Image description

ভাষা সৃষ্টির কারণ ও উৎস নিয়ে বহু শতাব্দী ধরে লেখালেখি হয়েছে। ভাষা সৃষ্টির উৎসের ওপর সম্পূর্ণ নির্ভরযোগ্য কোনো তথ্য প্রায় নেই বললেই চলে। কিন্তু ভাষার পরিবর্তনশীলতার জন্য প্রাচীন মানুষের বিবর্তনের ইতিহাসে আকার-ইঙ্গিতের নির্বাক অথবা প্রাক-ভাষা থেকে অন্তত একবার মৌখিক ভাষার জন্ম হয়। কিন্তু এর বেশি জানা নেই।

বিশ্বের অনেক ধর্মেই ভাষার উৎস সম্পর্কে বলা হয়েছে। ইহুদি-খ্রিস্টান-ইসলাম ধর্মের ধারায় বলা হয়, ঈশ্বর প্রথম মানুষ আদমকে বিশ্বের যাবতীয় পশু-পাখির ওপর কর্তৃত্ব দেন এবং আদম এই সব পশু-পাখির একটি করে নাম দেন; এটি ছিল আদমের ভাষাজ্ঞানের প্রথম বড় প্রয়োগ। বর্তমানে পৃথিবীতে ভাষার প্রাচুর্যের কারণ হিসেবে বাবেলের মিনারের কাহিনীর উল্লেখ করা হয়; এই কাহিনী অনুসারে বর্তমান পৃথিবীতে ভাষার প্রাচুর্য ও বৈচিত্র্য হলো মানুষের ঔদ্ধত্যের শাস্তি। এই ধর্মীয় কাহিনীগুলো অতীতে মেনে নেয়া হলেও বিজ্ঞানের উন্নতির সাথে সাথে ভাষার উৎসের একটি প্রাকৃতিক, বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যার প্রয়োজন হয়ে পড়ে। ১৮শ’ শতকের বেশ কিছু ইউরোপীয় দার্শনিক যেমন জঁ-জাক রুশো, কোঁদিয়াক, হার্ডার প্রমুখ মনে করতেন ভাষার উৎস নির্ণয় করা খুব কঠিন কোনো কাজ নয়।

ভাষা যে মানুষের লিখিত ইতিহাসের চেয়ে বহু প্রাচীন, এ ব্যাপারটিকে তারা তেমন আমল দেননি। তারা মনে করেছিলেন, ভাষাহীন মানুষ কীভাবে বসবাস করত, তা মনের পর্দায় গভীরভাবে কল্পনা করে যৌক্তিকভাবে এগোলেই ভাষার কীভাবে উৎপত্তি হলো, সে বিষয়ে একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছানো সম্ভব। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল, এই অনুমানগুলোর মধ্যে কোনো ঐকমত্য নেই।

১৯৬০-এর দশক থেকে নোয়াম চমস্কির প্রবর্তিত ধারণাগুলো ব্যাকরণের তত্ত¡কে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে। চমস্কির মতে, ভাষাবিজ্ঞানের কেন্দ্রীয় একটি প্রশ্ন হলো- মস্তিষ্কে অন্তর্নিহিত যে ক্ষমতাবলে মানুষ তার জীবনের প্রথম বছরগুলোতে অত্যন্ত দ্রুততার সাথে দক্ষভাবে কোনো ভাষায় কথা বলার ক্ষমতা অর্জন করে, সেই জৈবিক ক্ষমতার প্রকৃতি কী? এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ভাষার উৎসের গবেষণা বিবর্তনবাদী জীববিজ্ঞানের একটি অংশ বলেই মনে হয়। কীভাবে আদি মানুষের মধ্যে এই অন্তর্নিহিত ক্ষমতার বিকাশ ঘটেছিল? অন্য প্রাইমেটদের মধ্যে কীভাবে এর বিবর্তন ঘটে? চম্স্কি নিজে অবশ্য বেশ স্পষ্টভাবেই ভাষার বিবর্তন নিয়ে গবেষণাকে নিরুৎসাহিত করেছেন।

ফলে চমস্কীয় ভাষাবিজ্ঞানীরা এক ধরনের স্ববিরোধিতার মধ্যে কাজ করছেন। তারা সব ভাষাকে একটিমাত্র বিশ্বজনীন ব্যাকরণের আওতায় এনে ব্যাখ্যা করতে চাইছেন, যে ব্যাকরণের উৎস হলো মানুষের অন্তর্নিহিত ভাষিক ক্ষমতা। অথচ এই ক্ষমতাটির উদ্ভব ও বিকাশ কীভাবে ঘটল, তা নিয়ে তারা খুব একটা চিন্তিত নন।

ইদানিং স্টিভেন পিংকারসহ আরও কিছু বিজ্ঞানী এই নিরুদ্বেগ কাটিয়ে ভাষার উৎসের ব্যাপারে মনোযোগী হয়েছেন। ভাষার যে প্রত্যক্ষ লিখিত নিদর্শন পাওয়া গেছে, তার বয়স ৫ হাজার বছরের বেশি নয়। মুখের ভাষার উৎপত্তি কী করে ঘটল, তার ওপর এই প্রমাণ তাই আলোকপাত করতে পারে না। তাই ভাষার উৎসের জন্য আমাদেরকে অপ্রত্যক্ষ প্রমাণের ওপরেই নির্ভর করতে হবে। প্রাচীন মানুষদের বাগযন্ত্র (জিহ্বা, ঠোঁট, স্বরযন্ত্র) সরাসরি পর্যবেক্ষণ করতে পারলে আমরা অনেক কিছু জানতে পারতাম, কিন্তু এগুলো নরম পেশিকলা দিয়ে তৈরি বলে আজ আর এগুলোর অস্তিত্ব নেই। এ পর্যন্ত পাওয়া সবচেয়ে প্রাচীন দ্বিপদী মানুষটি হলো australopithecus afarensis প্রজাতির লুসি-র কঙ্কাল, যার বয়স প্রায় ৩০ লক্ষ বছর।

সুতরাং অনুমান করা যায়, ঐ সময়ের দিকেই মানুষের ভাষা উৎপাদনকারী বিশেষ বাগযন্ত্রের উৎপত্তি হয়েছিল। আদি মানুষের মস্তিষ্কের বিবর্তনের সাথে ভাষার উৎপত্তির সম্পর্ক স্থাপন করা আরও কঠিন। তবে সবকিছুর পরে একথা সত্যি যে, শুধুমাত্র যোগাযোগের কারণে মানুষের ভাষা তৈরির প্রয়োজন ঘটেছিল। এক সময় মানুষের ভাষা ছিলো না। তারা চিচি করে শব্দ করে কথা বলতো বা ইশারায় বোঝাতো।

ভাষাবিদ নোয়েরের তত্ত্ব এমন কথাই বলে। যে কারণে ভাষা স্বাধীন নয়। কারণ ভাষা ইশারা, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সঞ্চালন ছাড়া ভাষা বোঝা দুরূহ। তবে কার্ল মার্কস বলেছেন ভিন্ন কথা।

তিনি বলেছেন, শ্রম মেহনতের কষ্টে মানুষের ভোকাল কর্ড খুলে গিয়েছিলো। তারপরে মানুষ কথা বলতে শুরু করে। দিনে দিনে ভাষা পত্র-পল্লবে বিকশিত হয়। এর মধ্যে মানুষ আবিষ্কার করে ফেলে ভাষা আগ্রাসন করলে একটি জাতিকে আগ্রাসন করা যায়। এভাবে দেখা গেছে কয়েকটি ভাষাভাষী মানুষ বিশ্বকে শাসন করেছে। সংগ্রামের মধ্য দিয়ে মানুষ স্বাধীন হয়েছে। কিন্তু শাসকের হাত ধরে  ভাষা রয়ে গেছে। ভাষা প্রবহমান নদীর মতো। সহজিয়া ভাষা মানুষের মুখে টিকে থাকে। ধ্রুপদ ভাষা ও ভাবে টিকে না। যেমন সংস্কৃত, ল্যাটিন এমন সব ভাষার পরিচায়ক। তারপরও এ কথাই ঠিক যে, ভাষা  যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম।

ভাষার ইতিহাস যোগাযোগের একটি সুসংবদ্ধ ব্যবস্থা। দেশ, কাল ও পরিবেশভেদে ভাষার পার্থক্য ও পরিবর্তন ঘটে। বিভিন্ন প্রাকৃতিক পরিবেশে অবস্থান করে মানুষ আপন মনোভাব প্রকাশের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন বস্তু ও ভাবের জন্য বিভিন্ন ধ্বনির সাহায্যে শব্দের সৃষ্টি করেছে। সেসব শব্দ মূলত নির্দিষ্ট পরিবেশে মানুষের বস্তু ও ভাবের প্রতীক মাত্র। তবে ভাষা দ্রুত বদলায়। আট থেকে বারো কিলোমিটারের মধ্যে ভাষা বদলে যায়। এলাকা ত্যাগ করলে অন্য এলাকার ভাষা এক ভাষার ভিতরে মিশে যায়- ভাষার চরিত্র এমন। এ শতকে মানুষ তার দৈনন্দিন জীবনে যে ভাষা ব্যবহার করে, হাজার বছর আগেকার মানুষের ভাষা ঠিক এমনটি ছিল না। বর্তমানে পৃথিবীতে ভাষা আছে ৭ হাজারের বেশি। এর মধ্যে মাত্র ২৩টি ভাষাতেই কথা বলে পৃথিবীর অর্ধেকের বেশি মানুষ। অন্যদিকে বিলুপ্তির পথে আছে পৃথিবীর ২৪ হাজার ভাষা।

বিশ্বের সবচেয়ে বেশি মানুষ ৫টি ভাষায় কথা বলে। কিন্তু কেন? সেটা পরে আলোচনা করা যাবে। বেশি মানুষ কথা বলে এমন ভাষার মধ্যে প্রথম স্থানে রয়েছে মান্দারিন চাইনিজ। এটি চীনা ভাষার কথ্য রূপগুলোর একটি।  প্রায় ৯৪ কোটি লোক এ ভাষায় কথা বলে। পর্তুগিজ ভাষায় ২৩৬ মিলিয়নেরও বেশি মানুষ কথা বলে। সংস্কৃত ভাষা প্রভাবিত হিন্দি একটি ইন্দো-ইরানীয় ভাষা। বিশ্বজুড়ে ৩৪৪ মিলিয়নেরও বেশি মানুষের মুখের ভাষা এটি। ইংরেজি ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা পরিবারের অন্তর্গত একটি পশ্চিম জার্মানিক ভাষা। এটি জার্মান, ডাচ ও ফ্রিজীয় ভাষার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত।

বিশ্বের প্রায় ৩৮ কোটি মানুষের মাতৃভাষা ইংরেজি। স্প্যানিশ একটি রোমান্স ভাষা এবং ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগোষ্ঠীর অন্তর্গত। আনুমানিক ৪৯ কোটি মানুষের মাতৃভাষা এটি। এত বেশি লোকের মুখের ভাষা হওয়ার কারণ এমন হতে পারে যে এগুলো শাসকের ভাষা এবং সহজিয়া ভাষা। শাসকের ভাষাকে মানুষ সম্মান করে শত শত বছর পরেও। আমাদের ইংরেজি বা আরও কিছু ভাষা প্রীতি যার প্রমাণ। একইভাবে সহজিয়া আকারেরও ভাষা স্থাপিত হয় মানুষের ভেতরে। তারপরও মাতৃভাষার প্রতি মানুষের শ্রদ্ধা সবচে বেশি থাকবে এটাই ঠিক। সব ভাষা বলার পরেও বাংলা ভাষার তৃপ্তি আর কোথায় পাবো।

মানবকণ্ঠ/এআই