Image description

দলীয় প্রতীকে নির্বাচন করার সুযোগ থাকলেও আসন্ন ষষ্ঠ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে বড় কোনো রাজনৈতিক দলই দলীয় প্রতীকের প্রার্থী মনোনয়ন দিচ্ছে না। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ, দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে থাকা অন্যতম বড় দল বিএনপি এবং নির্বাচন কমিশনের দেয়া দাঁড়িপাল্লা প্রতীক হারানো জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থীরা দলের নেতাদের সঙ্গে নিয়ে মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন স্বতন্ত্র ব্যানার নিয়েই। অবশ্য সংসদে প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টিই (জাপা) একমাত্র দলীয় প্রতীকে নির্বাচনের ঘোষণা দিয়েছে।

ঈদুল ফিতরের আমেজ ফুরানোর আগেই প্রথম ধাপের ভোটকে ঘিরে মাঠে বেজে উঠেছে নির্বাচনী ডামাডোল। নৌকা, ধান কিংবা অন্য কোনো দলীয় প্রতীকের প্রচারণা না থাকায় নির্বাচন অনেকটা ঠাণ্ডা মনে হলেও ভোট ঘিরে তৃণমূলে রাজনীতি অনেকটাই চাঙ্গা হয়ে উঠেছে।

নর্বাচন কমিশন (ইসি) জানিয়েছে, গতকাল সোমবার প্রথম ধাপের নির্বাচনের মনোনয়নপত্র দাখিলের শেষদিনে এক হাজার ৮৯১ জন প্রার্থী মনোনয়নপত্র দাখিল করেছেন। এতে চেয়ারম্যান পদে ৬৯৬ জন, ভাইস চেয়ারম্যান পদে ৭২৪ জন ও মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে ৪৭১ জন প্রার্থী মনোনয়নপত্র দাখিল করেছেন।

ইসির অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ জানান, এবার সম্পূর্ণ অনলাইনে মনোনয়নপত্র জমা নেয়া হয়েছে। এ ধাপের নির্বাচনে রিটার্নিং কর্মকর্তা হিসেবে জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা ও সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা হিসেবে উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তাদের নিয়োগ করা হয়েছে। রিটার্নিং কর্মকর্তার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে দায়ের করা আপিল আবেদন নিষ্পত্তি করবেন আপিল কর্তৃপক্ষ হিসেবে জেলা প্রশাসক। নির্বাচন কমিশন ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী, প্রথম ধাপের মনোনয়নপত্র বাছাই ১৭ এপ্রিল। রিটার্নিং কর্মকর্তার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আপিল ১৮ থেকে ২০ এপ্রিল। আপিল নিষ্পত্তি ২১ এপ্রিল, প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ সময় ২২ এপ্রিল। প্রতীক বরাদ্দ ২৩ এপ্রিল, আর ১৫০ উপজেলায় ভোটগ্রহণ হবে ৮ মে। 

নির্বাচন ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ঈদের ছুটির পর পরই সারাদেশে শুরু হয়ে গেছে উপজেলা নির্বাচনের আমেজ। অনুষ্ঠানিক প্রচারণা শুরু না হলেও ঈদের মধ্যেই উপজেলা নির্বাচন নিয়ে উৎসাহী প্রার্থীরা প্রচার প্রচারণা শুরু করে দিয়েছেন। ঈদে তারা জনসংযোগ করে জনগণের কাছাকাছি যাওয়ার চেষ্টা করেছেন। তারা বলছেন, এই উপজেলা নির্বাচনকে ঘিরে রাজনীতিতে একটি নতুন মেরুকরণ তৈরি হতে যাচ্ছে। কোনো দলীয় প্রতীক না থাকলেও নির্বাচনে সব দলই মাঠে থাকছে। এমনকি সব নির্বাচন বয়কট করা বিএনপিও উপজেলার ভোট ঘিরে কৌশলী অবস্থান নিয়েছে। যে কারণে আগামী ঈদুল আজহা পর্যন্ত উপজেলা নির্বাচন নিয়েই রাজনীতির মাঠ ব্যস্ত থাকবে বলে মনে করছেন তারা।

আওয়ামী লীগ: এবারের উপজেলা নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ দলীয় প্রতীক ব্যবহার করছে না। নির্বাচনে দলটির যারা প্রার্থী হতে ইচ্ছুক তারা স্ব-উদ্যোগে এবং স্বতন্ত্রভাবে প্রার্থী হচ্ছেন। এর ফলে আওয়ামী লীগের মধ্যে বিভক্তি কমবে বলে আশা করা হয়েছিল এবং সেরকম আশাবাদ থেকে আওয়ামী লীগ উপজেলা নির্বাচনে দলীয় প্রতীক ব্যবহার না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। কিন্তু এখন পরিস্থিতি অন্যরকম হয়ে গেছে বলেই ধারণা করা হচ্ছে। আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের একটি ‘ফ্রি স্টাইল’ প্রতিযোগিতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। প্রতিটি উপজেলায় আওয়ামী লীগের ৫-৭ জন, কোথাও কোথাও ১০ জন পর্যন্ত প্রার্থীকে মাঠে দেখা যাচ্ছে। এটি আওয়ামী লীগের জন্য অশনিসংকেত বলেই অনেকে মনে করছেন। যদিও দলটির পক্ষ থেকে মন্ত্রী এবং এমপিদেরকে উপজেলা নির্বাচন থেকে দূরে থাকার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। কেউ যেন কোন প্রার্থীকে সমর্থন না দেয়, সেরকম বক্তব্য দেয়া হয়েছে। কিন্তু সেসব বক্তব্য কেউ শুনছেন না। মন্ত্রী-এমপিরা তাদের নিজস্ব ব্যক্তিকে মনোনয়ন দিয়েছেন এবং উপজেলা নির্বাচনকে ঘিরে আওয়ামী লীগের ভেতরেই একটি সংঘাতময় পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।

বিএনপি: উপজেলা নির্বাচন নিয়ে বিএনপি এক রহস্যময় অবস্থান তৈরি করেছে। যদিও অন্তত ২শটি উপজেলায় বিএনপির স্থানীয় পর্যায়ের নেতাদেরকে উপজেলা নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে দেখা যাচ্ছে এবং তারা জনসংযোগও শুরু করেছেন। উপজেলা নির্বাচন নিয়ে বিএনপির হাই কমান্ড কৌশলগত অবস্থান গ্রহণ করেছেন। তারা আনুষ্ঠানিকভাবে উপজেলা নির্বাচন বর্জন বা অংশগ্রহণ কোনো কিছুই বলছেন না। বরং যারা যারা অংশগ্রহণ করছেন তারা স্বতন্ত্র হয়ে অংশগ্রহণ করলে দলগতভাবে বিষয়টিকে উপেক্ষা করার নীতি গ্রহণ করা হয়েছে। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সাম্প্রতিক বক্তব্যে বিষয়টি আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। ঈদের ছুটিতে নিজের এলাকা ঠাকুরগাঁওয়ে গিয়ে স্থানীয় নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে তিনি পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছেন, উপজেলা নির্বাচনের ব্যাপারে বিএনপি হ্যাঁ, না কোন সিদ্ধান্তই গ্রহণ করেনি। তবে আওয়ামী লীগের মতো বিএনপি নেতারা উপজেলা নির্বাচনে ‘ফ্রি স্টাইলে’ অংশগ্রহণ করছে না। যেসব উপজেলায় বিএনপি অংশগ্রহণ করছে কিংবা বিএনপির প্রার্থীদেরকে প্রচারণায় দেখা যাচ্ছে সেসব এলাকায় একক প্রার্থী দেখা যাচ্ছে। ফলে এই স্থানীয় নির্বাচনে বিএনপি একটি বড় ধরনের চমক দেখাতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

জাতীয় পার্টি: জাতীয় পার্টি একমাত্র রাজনৈতিক দল যারা উপজেলা নির্বাচনে দলীয় প্রতীক নিয়ে অংশগ্রহণ করছে। তবে ক্ষয়িষ্ণু জাতীয় পার্টি উপজেলা নির্বাচনে খুব একটা বড় ধরনের প্রভাব ফেলতে পারবে বলে মনে হয় না। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, কয়েকটি পকেট ছাড়া জাতীয় পার্টি অধিকাংশ স্থানেই এখন নেই বললেই চলে। রংপুর, সিলেটের মতো কয়েকটি অঞ্চলে হয়তো জাতীয় পার্টি কিছু প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়ে তুলতে পারবে। তবে রাজনৈতিক দল হিসেবে সারা দেশে প্রভাব রাখার মতো অবস্থানে দলটি নেই। 

জামায়াত: এবার জামায়াত উপজেলা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছে। বেশ সংঘবদ্ধভাবে এবং পরিকল্পিতভাবে। তারা ঢালাওভাবে সব উপজেলায় অংশগ্রহণ না করে যেখানে যেখানে তাদের শক্ত ভিত্তি রয়েছে সে উপজেলাগুলোকে বেছে নিয়েছে। এরকম প্রায় একশ’ উপজেলায় জামায়াত অংশগ্রহণ করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। জানা গেছে, এই উপজেলা নির্বাচনের মাধ্যমে জামায়াত তার রাজনৈতিক শক্তি প্রমাণ করতে চায়। তাই এবারের নির্বাচনকে তারা চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছে। 

এ বিষয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল সম্প্রতি সাংবাদিকদের বলেন, ‘শুনতে পাচ্ছি আসন্ন উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে দলীয় প্রতীক দেয়া হবে না। এটা ভালো সিদ্ধান্ত নিয়েছে রাজনৈতিক দলগুলো। এবার ভোটাররা কেন্দ্রমুখী হবেন বেশি।’

তিনি উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে রাজনৈতিক দলের বাইরে স্থানীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের ভোট করার আহবান জানিয়ে বলেন, ‘এ নির্বাচনে প্রার্থীদের সঙ্গে ভোটারদের যোগাযোগ বেশি থাকে। সম্পর্কের বিষয় থাকে। তাই এই নির্বাচনে মানুষ ভোট দেয়ার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকে।’

দেশে প্রথমবারের মতো উপজেলা পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৮৫ সালে। এর পর ১৯৯০ সালে দ্বিতীয়বার ও ২০০৯ সালে তৃতীয়বার, ২০১৪ সালে চতুর্থবার এবং ২০১৯ সালে পঞ্চমবার উপজেলা পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এবার হচ্ছে ষষ্ঠ উপজেলা পরিষদ নির্বাচন। 

বিদ্যমান আইন অনুযায়ী, উপজেলা পরিষদের মেয়াদ শুরু হয় প্রথম সভার দিন থেকে। পরবর্তী পাঁচ বছর নির্বাচিত পরিষদ দায়িত্ব পালন করে। আর মেয়াদপূর্তির আগের ১৮০ দিনের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। সে অনুসারে এবার ৮ মে থেকে ২৫ মে’র মধ্যে চার ধাপে উপজেলা পরিষদ নির্বাচন হচ্ছে।

মানবকণ্ঠ/এআই