Image description

ছোট ও মাঝারি সাইজের ২০টি গরু নিয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে রাজধানীর ধোলাইখাল ট্রাক টার্মিনাল হাটে এসেছেন বেপারি কালাম মিয়া। এর মধ্যে মঙ্গলবার দুপুর সাড়ে ১২টায় ৩ মণ ওজনের একটি গরু বিক্রি করেন ১ লাখ ১০ হাজার টাকায়।

গরুটি বিক্রি করতে পেরে তার চোখেমুখে ছিল প্রশান্তি ছাপ। আর ২ দিনের প্রচেষ্টায় নিজের বাজেট মতো গরু কিনতে পেরেও মহাখুশি কেরানীগঞ্জের বাসিন্দা সানা উল্লাহ। কালাম বেপারি জানান, আমি ৫ দিন আগে এখানে ২০টি গরু নিয়ে এসেছি, তার মধ্য ১৩ বিক্রি হয়েছে। আশা করছি সামনে যে সময় আছে তাতে সব গরু ভালো দামে বিক্রি করতে পারব। এ হাটে তাদের মতো অন্তত ১২ জন ক্রেতা-বিক্রেতা জানিয়েছেন, বড় গরুর চেয়ে ছোট ও মাঝারি মানের গরু বেশি কেনাবেচা হচ্ছে। আর বড় গরুর সংখ্যা বেশি হলেও এগুলোর ক্রেতা তুলনামূলক কম। এ অবস্থায় শেষদিনের আশায় দড়ি ধরে আছেন বিক্রেতারা।


শুধু এ হাটে নয়, মঙ্গলবার সকাল থেকে রাত পর্যন্ত ঢাকার ধোলাইখাল ট্রাক টার্মিনাল, খিলগাঁও রেলগেট বাজার, কমলাপুর, আফতাবনগর, রহমতগঞ্জ, দিয়াবাড়ী, গাবতলী পশুর হাট, মোহাম্মদপুর বছিলাসহ অন্যান্য হাট ঘুরে একই চিত্র দেখা গেছে। এসব পশুর হাটে  মাঝারি ও ছোট আকারের গরুতে দর কষাকষিতে করতে দেখা গেছে। আর দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে ট্রাকে করে গরু, ছাগল, মহিষ নিয়ে এসেছেন ব্যবসায়ীরা। তবে হাটগুলো জমে উঠলেও কর্দমাক্ত হাটে ক্রেতা-বিক্রেতাদের চরম  বিপাকে পড়তে দেখা গেছে। অনেক হাটে বৃষ্টির পানি জমে আছে। হেঁটে চলাফেরা করা দায় হয়ে পড়েছে। গরুর গোবর, ময়লা-আর্বজনা কাদা-পানিতে জমে একাকার অবস্থা। শুধু মানুষ নয়, চরম দুর্ভোগে পড়েছে অবলা পশুগুলোও। ফলে লোকসানের আশঙ্কা করছেন ব্যবসায়ীরা।

রাজধানীর দুই সিটি করপোরেশন এলাকায় বসা ১৯টি হাটের প্রায় সবটিতেই বিপুলসংখ্যক গবাদিপশুর সমাগম হয়েছে। তবে বিক্রেতা এবং ক্রেতারা দরদামেই আটকে থাকছেন। বিক্রেতারা জানিয়েছেন, বাজারে প্রচুর গরু। সেই তুলনায় বিক্রি কিছুটা কম। আর পশু পালনের খরচ, বিশেষত গো-খাদ্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে দাম বেশি চাওয়া হচ্ছে। গাড়ি ভাড়া, কর্মীদের বেতনসহ অনেক খরচ আছে। খুব বেশি লাভ হয় না।


ক্রেতারা জানিয়েছেন, বাজারে ছোট ও মাঝারি এবং বড় সাইজের প্রচুর গরু আছে। কিন্তু  দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিসহ নানা কারণে বাজেটের মধ্যে সমন্বয় রেখে ছোট ও মাঝারি গরুর প্রতি তাদের আগ্রহ বেশি এবং বড় গরুর দিকে ঝোঁক কম।

মঙ্গলবার ঢাকার ধোলাইখাল ট্রাক টার্মিনাল ঘুরে দেখা গেছে, সকাল থেকে কখনো অঝোর ধারায়, আবার কখনো গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি। তাই বিক্রেতাদের জন্য মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা হয়ে দেখা দিয়েছে। তবে বৃষ্টি কমে আসার সঙ্গে সঙ্গে ক্রেতার সংখ্যাও বেড়েছে।


এ হাটে জামালপুরের সুরত আলী ৭টি গরু নিয়ে এসেছেন। তিনি জানান, আমার একটি ১০ মণ ওজনের গরু দাম চাচ্ছি ৫ লাখ টাকা কিন্তু এখন পর্যন্ত দাম উঠেছে তিন লাখ টাকা। এভাবে দাম বললে তো বিক্রি করা সম্ভব নয়। এত কম দামে বিক্রি করলে লাভ তো দূরের কথা পুরোটাই লোকসান দিতে হবে। তাই শেষ দিনের আশায় আছি।

নূর জাহান এগ্রোর মালিক মো. রিপন মিয়া জানান, আমি ২০টি গরু এনেছি। এখন পর্যন্ত তিনটি গরু বিক্রি হয়েছে। বাজারে প্রচুর গরু আছে। ক্রেতারা কম-বেশি এলেও যে দাম বলছে তাতে খরচই উঠবে না। এ সময় তিনি একটি মাঝারি সাইজের গরুর দেখিয়ে বলেন, এটির দাম চাচ্ছি  ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা। কিন্তু সর্বোচ্চ উঠেছে ১ লাখ ৩০ হাজার।  

বৃষ্টির মধ্যে এ হাটে গরু কিনতে আসা ক্রেতাদের চরম দুর্ভোগ  পোহাতে দেখা গেছে। পোস্তগোলার বাসিন্দা সোহাগ মিয়া বলেন, গতবারের তুলনায় এবার গরুর দাম ৩০ হাজার টাকা থেকে ৫০ হাজার টাকা বেশি হাঁকা হচ্ছে। বৃষ্টির জন্য ক্রেতা-বিক্রেতাদের ভোগান্তির কথা স্বীকার করে এ হাটের ইজাদারের প্রতিনিধি সানি হোসেন বলেন, বৃষ্টির ওপর কারও হাত নেই। তবে ক্রেতা-বিক্রেতাদের   নিরাপত্তার জন্য ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।

সরেজমিন কমলাপুর পশুর হাটে ঘুরে দেখা গেছে, ছোট-বড় সব ধরনের পশু রয়েছে এ হাটে। তবে ছোট ও মাঝারি সাইজের গরুর চাহিদা বেশি। ক্রেতারা বলছেন, ব্যবসায়ীরা গরুর দাম দ্বিগুণ হাঁকাচ্ছেন। 

সকাল থেকে বৃষ্টি হওয়ায় পুরো এলাকা কাদায় পরিপূর্ণ হয়েছে। গরুর গোবর আর বৃষ্টির পানি মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। কিছু কিছু গরুর ওপরে ছাউনি থাকলেও অনেক গরুর ওপরই ছাউনি নেই। এ অবস্থায় ক্রেতা-বিক্রেতা অনেকেই বাধ্য হয়ে কাদায় পা ফেলছেন। কখনো কখনো সেই কাদা এসে লাগছে তাদের কাপড়ে।


এ হাটে কথা হয়, কুষ্টিয়ার গরু বেপারি লিহাজ উদ্দিনের সঙ্গে। তিনি বলেন, ৫ দিন আগে ১৭টি গরু নিয়ে এসেছি। আমার ছোট-বড় সব ধরনের গরুই আছে। মাত্র ৩টি বিক্রি করেছি।

 এ হাটে গরু কিনতে আসা টিকাটুলির বাসিন্দা সানি হোসেন বলেন, ঈদে সবারই খরচ বেশি। তাই গরু কিনতে নিদিষ্ট একটি বাজেট আছে। সেই প্রত্যাশা অনুযায়ী গত ২ দিন ধরে হাটে এসে গরু কিনতে পাচ্ছি না। ব্যবসায়ীরা খুব বেশি দাম হাঁকাচ্ছে।

খিলগাঁও রেলগেট পশুর হাটেও বৃষ্টির কারণে ক্রেতা-বিক্রেতাদের চরম দুর্ভোগ  পোহাতে দেখা গেছে। এ হাটে ছেলে তালহাকে নিয়ে গরু কিনতে এসেছেন শাহজাহানপুরের বাসিন্দা আবদুস সোবহান। তারা দুজনে বৃষ্টির কাদাপানি থেকে নিজেদের রক্ষা করতে হাঁটু পর্যন্ত কালো গামবুট পরে এসেছেন।

আবদুস সোবহান জানান, ইচ্ছা ছিল বড় সাইজের গরু কেনার কিন্তু দামে বনিবনা হচ্ছে না। একটা ১১ মণ ওজনের গরুর দাম চাচ্ছে ৭ লাখ টাকা। এত দাম দিয়ে গরু কেনা সম্ভব না। তাই  ১ লাখ ৯০ হাজার টাকা দিয়ে মাঝারি সাইজের গরু কিনেছি।  

এ হাটে পাবনা থেকে মাঝারি ও ছোট আকারের ২১টি গরু এই হাটে এনেছেন ব্যবসায়ী বদু মিয়া। তিনি বলেন, আমার গরুগুলোর দাম চাইছি ১ লাখ থেকে ২ লাখ টাকার মধ্যে কিন্তু  ক্রেতারা ছোট গরু বলছে ৬০ থেকে ৮০ হাজার টাকা। আর মাঝারি মানের গরুর দাম বলেছে ১ লাখ ২০ থেকে ৪০ হাজার টাকা। তাই বিক্রি করছি না। তবে আশা করছি শেষ দিনে সব বিক্রি হয়ে যাবে।

হাটের সার্বিক ব্যবস্থা নিয়ে কমলাপুর পশুর হাটের সমন্বয়ক  বিএম  সিরাজুল ইসলাম সময়ের আলোকে বলেন, বৃষ্টির জন্য সমস্যা হলেও জমজমাট কেনাবেচা হচ্ছে। আশা করছি শেষ সময় পর্যন্ত তা অব্যাহত থাকবে।

রহমতগঞ্জ, সারুলিয়া ও আফতাবনগর হাটে দেখা গেছে, বৃষ্টির মধ্যেও হাটগুলো জমে উঠলেও ক্রেতা-বিক্রেতারাও পড়েছেন বিপাকে। হাটের সীমানা ছাপিয়ে গরু চলে গেছে অনেক দূর। সেখানে হাঁটার রাস্তায়ও পানি জমে গেছে। শুধু তাই নয়, এ অবস্থায় পশুর দামও কমে গেছে। ফলে লোকসানের আশঙ্কা করছেন ব্যবসায়ীরা।

মেহেরপুর থেকে আফতাবনগরে কাসেম হোসেন নামে এক বেপারি বলেন, বৃষ্টির কারণে ওপরের তাঁবুও কোনো কাজে আসছে না। মানুষ ও গরু সবাই ভিজছে। দাঁড়িয়ে থাকতেও সমস্যা হচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে গরুর দাম যে পড়ে যাবে বলেও শঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি। বিকাল ৪টা, গাবতলীর পশুর হাটে ক্রেতা ও বিক্রেতাদের ভিড়ে তিল ধারণের ঠাঁই নেই। বিক্রেতারা ব্যস্ত সময় পার করছেন, ক্রেতারাও পছন্দের পশুর খোঁজে হাটে ঘুরাফেরা করছেন। ক্রেতা ও বিক্রেতার দরদামে জমে উঠেছে হাট।


কুষ্টিয়া কুমার খালী থেকে ১৬টি গরু নিয়ে গাবতলী হাটে এসেছেন মাজিদুল ইসলাম (৩৯)। তিনি সময়ের আলোকে বলেন, আজকে একটু বেচাবিক্রি বেশি হয়েছে, আর  মাত্র দুটি গরু আছে, এই দুটি বিক্রি হলে আজকেই বাড়িতে চলে যাব।

মানিকগঞ্জ থেকে ৭৫টি গুরু নিয়ে আসা আহসান হাবিব বলেন, অন্যদিনের তুলনায় আজকে ক্রেতার সমাগম বেড়েছে, তবে তেমন বেচাবিক্রি নেই। মাত্র ১০টি বিক্রি করেছি। ক্রেতারা দাম অনেক কম বলায় গরু বিক্রি করতে পারছি না।

রাজধানীর মিরপুর থেকে ছেলেমেয়েকে সঙ্গে করে কুরবানি পশু কিনতে এসেছেন সাইদুল ইসলাম (৪৫)। তিনি সময়ের আলোকে বলেন, দুপুর থেকে ঘুরছি, এবার হাটে অনেক গরু এসেছে কিন্তু দাম বেশি বলায় এখনও কিনতে পারেনি। গতবারের চেয়ে প্রতিটি গরুর দাম ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকা বেশি।

গত ২ দিনের তুলনায় মঙ্গলবার গাবতলীর পশুর হাটে কেনাবেচা বেড়েছে। তবে বিক্রেতার বলছেন, বড় গরুর তেমন চাহিদা নেই, ছোট ও মাঝারি সাইজের গরুই বেশি বিক্রি হচ্ছে।

শুক্রবার থেকে মোহাম্মদপুরের বছিলার হাটে কুরবানির পশু আসা শুরু হয়। দুপুরে সরেজমিন দেখা যায়, অন্যদিনের তুলনায় কুরবানির পশুর সংখ্যা অনেক বেশি।

মোহাম্মদপুর থেকে বছিলা হাটে কুরবানির পশু কিনতে এসেছেন শরিফুল ইসলাম। তিনি বলেন, গরু কেনার জন্য ২দিন আগেও হাটে এসেছিলাম, তখন গরুর সংখ্যা একটু কম ছিল, বিক্রেতারাও দাম বেশি বলছিল। আজকে গরুর সংখ্যা একটু বেশি।  ঈদের এক দিন আগে সামর্থ্যরে মধ্যে পছন্দমতো একটা গরু কিনতে পেরে ভালো লাগছে।

মানিকগঞ্জের সড়াইল থেকে বছিলা হাটে ২০টি গরু নিয়ে এসেছেন রহিম বেপারি (৪৩)। তিনি বলেন, গত ২ দিন ক্রেতারা আসছেন, দাম-দর করে চলে গেছেন। আজকে কেনাবেচা বেশ জমে উঠেছে। সকালে বৃষ্টির জন্য কেনাবেচা করতে একটু অসুবিধা হয়েছে, তারপরও এখন পর্যন্ত আমার ৭টি গরু বিক্রি হয়েছে। আশা করছি ঈদের আগেই সব গরু বিক্রি হয়ে যাবে।

উত্তরা উত্তর মেট্রোরেল স্টেশনের সামনে খোলা মাঠেই বসেছে এবারের কুরবানির পশুর হাট। মঙ্গলবার সকাল থেকেই ক্রেতা ও বিক্রেতাদের সমাগম দেখা যায় এই হাটে।  

রাজধানীর পল্লবী থেকে কুরবানির পশু কিনতে আসা  সিরাজুল ইসলাম সময়ের আলোকে বলেন, আজকে বেপারিরা পশু ছাড়ছে। গত ২ দিন দামদর করে গরু কিনতে পারেনি। দরদামে মিলে যাওয়ায় আজকে গরু কিনতে পারলাম।

দিয়াবাড়ী পশুর হাটের ২৫টি গরু নিয়ে এসেছেন লালু  বেপারি। তিনি বলেন, ঈদের আর এক দিন বাকি। লাভ-লস যাই হোক গরু বিক্রি করতে হবে। আজকে হাটে ক্রেতাদের সমাগম বেশি। কেনাবেচাও ভালো হচ্ছে।