Image description

সোমালিয়ান জলদস্যুদের কবল থেকে ৩৩ দিনে মুক্ত হবার পর বাংলাদেশি জাহাজ এমভি আবদুল্লাহর নাবিকরা জাতীয় পতাকা নিয়ে জাহাজের ডেকে উল্লাসে মেতেছেন। নাবিকরা একসঙ্গে হাস্যোজ্জ্বল ছবি তুলে পাঠিয়েছেন স্বজনদের কাছে। বর্তমানে তাদের পাশে রয়েছেন স্প্যানিশ নৌবাহিনীর নৌসেনারা। বর্তমানে আবদুল্লাহকে নিরাপত্তা দিয়ে দুবাইয়ের দিকে নিয়ে যাচ্ছে ইতালিয়ান নৌবাহিনীর একটি যুদ্ধজাহাজ।

জাহাজের মালিক কোম্পানি কেএসআরএমের চট্টগ্রামের আগ্রাবাদের প্রধান কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানানো হয়।

এসময় প্রতিষ্ঠানটির উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহরিয়ার জাহান রাহাত জানান, সোমালিয়ান জলদস্যুদের হাতে জিম্মি দশা থেকে মুক্ত হওয়া জাহাজ এমভি আব্দুল্লাহকে সংযুক্ত আরব আমিরাতে আনা হচ্ছে। জাহাজটি আগামী ১৯-২০ এপ্রিল দুবাই পৌঁছাবে। এরপর জাহাজটিকে সরাসরি চট্টগ্রাম নিয়ে আসা হবে। তবে মুক্তিপণের বিষয়টি তিনি এড়িয়ে যান।

তবে বাংলাদেশি জাহাজ এমভি আবদুল্লাহ এবং জিম্মি ২৩ নাবিককে ৫০ লাখ ডলার মুক্তিপণের বিনিময়ে সোমালিয়ার জলদস্যুরা মুক্তি দিয়েছে বলে জানিয়েছে লন্ডনভিত্তিক আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম বার্তা সংস্থা রয়টার্স। বাংলাদেশি মুদ্রায় এর পরিমাণ প্রায় ৫৪ কোটি ৭৪ লাখ টাকা। দুই সোমালি জলদস্যুর বরাতে গত রবিবার এ তথ্য জানায় রয়টার্স। এর আগে, মুক্তিপণ দিয়ে সোমালিয়ায় জিম্মি নাবিক ও জাহাজ মুক্ত করা হয়েছে, এমন তথ্য সঠিক নয় বলে জানিয়েছিলেন নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী। গতকাল সোমবার সচিবালয়ে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে প্রতিমন্ত্রী দাবি করেন, মুক্তিপণের বিষয়ে তার কাছে কোনও তথ্য নেই। তিনি বলেন, জলদস্যুদের ওপর প্রচণ্ড  চাপ ছিল।

ইউরোপীয় ইউনিয়নের উদ্ধারকারী জাহাজ ছিল তাদের থেকে দুই নটিকেল মাইল দূরে। একটা বহুমাত্রিক ব্যবস্থার মাধ্যমে এমভি আবদুল্লাহর ২৩ নাবিককে উদ্ধার করা হয়েছে। বহুমাত্রিক চাপের কারণে জলদস্যুরা নাবিকদের ছাড়তে বাধ্য হয়। আর কিছুদিন গেলে কী পরিণতি হতো, সেটা বুঝতে পেরেই জলদস্যুরা নাবিকদের ছাড়তে বাধ্য হয়েছে। কয়লা বোঝাই এমভি আবদুল্লাহ ছিনতাইয়ের ঘটনায় আর্মড গার্ড না থাকাকে অন্যতম কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন খালিদ মাহমুদ চৌধুরী। তিনি জানান, জলদস্যুদের কাছে খবর ছিল জাহাজে কোনো আর্মড গার্ড নেই। সেই সুযোগেই তারা জাহাজটি আটক করে। ২০২১ সাল পর্যন্ত ওই জাহাজে আর্মড গার্ড ছিলো। যদি এখনো আর্মড গার্ড থাকতো তাহলে হয়তো জলদস্যুরা এমন দুঃসাহস দেখাতো না বলেও উল্লেখ করেন নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী।

দুবাইয়ে পথে এমভি আবদুল্লাহ,পাহারায় স্পেন-ইতালির জাহাজ: ছিনতাইয়ের কবলে পরা এমভি আব্দুল্লাহ জাহাজের মালিক কোম্পানি কেএসআরএমের উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহরিয়ার জাহান রাহাত গতকাল সোমবার সংবাদ সম্মেলনে বলেন, বাংলাদেশি জাহাজ এমভি আব্দুল্লাহতে জলদস্যু ছিল ৬৫ জন। গত শনিবার মধ্যরাতে বোটে করে তারা চলে যায়। জাহাজটি এখন সংযুক্ত আরব আমিরাতে আসছে। তাদের পাশে রয়েছেন স্প্যানিশ নৌবাহিনীর নৌসেনারা। বর্তমানে আবদুল্লাহকে নিরাপত্তা দিয়ে দুবাইয়ের দিকে নিয়ে যাচ্ছে ইতালিয়ান নৌবাহিনীর একটি যুদ্ধজাহাজ। দুবাইয়ে নোঙর করার পর জাহাজের নাবিকরা ফ্লাইটে বা জাহাজে যেভাবে ইচ্ছা দেশে ফিরতে পারবেন।’  তিনি আরও বলেন, আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি ধন্যবাদ জানাতে চাই। বিদেশি যুদ্ধজাহাজ ফোর্সফুলি জাহাজটি উদ্ধারে যেতে চেয়েছিল। আমাদের সরকার কুইক রেসপন্স করেছে। সাংবাদিকরা সহযোগিতা করেছেন।

সংবাদ সম্মেলনে কেএসআরএম-এর সিইও মেহেরুল করিম বলেন, জাহাজ দখলে নেয়ার পর আমরা লোকেশন ট্রেস করতে থাকি। যোগাযোগ শুরুর পর প্রতিদিনই কথা হচ্ছিল। নাবিকরা কেমন আছে, কত তাড়াতাড়ি দস্যুরা জাহাজ ছেড়ে যাবে ইত্যাদি কথা হতো।’ তিনি আরও জানান, দুই দিন আগে আমাদের দাবি ছিল, তাই প্রত্যেক নাবিকের ভিডিও নিয়েছি। মুক্তিপণের প্রতিটি কাজ আইনগতভাবে করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক নিয়ম মেনে করা হয়েছে। কত ডলার সে বিষয়টি আমরা নানা কারণে বলতে পারছি না। ইউএসএ, ইউকে, সোমালিয়া, কেনিয়ার নিয়ম মানতে হয়েছে।

এমভি আবদুল্লাহর নাবিকদের মুক্তিপণ ৫০ লাখ ডলার!: মুক্তিপণ দিয়ে সোমালি জলদস্যুদের কবল থেকে একমাস পর মুক্ত হলেন কেএসআরএম গ্রæপের এসআর শিপিং কোম্পানির জাহাজ এমভি আবদুল্লাহ ও ২৩ নাবিক। তারা এখন সংযুক্ত আরব আমিরাতের পথে। সবাই অক্ষত আছে বলে জানিয়েছে মালিকপক্ষ। তবে মুক্তিপণের টাকার অঙ্ক নিয়ে মুখ খুলছে না জাহাজের মালিকপক্ষ। কেউ বলছে ৫০ লাখ ডলারে জিম্মিদের ছেড়ে দিয়েছে দস্যুরা। কেউ বলছে, টাকার অঙ্ক আরও কম হবে।

সোমালিয়ার স্থানীয় সংবাদমাধ্যম পান্টল্যান্ড মিররের প্রতিবেদনে মুক্তিপণের পরিমাণ ৫০ লাখ ডলার বলে উল্লেখ করা হয়েছে। বাংলাদেশি মুদ্রায় যা প্রায় ৫৫ কোটি টাকা। এ সংবাদটিকে তারা ব্রেকিং নিউজ হিসেবে প্রচার করেছে। মালিকপক্ষের আরেকটি সূত্র মুক্তিপণ বাবদ দেয়া টাকার অঙ্ক আরও কম বলে উল্লেখ করেছে। বার্তা সংস্থা রয়টার্স সংশ্লিষ্ট দুজন জলদস্যুর বরাত দিয়ে জানিয়েছে, ৫০ লাখ ডলার মুক্তিপণ দিয়ে এমভি আবদুল্লাহ ও ২৩ নাবিককে মুক্ত করা হয়েছে। রয়টার্সের প্রতিবেদনে আব্দিরশিদ ইউসুফ নামে এক দস্যুর বরাত দিয়ে জানানো হয়, ‘দুই রাত আগে আমাদের কাছে টাকা পৌঁছানো হয়। আমরা টাকাগুলো জাল কি না তা যাচাই করেছি। এরপর সরকারি বাহিনীর নজর এড়িয়ে আমাদের গ্রæপগুলোর মধ্যে টাকা বণ্টন করা হয়েছে।’

৫৫ কোটি টাকা মুক্তিপণ দেয়ার বিষয়ে সোমালি সংবাদমাধ্যমের তথ্য উদ্ধৃত করে প্রশ্ন রাখলে জাহাজ মালিকপক্ষের মিডিয়া উপদেষ্টা মো. মিজানুল ইসলাম বলেন, মুক্তিপণের বিষয়ে কোনো কিছু বলার নেই। মুক্তিপণের বিষয়টি কৌশলগত কারণে আমরা বলতে পারব না। আমাদের নাবিকেরা মুক্ত হয়েছেন, এটাই সবচেয়ে বড় কথা।’ তবে তুলনামূলক কম সময়ে জিম্মি জাহাজ ও নাবিক উদ্ধারের বিষয়টিকে বড় অর্জন হিসেবেই দেখছেন সংশ্লিষ্টরা। কারণ, সাধারণ বড় জাহাজ ও বড় ধরনের মুক্তিপণের বিষয়ে লম্বা সময় দেনদরবার করতে হয়। এতে চার মাস আবার বা ৬ থেকে ৯ মাস পর্যন্ত সময় লাগে। দীর্ঘসূত্রতার কবলে পড়ে অনেক সময় জাহাজ পরিত্যক্ত হয়। এমভি আবদুল্লাহর ক্ষেত্রে মাত্র ৩৩ দিনে মুক্তি মিলেছে। 

উচ্ছ্বসিত এমভি আবদুল্লাহর নাবিকরা, পরিবারে খুশির বন্যা: আমাদের আনোয়ারা প্রতিনিধি জানান, মুক্তির পর উচ্ছ¡সিত এমভি আবদুল্লাহ জাহাজের নাবিকরা। জাহাজে থাকা নাবিকরা একসঙ্গে হাস্যোজ্জ্বল ছবি তুলে পাঠিয়েছেন স্বজনদের কাছে। এদিকে দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর অক্ষত অবস্থায় নাবিকদের মুক্তিতে তাদের পরিবারে বইছে খুশির বন্যা। চট্টগ্রামের কর্ণফুলী এলাকার নাবিক মোহাম্মদ নুর উদ্দিনের স্ত্রী জান্নাতুল ফেরদৌস বলেন, ‘এই দিনগুলো কীভাবে কেটেছে জানি না! আড়াই বছরের ছেলেকে নিয়ে ঈদের আনন্দের দিন ছিল বিষাদে ভরা। আজ যেন আমাদের খুশির ঈদ। কেএসআরএম গ্রæপের প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। তারা তাদের অঙ্গীকার রক্ষা করেছে।’ 

এমভি আবদুল্লাহর ২৩ জন নাবিকের মধ্যে নূর উদ্দিন (জিএস) কর্ণফুলী উপজেলার বড়উঠান ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের আমিন শরীফের ছেলে। তার সংসারে স্ত্রী ও চার বছরের এক পুত্রসন্তান রয়েছে। চট্টগ্রামের আনোয়ারার মোহাম্মদ সামসুদ্দিন শিমুল (ওয়েলার) বৈরাগ ইউনিয়নের উত্তর বন্দর এলাকার মৃত আইয়ুব আলীর ছেলে। তার সংসারে মা, স্ত্রী ও দুই কন্যাসন্তান রয়েছে। একই এলাকার সাজ্জাদ হোসেন (এবি) গাজু মিয়ার ছেলে। আসিফুর রহমান (এবি) বৈরাগ ইউনিয়নের উত্তর বন্দর মেরিন একাডেমি এলাকায়। তার বাবার নাম মোহাম্মদ আখতার হোসেন। তিনি পাঁচ মাস আগে চাকরিতে যোগ দেন। 

এর আগে গত শনিবার সোমালিয়ার সময় রাত ১২টা (বাংলাদেশ সময় রাত ৩টায়) এমভি আবদুল্লাহ জাহাজ থেকে একে একে নেমে যায় সব দস্যু। জাহাজটিতে ছিল ৬৫ জন দস্যু। তারা নেমে নৌকায় চলে যায়। এদিকে, নাবিকদের মুক্তির জন্য সোমালিয়ান জলদস্যুদের ডলারভর্তি ব্যাগ একটি এয়ারক্রাফট থেকে ফেলার দৃশ্যের ভিডিও বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। দস্যুরা ডলারভর্তি ব্যাগ পেয়ে খুশিতে চিৎকার করতে থাকে। এরপরই নাবিকদের মুক্তি দেয়া হয়। 

মুক্তির পর চিকিৎসাসহ প্রয়োজনীয় ওষুধ পেয়েছে এমভি আবদুল্লাহ জাহাজের নাবিকরা। পাশাপাশি জাহাজে রেখে যাওয়া জলদস্যুদের হাতের ছাপ, ফেলে যাওয়া কাপড় আর ব্যবহার্য সামগ্রী ইত্যাদির নমুনা সংগ্রহ করেন নৌবাহিনীর একটি টিম। এমনটাই জানিয়েছেন সমুদ্রগামী জাহাজের নাবিক আতিক ইউ এ খান।

তিনি জানান, বাংলাদেশ সময় রাত ৩টায় নোঙর তুলে দুবাইয়ের উদ্দেশে রওনা হয় এমভি আবদুল্লাহ জাহাজসহ নাবিকরা। রওনা হওয়ার পর সোমালিয়ার জলসীমা থেকে বের হতেই ভোর ৫টার দিকে ন্যাটোর দুটি ফ্রিগেট, ইতালি আর স্পেনের দুটি যুদ্ধজাহাজ এমভি আবদুল্লাহকে থামায়।  

উল্লেখ্য, গত ১২ মার্চ মোজাম্বিক থেকে সংযুক্ত আরব আমিরাত যাওয়ার পথে কয়লা বোঝাই বাংলাদেশি জাহাজ এমভি আবদুল্লাহ ছিনতাই করে সোমালি জলদস্যুরা। এ সময় জাহাজটিতে থাকা ২৩ বাংলাদেশি নাবিককে জিম্মি করে তারা। সোমালিয়ার রাজধানী মোগাদিসু থেকে প্রায় ৬০০ নটিক্যাল মাইল পূর্বে ঘটে এ ছিনতাইয়ের ঘটনা। নাবিকদের উদ্ধারে নানা চেষ্টা করা হয়। চলে ক‚টনৈতিক তৎপরতা। কিন্তু অগ্রগতি আসতে সময় লাগছিল। ঘটনার পরপরই জাহাজটি উদ্ধারে যায় ভারতীয় নৌবাহিনীর জাহাজ। এমনকি জাহাজটির জিম্মি নাবিকদের ঈদও কাটে বন্দী দশায়। তবে তাদের ঈদের দিন ভালো খাবার দেয়া হয় বলে খবর পাওয়া গিয়েছিল। অবশেষে বাংলা নববর্ষের দিন রবিবার সুখবর আসে। এর আগে জিম্মি করার ৯ দিন পর দস্যুরা যোগাযোগ করে মুক্তিপণ দাবি করে। ১৪ বছর আগে একই মালিকের আরেকটি জাহাজ এমভি জাহান মণিকেও একইভাবে মুক্ত করে কেএসআরএম গ্রুপ।

মানবকণ্ঠ/এআই