Image description

একসময় ইলিশ ছিল মধ্যবিত্ত বাঙালির রসনাবিলাসের অন্যতম অনুষঙ্গ। ইলিশের মৌসুমে প্রতিদিন না হলেও, মাঝে মাঝে পাতে এ মাছের উপস্থিতি ছিল নিয়মিত। প্রতিবেশীর ঘর থেকে ভেসে আসত ইলিশ ভাজার সুঘ্রাণ, যা বাঙালির উৎসব আর ঐতিহ্যকে জানান দিত। অথচ, সেই ইলিশ এখন মধ্যবিত্তদের সাধ্যের বাইরে চলে গেছে। নিম্নবিত্তরা তো ইলিশ খাওয়ার কথা কল্পনাও করতে পারেন না।

জাতীয় মাছ ইলিশ এখন আর সাধারণের মাছ নেই। এটি এখন শোভা পায় কেবল উচ্চবিত্তদের খাবার মেন্যুতে, পরিণত হয়েছে এক প্রকার বিলাসপণ্যে। 

শুক্রবার রাজধানীর রায়েরবাগ ও যাত্রাবাড়ীতে এক কেজি ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ২ হাজার ৩০০ থেকে ২ হাজার ৫০০ টাকায়। এই দাম একজন শ্রমিকের তিন দিনের মজুরির চেয়েও বেশি।

চাঁদপুর, বরিশাল কিংবা পাথরঘাটার আড়তেও মাঝারি আকারের ইলিশের দাম কেজিতে ১ হাজর ৭০০ টাকা থেকে ২ হাজার টাকা। অথচ, বাজারে ইলিশের সরবরাহ ভালো। 

নজরদারিতে ঘাটতি, সিন্ডিকেটের জাল: বাংলাদেশে ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে ইলিশ আহরণ হয়েছে ৫ লাখ ২৯ হাজার টন, যা আগের বছরের তুলনায় প্রায় ৪২ হাজার টন কম। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এর জন্য দায়ী মা ইলিশ ও জাটকা সংরক্ষণে দুর্বল অভিযান, নিষিদ্ধ মৌসুমে মাছ ধরা এবং প্রশাসনিক ব্যর্থতা।

জাতীয় মৎস্যজীবী সমিতির মহাসচিব মো. ইকবাল হোসেন বলেছেন, ২০২৪ সালের আগস্টে রাজনৈতিক অস্থিরতার সময় নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হয়নি। পরে প্রশাসনিক তদারকিও ছিল ঢিলেঢালা।

মৎস্য অধিদপ্তরের ইলিশ শাখার সহকারী পরিচালক এম ফারুক ময়েদুজ্জামান বলেছেন, “আমাদের জনবল ও প্রযুক্তির ঘাটতির কারণে ২৪ ঘণ্টা নজরদারি করা সম্ভব হয় না। এ সুযোগেই অসাধু জেলে ও ব্যবসায়ীরা নিষিদ্ধ সময়েও ইলিশ ধরছে।”

সাগর খোলা, তবু বাজারে আগুন: গত ১১ জুন মাছ ধরার ওপর নিষেধাজ্ঞা উঠে গেলেও বাজারে তার কোনো ইতিবাচক প্রভাব নেই। বরং, দাম আরো বেড়েছে। চাঁদপুর, ভোলা, বরগুনার আড়তে এক কেজি ইলিশের দাম উঠেছে আড়াই থেকে ৩ হাজার টাকা পর্যন্ত।

চাঁদপুরের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মোহসিন উদ্দিন জানিয়েছেন, ইলিশ নিলামের নামে কারসাজি চলছে। গোপন সিন্ডিকেট বাজারে দামের ওপর প্রভাব ফেলছে। তবে, চাঁদপুর মৎস্য বণিক সমিতির নেতা শবে বরাত বলেছেন, আগে যেমন মাছ পাওয়া যেত, এখন তা আর হয় না। জাল, জাহাজ ও জ্বালানির খরচ বেড়েছে। দাম বাড়তেই পারে।

১০ বছরে ৩২৪ শতাংশ মূল্যবৃদ্ধি: বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক মহাপরিচালক ড. মো. আনিছুর রহমান জানিয়েছেন, ২০১৫ সালে এক কেজি ইলিশের দাম ছিল ৫৯০ টাকা। ২০২৩ সালে তা দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৩০০ টাকায়। ২০২৫ সালে এসে তা আড়াই হাজার টাকায় পৌঁছেছে। মাত্র এক দশকে ইলিশ মাছের দাম বেড়েছে ৩২৪ শতাংশ।

তিনি প্রশ্ন তোলেন, ইলিশ তো চাষ করা হয় না, সাগর থেকে ধরা হয়, তাহলে এই বিশাল মূল্যবৃদ্ধি কেন? পাঙ্গাস বা রুইয়ের দাম তো বাড়েনি।

রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ কাগজে-কলমে: ইলিশের বাজারে লাগাম টানতে সরকার এখনো কোনো সমন্বিত বা দৃশ্যমান পদক্ষেপ নেয়নি। চাঁদপুর জেলা প্রশাসন কিছু উদ্যোগ নিলেও তা কার্যকর হয়নি। ইলিশের মূল্য নির্ধারণ, আড়ত সংস্কার কিংবা প্রযুক্তিনির্ভর নজরদারি—সবই এখনো খবরে সীমাবদ্ধ।

মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফরিদা আখতার বলেছেন, ইলিশসহ অন্যান্য মাছের দাম ঘোষণার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়, বরং মূল্যবৃদ্ধির প্রকৃত কারণ চিহ্নিত করে হস্তক্ষেপ করতে হবে।

তিনি জানান, অবৈধ জাল ও জেলেদের বিরুদ্ধে নিয়মিত অভিযান চলছে। তবে, নদীর নাব্য সংকট ইলিশের চলাচলে বিঘ্ন ঘটাচ্ছে। তা গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করা প্রয়োজন।

গবেষণা, প্রযুক্তি আর প্রশাসনিক সদিচ্ছার অভাব: বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখনই কার্যকর ব্যবস্থা না নিলে ইলিশ শুধু ছবিতে থাকবে, পাতে নয়। 

বিশেষজ্ঞদের সুপারিশ: স্যাটেলাইট, ড্রোন ও ডিজিটাল নজরদারির মাধ্যমে মাছ ধরার মৌসুমে কঠোর নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। নিলাম প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা আনতে হবে। সিন্ডিকেট ভাঙতে লাইসেন্স ব্যবস্থার সংস্কার করতে হবে। নদী ও সাগরে ইলিশের চলাচল ট্র্যাক করে বাস্তবভিত্তিক পরিকল্পনা করতে হবে।

তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা মিজানুর রহমান বলেছেন, ইলিশ শুধু মাছ নয়, এটি বাঙালির সাংস্কৃতিক পরিচয়ের অংশ। এই স্বাদ যদি নাগালের বাইরে চলে যায়, তবে তা আমাদের ঐতিহ্যকেই আঘাত করবে।

তিনি জানান, আজ যাত্রাবাড়ীতে ছোট ইলিশ (৩০০ থেকে ৫০০ গ্রাম) ১ হাজার থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। মাঝারি ইলিশ (৬০০ থেকে ৮০০ গ্রাম) ১ হাজার ৮০০ থেকে ২ হাজার টাকা এবং বড় ইলিশ (১ কেজি) ২ হাজার ৩০০ থেকে ২ হাজার ৫০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।