Image description

বাইরে রোদের ঝাঁঝালো তাপ। চৈত্রের দাবদাহ চলছে। রমনা পার্কের দক্ষিণ পাশের বৃক্ষরাজির পাতাগুলো শুকিয়ে কেমন ঝিমিয়ে পড়েছে গাছের নিচে বসে লামিয়া, রিংকু, টিংকু, জোবেদা জীবনের গল্প শোনাচ্ছে। লামিয়ার বাবা নেই। মা থেকেও নেই। পরের বাড়ি কাজ করে আর শিল্পকলার করিডর ঝাড়ু দেয়। 

ছোট্ট একটা কুঁড়েঘরে থাকে তারা। এটাকে কুঁড়েঘর বলে না। তাঁবুঘরও বলা যায়। ঢাকা ক্লাবের পেছনের দিকটায় তাদের ছোট্ট একটা তাঁবুঘর। সেটা আবার দিনে গুটিয়ে রাখতে হয়। শহরের নামি দামি মানুষেরা দেখলে তাদের জাত যাবে। এইসব ঘরে বাস করলে নানান সমস্যা দেখা যায়। মাঝে মাঝে ভিআইপি নাকি কারা যেন যাওয়া আসা করেন। তখন সবকিছু পরিষ্কার করে রাখতে হয়। পুলিশ মামারা থাকতে দেয় না। দিনে একটু ঘরের ভেতর মাথা রাখবে তার উপায় নাই। মাঝে মাঝে বেঞ্চে একটু আশ্রয় নেয়। তারপরও বড়লোকেরা (এটা লামিয়ার ভাষায়) এলে দূর দূর করে তাড়িয়ে দেয়। কখনো কখনো কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের মামারা আসে দলবেঁধে। তারা গোল হয়ে বসে গল্প করে। ভালো লাগে। 

লামিয়ার বাবা রিকশা চালাতো। একদিন ঢাকা ক্লাবের সামনে একটা প্রাইভেট কারের ধাক্কায় উল্টে যায় রিকশা। লামিয়ার বাবা ছিটকে পড়ে যায়। ফিনকি দিয়ে রক্ত ছুটতে থাকে। রক্ত গড়িয়ে যায় অনেক দূর। কয়েকজন ধরে পাশেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে নিয়ে গেলেও আর ফেরেনি লামিয়ার বাবা। 

কত সুন্দর জীবন ছিল তাদের। নাজিমউদ্দিন রোডে একটা ভাড়া বাসায় থাকতো তারা। লামিয়া ফোরে উঠল। বাবা তাকে সুন্দর একটা জামা কিনে দিলেন। করোনাকালীন ঈদ। তবুও তাদের আনন্দ থেমে থাকেনি। ছোট্ট বাসায় আনন্দ উছলে পড়তো। সারাদিন শেষে বাবা যখন বাসায় ফিরতো। বাবার কোলে মাথা রেখে লামিয়া ঘুমিয়ে পড়তো। বাবাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমাতে কী যে শান্তি লাগতো। লামিয়ার মা ঈদের দিনে দু তিন রকম সেমাই, নুডলস, পায়েস, পোলাও রান্না করতো। বাবা মারা যাওয়ার আগে সেই যে ঈদের আনন্দ করেছে, আর করেনি।  

বলতে বলতে চোখের কোনে পানি জমে উঠেছে লামিয়ার। 

দুই

রিংকুর বাবা আছে মা নেই। কিন্তু বাবা আরেকটা বিয়ে করেছেন। ঘরে তার সৎ মা। বাবা কাঁচামালের ব্যবসা করে। কারওয়ান বাজার থেকে ভ্যানগাড়িতে করে নানারকম সবজি নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় বিক্রি করে। 

তারা থাকে কমলাপুর বস্তিতে। হাঁটতে হাঁটতে গুলিস্তান হয়ে সে রমনায় চলে আসে। পার্কের এক বড় ভাই জামাল সে তাকে চকোলেট ধরিয়ে দেয়। চকোলেট বিক্রি করে যা পায় সেটা দিয়ে সে তার খাবার কিনে খায়। 

রিংকুর বাবা তার নাম রেখেছিল টেলিভিশনে রিংকুর গান শুনে। রিংকু ক্লোজআপ তারকা। তার গান শুনে মুগ্ধ হয়ে মিল রেখে রিংকু রাখে। 

বাবা বলেছিল, আমার ছাওয়ালও একদিন শিল্পী হবে। 

কিন্তু ভাগ্য সহায় হয়নি। রিংকুর দাদাবাড়ি বরগুনার আমতলিতে। নদীতে তাদের বাড়িঘর সব ভেঙে গেলে তার বাবা চলে আসে ঢাকায়। কোনোমতে চলছিল সংসার। এমন সময় করোনা আক্রমণ করে। করোনায় মারা যায় রিংকুর মা। বাবার টাকা পয়সা ছিল না। চিকিৎসাও করাতে পারেনি। 

রিংকু কখনো ঈদের জামা পরেনি। নতুন জামা কখনো জোটেনি তার কপালে। বাবা সামান্য সবজি বিক্রেতা। নিজের পুঁজি নাই। অন্যের দেয়া কিছু টাকা আর ভ্যানগাড়ি। লাভের কিছু অংশ পেয়ে কোনোরকমে সংসার চালায়। 

সৎ মায়ের সংসারে রিংকু এখন বোঝা। তাই কাউকে কিছু না বলে বাড়ি ছেড়ে চলে এসেছে। কোথায় থাকবে সেটা জানে না। কি খাবে কি হবে জীবনের? ভাবতে ভাবতে কান্নায় ভেঙে পড়ে রিংকু। 

তিন

ঢাকা ক্লাবে অন্যদিন পত্রিকার ইফতারির বিশাল আয়োজন। লেখকদের সম্মানে অনুষ্ঠান। মাজহারুল ইসলাম আর আবদুল্লাহ নাসের দুজন ভালো বন্ধু। তারা অনেক মানবিক কাজও করেন। প্রতি ঈদে তারা অসহায় ছিন্নমূল শিশুদেরকে ঈদ সামগ্রী উপহার দেন। 

রমনা পার্কে জামাল নামে একটি ছেলে শিশুদের নিয়ে কাজ করে। সে পার্কের শিশুদেরকে লেখাপড়া শেখায়। শিশু ফাউন্ডেশন নামে তার সংগঠন রয়েছে। এই সংগঠন অসহায় শিশুদের নিয়ে কাজ করে। পড়ালেখার পাশাপাশি তারা কাজও শেখায়। জামালের স্বপ্ন একদিন সে এই শিশুদের জন্য একটা আবাসিক ভবন তৈরি করবে। সেখানে তাদের শিক্ষা থেকে শুরু করে সবই শেখানো হবে। শিশুরা বড় হবে। 

মাজহারুল ইসলাম জামালকে ডাকলেন। ঢাকা ক্লাবের খাবার আর শিশুদের জন্য ঈদের নতুন জামা নিয়ে সবাই তখন রমনা পার্কে। জামালের একটা জাদুর বাঁশি আছে। এই বাঁশিতে ফুঁ দিলেই পার্কের শিশুরা একটা নির্দিষ্ট জায়গায় জড়ো হয়। জামাল বাঁশিতে ফুঁ দিতেই শতেকজন শিশু জড়ো হয়ে গেল। তারা এই পার্কের আশেপাশেই থাকে। কেউ গুলিস্তান পার্কে। কেউ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। 

মাজহারুল ইসলাম শিশুদের উদ্দেশে বক্তৃতা দিলেন। এই যে তোমরা যারা শিশু তারাও তো মানুষ। আর মানুষ হিসেবে আমাদের সবারই ভালো থাকার অধিকার রয়েছে। শিশুরা সবাই হাততালি দিলো। আমরা তোমাদের জন্য কিছু ঈদ উপহার এনেছি। পার্কের দক্ষিণ গেটে একটি ট্রাকে ঈদের নতুন জামাকাপড় আছে। তোমাদের যার যেটা পছন্দ ও সাইজ সেটাই নিবে। আর খাবারের প্যাকেট জামালের হাত থেকে নিবে। 

লামিয়া, রিংকু, জোবেদাও ছুটলো ট্রাকের কাছে। শিশুদের সাথে তাদের স্বপ্নও ছুটছে। এই শিশুরা কি পারবে তাদের আগামীর জীবন গড়তে!


মানবকণ্ঠ/এফআই