলাভের জন্য বান্দার জন্য অশেষ রহমত ও বরকতপূর্ণ মাস। এ মাসে সিয়াম পালন প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক মুসলমান নর-নারীর অবশ্য কর্তব্য (ফরজ)। এককথায়, রমজান মাস হচ্ছে মুমিন বান্দাদের জন্য এবাদতের বসন্তকাল। আরবি বসন্তপুঞ্জী তথা হিজরি সালের শাবান চন্দ্রমাসের সমাপ্তির পরই প্রতিবছর রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের সওগাত নিয়ে আসে এবাদতের মাস রমজান। নৈতিক পরিশুদ্ধি ও আত্মগঠনের মাস হিসাবে মাহে রমজানের আগমনে সারাবিশ্বের ধর্মপ্রাণ মুসলমান নামাজ-রোজার প্রস্তুতি সম্পন্ন করতে কসুর করেন না।

দৈনন্দিন জীবনযাত্রার ব্যস্ততা ও পরিশ্রমকে উপেক্ষা করে মহান রাব্বুল আলামিনকে সন্তুষ্ট করার নিমিত্তে স্বতঃস্ফূর্তভাবে এক অনন্য এবাদতের প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ সর্বত্র লক্ষ্য করা যায়। কেননা, নবী করিম (স.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি পবিত্র রমজান মাস ভালোভাবে যাপন করবে, তার সমগ্র বছর ভালোভাবে যাপিত হবে।’

‘রামদান’ শব্দটি আরবি। ‘রমজান’ শব্দটি এসেছে ‘রমজ’ শব্দ থেকে যার অর্থ হলো জ্বালিয়ে দেয়া। দগ্ধ করার মাঝে রোজা মানুষের মনের কলুষ-কালিমা পুড়িয়ে নষ্ট করে দিয়ে মনকে নির্মল ও পবিত্র করে তোলে। পাপরাশিকে সম্পূর্ণরূপে দগ্ধ করে মানুষকে করে তোলে পুণ্যবান। রোজা একটি ফারসি শব্দ যাকে আরবিতে সিয়াম বলা হয়। ‘রোজা’ মানে সারাদিন উপবাসব্রত পালন করা নয় বরং ‘সিয়াম’ পালনকারী ব্যক্তির পানাহার বন্ধের সাথে সাথে সমস্ত অন্যায় কর্ম, মিথ্যা, আত্মার কু-প্রবৃত্তি, কু-বাসনা, অনিষ্ট চিন্তা থেকে সম্পূর্ণ বিরত থাকতে হয়। রোজা ব্যক্তিগত আত্মসংযম ও ধৈর্য ধারণের শিক্ষা দেয়।

ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের জন্য মাহে রমজানের গুরুত্ব অপরিসীম। মুমিন বান্দাহর জীবনে বছরে অন্যান্য ১১ মাসের তুলনায় রমজান মাসটিই প্রভুর দরবারে মনোবাসনা পূরণের জন্য বান্দাহর নিমিত্তে নিয়ে আসে দুর্লভ সুযোগ। ইসলামের পূর্ণাঙ্গ ও প্রগতিশীল জীবন ব্যবস্থায় এবং ইসলামের পাঁচটি বিধানের মধ্যে রমজান মাসে সিয়াম পালন করতে অত্যন্ত গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে। রমজান এমন একটি মহিমাময় ও গৌরবান্বিত মাস, যে মাসে বিশ্বমানবতার মুক্তির সনদ ইসলামিক গ্রন্থ পবিত্র কুরআন শরিফ নাজিল হয়েছিল। রমজান মাসে অতি হিকমতপূর্ণ মহাপবিত্র আল-কুরআন নাজিল হবার কারণেই এই মাস মহান আল্লাহর অশেষ করুণা ও নিয়ামতে পরিপূর্ণ এবং বিপুল-মর্যাদার অধিকারী। রমজান মাস হচ্ছে সাধনা ও তাকওয়ার মাস, কল্যাণ ও বরকতের মাস, রহমত ও মাগফিরাত এবং জাহান্নামের অগ্নি থেকে মুক্তি লাভের মাস। মহান আল্লাহ এ মাসটিকে বহু ফজিলত ও মর্যাদা দিয়ে অভিষিক্ত করেছেন।

রমজান মাসের যথাযথ মূল্যায়নকারী বান্দাহর মর্যাদা উল্লেখ করে হাদিস শরিফে রসুল (স.) এরশাদ করেছেন, ‘রোজাদারের নিদ্রা এবাদতের সমতুল্য, তার চুপ থাকা তসবিহ পাঠের সমতুল্য, সে সামান্য এবাদতে অন্যসময় অপেক্ষা অধিকতর সওয়াবের অধিকারী হয়।  ইমান ও এহতেসাবের সঙ্গে যে ব্যক্তি রোজা রাখে তার অতীতের সব গুনাহ মাফ করে দেয়া হয়।’(বায়হাকি)

শুধু তাই নয়, হাদিস শরিফে আরও উল্লেখ আছে- যারা রমজান মাসের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত রোজা পালন করে, তারা ওই দিনের মতো নিষ্পাপ হয়ে যায় সদ্য প্রসব লাভ করা শিশুর মতোই। এছাড়াও রোজা রাখার ফজিলত সম্পর্কে অসংখ্য প্রামাণ্য হাদিসে বিদ্যমান। রোজা পালনকারীর জন্য আল্লাহ পুরস্কার নিজ হাতেই দিয়ে থাকেন। যারা রমজান মাসের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত রোজা পালন করেছে, তারা ওই দিনের মতো নিষ্পাপ হয়ে যাবে, যেদিন তাদের মাতা তাদের নিষ্পাপরূপে প্রসব করেন। সব ভালো দ্বীনি কাজের পুণ্যের একটি নির্দিষ্ট সীমারেখা থাকলেও রোজার ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। আল্লাহ রমজান মাসের সিয়াম পালনকারীর প্রতিদান নিজ হাতেই দেবেন বলে অঙ্গীকারবদ্ধ।

রমজান মাস আধ্যাত্মিকভাবে যেমন মহিমান্বিত ঠিক তেমনিভাবে পৃথিবীর বুকে নিয়ে আসে সামাজিক সাম্য, অর্থনৈতিক সমতা, ন্যায়ভিত্তিক মানবিক চেতনা, মানুষে মানুষে পারস্পরিক সহানুভ‚তি-সমমর্মিতা ও উদার ভ্রাতৃত্ববোধ সৃষ্টির মহত্তম প্রেরণা। বিশ্বসমাজ ভালো ও মন্দ দুই শ্রেণির লোকের দ্বারা চালিত। সংখ্যায় ভালো মানুষের অঙ্ক কম হওয়াতে সর্বদা নীচমনা মানুষের উৎপাতে সমাজে অন্যায়, অশান্তি, অনাচার, ব্যভিচার, অবিচার, হত্যা, লুণ্ঠন ও অপরাধমূলক কাজ সংঘটিত হয়। তাই সমাজ সংস্কার বা সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় রোজার বিধান অতি গুরুত্বপূর্ণ।

রমজান মাসে অকস্মাৎ সামাজিক দৃশ্যপট সম্পূর্ণ বদলে যায়। সিয়াম পালনকারী ব্যক্তির চিন্তাধারা, আচার-আচরণ, ব্যবহারিক ও আধ্যাত্মিক জীবনধারা ক্ষণিক সময়ে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন নিয়ে আসে। মানুষের মধ্যকার সকল হীনতা, নীচতা, কপটতা, অসাধুতা ও অমানবিক স্বভাব বৈশিষ্ট্য দূর করে তার মধ্যে এক মহৎ, উন্নত, সৎ, উদার মানবিক গুণ সৃষ্টি করে। সর্বোপরি জীবসত্তায় লুক্কায়িত উত্তম গুণাবলিসমূহের বহিঃপ্রকাশ লক্ষ্য করা যায় সর্বত্র। ধনী-দরিদ্র ভেদ ভুলে সবাই সেহরি ও ইফতারের আনন্দে মেতে ওঠে। দান-খয়রাতের প্রথা অন্যান্য মাসের তুলনায় রমজান মাসে বর্ধিতহারে হওয়ায় অর্থনৈতিক সমতা ফিরে আসে, ধনী-দরিদ্রের তফাৎ ঘোচে, সমাজে সমতার পরিবেশ তৈরি হয়। সিয়াম পালনকারী সারাদিন উপবাস থাকার দরুন দরিদ্রের ক্ষুধা-যন্ত্রণার কথা সহজে আঁচ করতে পারেন।

হাদিস শরিফে এসেছে, রসুলে করিম (স.) বলেন, ‘রোজার মাস হল সহনশীল ও সহমর্মিতার মাস।’ সুতরাং, সারাদিন উপবাসব্রত পালন করা রোজার প্রাথমিক শর্ত নয় বরং দিনের বেলায় পানাহার থেকে বিরত থাকার পাশাপাশি যাবতীয় পাপ কাজ থেকে বিরত থাকা, ধৈর্যধারণ, সততা ও সব্যবহার, আত্মশুদ্ধি ও আত্মসংযম, রিপু নিয়ন্ত্রণ করা এবং কপটতা, প্রবঞ্চনা, কলহ-কোন্দল, মিথ্যা, অশ্লীলতা, অবিচার, জুলুম, অত্যাচার ইত্যাদি বর্জন করা অবশ্য কর্তব্য।

আল্লাহর কাছে একটি রোজা গ্রহণযোগ্য হওয়ার জন্য দৃষ্টি সংযম, সৎ সংকল্প, উত্তম বাক্য, নেক আমল, হালাল জীবিকা, সৎ প্রচেষ্টা, সুচিন্তা ও একনিষ্ঠ সাধনা থাকা দরকার। এছাড়া, পবিত্র কুরআন ও হাদিসে অনেক শর্তাবলি আরোপ করে রোজাদারকে তা পালন করতে বলা হয়েছে যেগুলো পালনের মাধ্যমে সম্পূর্ণ ফেরেশতা চরিত্রের মানবীয় গুণাবলি অর্জন করা তেমন দুঃসাধ্য কিছু নয়।

রোজাব্রত পালনের মাধ্যমে দুনিয়া-আখেরাতের সফলতা লাভের পাশাপাশি শারীরিক স্বাস্থ্য রক্ষায় রোজার গুরুত্ব কম নয়। রোজার মাধ্যমে লিভারে রক্ত সঞ্চালন দ্রুত হয় ফলে ত্বকের নিচে সঞ্চিত চর্বি, পেশির প্রোটিন, গ্রন্থিসমূহ এবং লিভারে কোষসমূহের রসসমূহ বেশি নিঃসরণ হয়। এতে নিয়মিত অভ্যাসকারীদের শারীরিক অসুখ-বিসুখ ও অবকাঠামো অন্যান্যদের চাইতে অনেক ভালো থাকে। রোজা রাখার কারণে স্থূলকায় শরীরে জমে থাকা কোলেস্টেরল শরীরের অন্যান্য জ্বালানির কাছে ব্যয় হয়ে যায় বিধায় শরীর অনেকটা কমে যায় এবং রক্তের সঞ্চালনও ভালোভাবে হয়। ফলশ্রুতিতে মেদবহুলদের জন্য শরীরের ওজনের মাত্রা অনেকটা কম দেখা যায়।

স্বাস্থ্যবিজ্ঞানী ডা. আব্রাহাম জে হেনরি রোজা সম্পর্কে বলেছেন, ‘রোজা হল পরমহিতৈষী ওষুধ বিশেষ। কারণ রোজা পালনের ফলে বাতরোগ, বহুমূত্র, অজীর্ণ, হৃদরোগ ও রক্তচাপজনিত ব্যাধিতে মানুষ কম আক্রান্ত হয়। মহান আল্লাহ পৃথিবীর সমগ্র মানবজাতির কল্যাণে ধরার বুকে শান্তি প্রতিষ্ঠার নিমিত্তে সকলকে রোজা রাখার উত্তম সুযোগ করে দেন।

সাংবাদিক-কলামিস্ট

মানবকণ্ঠ/এআই