Image description

নিজের টাকায় নিজেদের পদ্মা সেতু আজ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে পদ্মার বুক চিরে। স্বপ্নের এই পদ্মা সেতুর পথচলার এক বছর পূর্ণ হলো আজ ২৫ জুন।

গত বছরের এই দিনে পদ্মা সেতুর উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেদিন প্রধানমন্ত্রী পদ্মা সেতুতে ১৬ হাজার ৪০০ টাকা টোল দিয়ে যান চলাচলের শুভযাত্রা শুরু করেছিলেন। এর মধ্যে নিজের গাড়ির জন্য ৭৫০ টাকা টোল দিয়েছিলেন তিনি। প্রধানমন্ত্রীর গাড়িবহরে সেদিন ১৮টি গাড়ি ছিল।


এর পর থেকে পদ্মা সেতু দিয়ে গত এক বছরে যানবাহন পারাপার হয়েছে ৫৩ লাখেরও বেশি। এসব যানবাহন পারাপারে টোল আদায় হয়েছে ৭৯৫ কোটি টাকারও বেশি। শুধু তাই নয়, এক বছরের মধ্যেই দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার বাসিন্দা পদ্মা সেতুর সুফল ঘরে তুলতে শুরু করেছেন। এই সেতুর কল্যাণে বাঁচছে সময়, বাঁচছে কর্মঘণ্টা, বাড়ছে বিনিয়োগ, বাড়ছে কর্মসংস্থান এবং যোগাযোগ খাতে এসেছে আমূল পরিবর্তন। তাই এই এক বছরে পদ্মা সেতুতে প্রত্যাশার চেয়েও প্রাপ্তি ঘটেছে অনেক বেশি।

সেতু বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের ২৫ জুন উদ্বোধনের পরদিন, ২৬ জুন ভোর ৬টা থেকে সাধারণ যানবাহন চলাচল শুর হয় পদ্মা সেতুতে। এই এক বছরে পদ্মা সেতু দিয়ে যানবাহন পারাপার হয়েছে ৫৩ লাখেরও বেশি। আর টোল আদায় হয়েছে ৭৯৫ কোটি টাকার বেশি। এই টোল থেকে প্রথম বছরের লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ৬৩২ কোটি ৯৩ লাখ ৬৬ হাজার ১৪২ টাকা ঋণ পরিশোধ করেছে সেতু বিভাগ। এ ছাড়া ১৫ শতাংশ হারে সরকারকে ভ্যাট দেওয়া হয়েছে ১২০ কোটি টাকা। অবশ্য উদ্বোধনের পর প্রায় ১০ মাস পর গত ২০ এপ্রিল থেকে পদ্মা সেতু দিয়ে মোটরসাইকেল পারাপারের অনুমতি দেওয়া হয়। সেতু বিভাগ সূত্রে আরও জানা যায়, এখন পর্যন্ত পদ্মা সেতুতে মোট ব্যয় হয়েছে ৩২ হাজার ৬০৫ কোটি ৫২ লাখ টাকা। মূল সেতুর দৈর্ঘ্য ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার এবং সেতুর মূল নির্মাণকাজ শুরু হয় ২০১৪ সালের ২৬ নভেম্বর।


এই এক বছরে পদ্মা সেতুর অর্জন সম্পর্কে সেতু বিভাগের সচিব মো. মনজুর হোসেন গতকাল শনিবার সময়ের আলোকে বলেন, পদ্মা সেতু দেশের জিডিপিতে ১ দশমিক ২৩ শতাংশ অবদান রাখার কথা। তবে মাত্র এক বছরে জিডিপিতে অবদানের চিত্র চোখে পড়বে না। আরও কয়েক বছর যাওয়ার পর এটি দৃশ্যমান হবে। সবচেয়ে বড় কথা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে সাহস নিয়ে দেশের টাকায় এই স্বপ্নের পদ্মা সেতু তৈরির উদ্যোগ নিয়েছিলেন এবং এটি বাস্তবে রূপ দিয়েছে-এটি অনেক বড় অর্জন। এর সুফল পেতে শুরু করেছেন দক্ষিণ-পশ্চিমানঞ্চলের মানুষসহ দেশের প্রায় সব এলাকার মানুষ। পদ্মা সেতুর কল্যাণে ওই অঞ্চলের আর্থ-সামাজিক দিক দিয়ে ব্যাপক উন্নতি হয়েছে। আগে ওইসব এলাকা থেকে কেউ ঢাকায় কোনো কাজ সারতে আসল কমপক্ষে দুই রাত ও এক দিন অবস্থান করতে হতো। অথচ এখন দিনে এসে কাজ সেরে দিনের মধ্যেই চলে যেতে পারছে। এটি যে কত বড় পাওয়া ওইসব এলাকার মানুষের সেটি বলে বোঝানো যাবে না। তা ছাড়া বাণিজ্য বেড়েছে, বাড়ছে বিনিয়োগ, পর্যটন খাতের ব্যাপক উন্নতি হয়েছে, জমির মূল্য বেড়েছে অনেক, যার সুফল পাচ্ছেন ওইসব এলাকার মানুষ। সুতরাং আমি মনে করি এই এক বছরে পদ্মা সেতুতে প্রত্যাশার চেয়েও প্রাপ্তি ঘটেছে অনেক বেশি।

পদ্মা সেতু অর্থনীতি ও জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে এবং কৃষি বিপ্লব ও কর্মসংস্থানেও ব্যাপক অবদান রাখছে বলে উল্লেখ করেছেন বিশ্লেষকরা। পদ্মা সেতুর মাধ্যমে রাজধানী ঢাকার সঙ্গে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চল, মংলা বন্দরের সরাসরি সড়ক যোগাযোগ তৈরি হয়েছে। রাজধানী এবং দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের মধ্যে যাতায়াতের সময় এক-চতুর্থাংশ কমে এসেছে। আগে যেখানে ১০ থেকে ১২ ঘণ্টা সময় লাগত দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোতে যেতে, সেখানে এখন যেতে সময় লাগছে আড়াই ঘণ্টা থেকে সর্বোচ্চ সাড়ে তিন ঘণ্টা। পদ্মা সেতুর কল্যাণে পর্যটন খাতেরও ব্যাপক উন্নয়ন ঘটেছে। প্রস্তাবিত এশিয়ান হাইওয়ের এবং ট্রান্স-এশিয়ান রেলওয়ে নেটওয়ার্কের অংশ হওয়ায় পদ্মা সেতু আঞ্চলিক সংযোগকে সহজতর করবে। নির্মাণ খাতে ২৯ শতাংশ, কৃষি খাতে ৯ দশমিক ৫ শতাংশ এবং উৎপাদন ও পরিবহনে ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধিতে অবদান রাখবে পদ্মা সেতু। 


পদ্মা সেতুর প্রভাবে এই অঞ্চলে দারিদ্র্য ১ শতাংশ কমবে এবং জাতীয়ভাবে কমবে শূন্য দশমিক ৮ শতাংশ। দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলে ১ দশমিক ২৩ শতাংশ এবং জাতীয়ভাবে শূন্য দশমিক ৫৬ শতাংশ জিডিপির প্রবৃদ্ধি হবে। পদ্মা সেতুর জন্য করা নদী শাসনের ফলে ৯ হাজার হেক্টর জমি খরা ও বন্যা থেকে বাঁচবে, যার আর্থিক মূল্য ১৫৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। মাওয়া-জাজিরা রুটে ৪০০ মিলিয়ন ডলারের ফেরি সার্ভিস খরচ বাঁচবে। ওই অঞ্চলের জীবনমান পাল্টাতে কেমন অবদান রাখছে সে বিষয়ে জানান খুলনা ও বরিশালের দুই বিভাগীয় কমিশনার।

খুলনার বিভাগীয় কমিশনার মো. হেলাল মাহমুদ শরীফ সময়ের আলোকে বলেন, জ্বালানি সাশ্রয় হচ্ছে, সময় বাঁচছে, কর্মঘণ্টা বাঁচছে। এখন খুলনা বিভাগের মধ্যে যেকোনো জেলাতে ঢাকা থেকে আসা-যাওয়া করতে ৩ থেকে সর্বোচ্চ সাড়ে ৩ ঘণ্টা সময় লাগছে। আগে যেখানে ১০ থেকে ১২ ঘণ্টা সময় লাগত। এই এলাকার কৃষিতে ব্যাপক উন্নতি ঘটেছে। কৃষক তার ফসলের ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন, কম সময়ে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় কৃষিপণ্য পাঠাতে পারছেন। সবচেয়ে বড় কথা পদ্মা সেতুর কল্যাণে যোগাযোগ খাতে ব্যাপক উন্নতি ঘটেছে। নতুন নতুন বিনিয়োগ হচ্ছে, শিল্প প্রতিষ্ঠান হওয়ায় বাড়ছে কর্মসংস্থান। সুতরাং পদ্মা সেতু আমাদের বহুমুখী সুফল দিচ্ছে।

এ বিষয়ে বরিশাল বিভাগীয় কমিশনার মো. আমিন উল আহসান সময়ের আলোকে বলেন, পদ্মা সেতুর পথচলার প্রথম দিন থেকেই বরিশাল বিভাগের মানুষ এর সুফল পেতে শুরু করেছেন। বিশেষ করে কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকতসহ এই এলাকার অন্যান্য পর্যটন এলাকায় পর্যটকের সংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে। এখন প্রতিদিন ১০০ থেকে ১৫০টি গাড়িতে করে কুয়াকাটায় যাচ্ছেন পর্যটকরা। ঢাকা থেকে এখন বরিশালে মাত্র আড়াই ঘণ্টায় চলে আসা যাচ্ছে। এই সুফলটি মিলছে পদ্মা সেতুর কল্যাণে। উদ্যোক্তারা এই এলাকায় ব্যাপক বিনিয়োগের জন্য আসছেন। তারা প্রচুর জমি কিনছেন শিল্প কারখানা গড়ার জন্য। এতে কর্মসংস্থান বাড়বে। সবচেয়ে বড় কথা পদ্মা সেতুর কল্যাণে বরিশাল বিভাগের কৃষি, প্রাণিসম্পদ খাতের ব্যাপক উন্নতি ঘটেছে। আগে পণ্য আনা-নেওয়া করতে লঞ্চের জন্য অপেক্ষা করতে হতো ঘণ্টার পর ঘণ্টা। এতে পথেই অনেক পণ্য নষ্ট হয়ে যেত। এখন আর এমনটি হয় না। সুতরাং পদ্মা সেতুর কল্যাণে বরিশাল বিভাগের মনুষের জীবনে আমূল পবির্তন এসেছে।