Image description

কাজী নজরুল ইসলাম গদ্য লিখেছেন। তার গদ্যের এলাকাটা কম বিস্তৃত নয় এবং গদ্যের সঙ্গে তার সৃজনশীলতা বিশেষভাবে সম্পর্কিত হয়ে আছে। তার লেখক জীবনের প্রথম রচনা ছিল-‘বাউন্ডুলের আত্মকাহিনী’ যা গল্প, তার লেখক জীবনের শুরুতে লেখা। শুরু থেকে লেখা এসব গদ্য তার লেখক সত্তার অনেকটা অংশ অধিকার করে রেখেছে। নজরুলের লেখক সত্তার পরিপূর্ণ দিককে আবিষ্কার করতে হলে তার গদ্যকে অবহেলার চোখে দেখলে চলবে না বরং সম্পূর্ণ মনোযোগ দেওয়া প্রয়োজন। অথচ নজরুলের গদ্য মূল্যায়নের ক্ষেত্রে শুধু উপেক্ষিত থাকেনি, এ ক্ষেত্রে এক ধরনের সীমাবদ্ধতাও লক্ষ করা যায়, যার জন্য তার গদ্য পাঠকের কাছে অপরিচিত হয়ে আছে অনেকাংশে। 

কাজী নজরুল ইসলামের লেখক জীবনের স্বল্প পরিসরে সৃষ্টিশীল তিনটি উপন্যাস-‘বাঁধনহারা’, ‘মৃত্যুক্ষুধা’ ও ‘কুহেলিকা’। গল্পগ্রন্থ তিনটি-‘ব্যথার দান’, ‘রিক্তের বেদন’ ও ‘শিউলী মালা’। নাটক তিনটি-‘ঝিলিমিলি’, ‘আলেয়া’ ও ‘মধুমালা’। এ ছাড়া কিশোর নাটক দুটি। প্রবন্ধগ্রন্থ পাঁচটি। এ ছাড়াও আরও গদ্য লেখা রয়েছে কয়েকটি স্তরে। উল্লিখিত এত গদ্য লেখা কি একেবারে সংখ্যায় কম? অবশ্য নয়। কিন্তু শুধু সংখ্যা পরিমাপ করা নয়, সামগ্রিক দিক থেকে তার উল্লিখিত গদ্য বেশ কিছু বৈশিষ্ট্য নিয়ে উজ্জ্বল। 


নজরুল যে সময়টায় লিখেছেন এবং সে সময়ের সামাজিক অবস্থানে থেকে যা দেখেছেন, যা বুঝেছেন-তাই লেখার মধ্যে টেনে এনেছেন। নিজের সময়কে অস্বীকার করেননি, মানুষকে গ্রহণ করেছেন মুখ্যরূপে এবং অন্যায়, অবিচার, অত্যাচারের বিরুদ্ধে তিনি আপসহীন বিদ্রোহ ঘোষণা করেছেন। বিদ্রোহী সত্তার সেসব বৈশিষ্ট্য-তা তার লেখার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত হয়ে আছে। সেই কারণে তার সাহস ও আবেগ, অকৃত্রিম গতিশীলতা ও চেতনা বিশেষভাবে তার গদ্যের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। কিন্তু এসব বৈশিষ্ট্য ক্ষুদ্র পরিসরে সীমাবদ্ধ করা যায় না। এসব বৈশিষ্ট্যের জন্য তার গদ্য লেখা স্বকীয় এবং আলাদাভাবে চিহ্নিত হতে পারে। বস্তুত একেকজন সৃজনশীল লেখকের লেখা একেক রকম বৈশিষ্ট্যপূর্ণ হয়ে থাকে। এসব দিক থেকে বিচার-বিবেচনা করে তার গদ্য লেখার মূল্যায়ন স্থির হওয়া দরকার বলে মনে হয়। 

নজরুলের তিনটি উপন্যাস এবং এই তিনটি উপন্যাসের তিনটি চরিত্র-‘বাঁধনহারা’র নুরুল হুদা, ‘কুহেলিকা’র জাহাঙ্গীর ও ‘মৃত্যুক্ষুধা’র আনসার নজরুলের প্রতিকৃতি হিসেবে উন্মোচিত হয়েছে যেন। নজরুল চরিত্রের যে রোমান্টিকতা-স্বদেশিকতা-মানবতাবোধ রয়েছে তা এই তিনটি চরিত্রে প্রতিফলিত হয়েছে। ‘বাঁধনহারা’য় যে সৈনিক-জীবনের চিত্র প্রতিফলিত হয়েছে-তা উল্লেখযোগ্য এবং বিরল। ‘কুহেলিকার’ কাহিনি সন্ত্রাসবাদকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। এসব উপন্যাসে আঙ্গিকগত দুর্বলতা রয়েছে ঠিকই কিন্তু কিছু চরিত্র এবং সামাজিক অবস্থানকে যেভাবে উপন্যাসে উপস্থাপন করা হয়েছে-তা একেবারে মূল্যহীন নয়। কেননা যা কিছু বৈশিষ্ট্য এসব লেখায় রয়েছে তা সময় ও নজরুলের চেতনা মূল্যায়নে উল্লেখযোগ্য বলে মনে হয়। 


নজরুলের আঠারোটি গল্প। এসব গল্পের বেশিরভাগই প্রেমের গল্প। গল্পে অতি করুণ রস সঞ্চারিত হয়েছে। ‘রাজবন্দীর চিঠি’, ‘স্বামীহারা’, ‘রাক্ষুসী’, ‘বাউন্ডুলের আত্মকাহিনী’ এবং ‘শিউলীমালা’ এই পাঁচটি গল্প ছাড়া অন্য গল্পগুলোতে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে প্রেমের দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে। এর মধ্যে ‘ব্যথার দান’, ‘রিক্তের বেদন’, ‘ঘুমের ঘোরে’ এবং ‘হেনা’ গল্পে ট্র্যাজেডির সৃষ্টি হয়েছে প্রেম ও কর্তব্যের সংঘাতের মধ্য দিয়ে। গল্পগুলোর এক ধরনের চমক ও উজ্জ্বলতা পাঠকের মনকে আকৃষ্ট করে। ছোটগল্পে হয়তো নজরুল খুব বেশি সাফল্য অর্জন করেননি, তবে গল্পে তার ব্যক্তিমানস, দৃষ্টিভঙ্গি, জীবনকে দেখার প্রেক্ষাপট আমরা আবিষ্কার করতে পারি। 

নজরুল ইসলামের নাটকে গভীর বাস্তবধর্মী অবস্থান খুঁজে পাওয়া যায় না। এক ধরনের গতিময়তার প্রাবল্য তার নাট্যরসকে নিয়ন্ত্রিত করেছে, যদিও গীতিময়তার জন্য তার নাটক বেশ টানে। এটাও একটা গুণ অস্বীকার করা যায় না। রূপক-সাংকেতিকনির্ভর নাটকে ভিন্নমাত্রার প্রকাশ লক্ষ করা যায়। মোটামুটি নাটকগুলোতে তার সৃজনশীলতার উপস্থিতি অবহেলাপূর্ণ নয়।

নজরুল ইসলামের প্রবন্ধের সংখ্যা খুব বেশি নয়, তবুও প্রবন্ধগুলো উল্লেখযোগ্য এবং বিশিষ্ট। ‘নবযুগ’ ও ‘ধূমকেতু’ পত্রিকায় তার যেসব প্রবন্ধ সম্পাদকীয় হিসেবে প্রকাশ পেয়েছিল, সেগুলো প্রবন্ধগ্রন্থে স্থান পেয়েছে। এসব প্রবন্ধে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা, সাহস, রাজনৈতিক চেতনা, দেশপ্রেম, মানুষের প্রতি ভালোবাসা ও বিশ্বাস যেভাবে প্রকাশ পেয়েছে তা গভীর তাৎপর্যপূর্ণ এবং অনেকাংশে বিরল। এসব প্রবন্ধ শুধু শিল্পগুণে নয়, বেশ কিছু বৈশিষ্ট্যের জন্য টিকে আছে ও টিকে থাকবে। 

রুদ্র মঙ্গলের অন্তর্গত ‘রুদ্রমঙ্গল’ প্রবন্ধে নজরুল লিখেছেন-‘জাগো, জনশক্তি! হে অমর অবহেলিত পদপিষ্ট কৃষক আমার মুটে-মজুর ভাইয়েরা! তোমার হাতের ওই লাঙ্গল আজ বলরাম-স্কন্ধে হালের মতো ক্ষিপ্ত তেজে গগনের মাঝে উৎক্ষিপ্ত হয়ে উঠুক। এই অত্যাচারীর বিশ্ব উপড়ে ফেলু-উল্টে ফেলুক! আনো তোমার হাতুড়ি ভাঙো ওই উৎপীড়কের প্রাসাদ-ধুলোয় লুটাও অর্থপিশাচ বলদর্পীর শির। ছাড়ো হাতুড়ি চালাও লাঙ্গল উচ্চে তুলে ধরো তোমার বুকের রক্তমাখা লাল ঝান্ডা!’ এসব প্রবন্ধে রাজনৈতিক চেতনা, স্বচ্ছ ভাবাবেগ ও গভীর মানবপ্রেমের উদ্ভাস পাঠকের মনকে দারুণভাবে আকর্ষণ করে-যা গুরুত্বহীন নয়, বিভিন্ন বিবেচনায়। 


উল্লিখিত কটি স্তবকে নজরুলের উপন্যাস, গল্প, নাটক ও প্রবন্ধের অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত দিক তুলে ধরা হলো। কারণ নজরুল তো গদ্যও লিখেছেন, তা যেন কাছে টেনে নিই, এর বিস্তৃত ব্যাখ্যা করি ও বিশ্লেষণ করি। আর তা হলে তার লেখার আরও বিভিন্ন দিক ও তার অন্তর সাধনার দিকগুলোও বিভিন্ন পরিধি নিয়ে বুঝতে পারব। 

বিশেষত নজরুলের গদ্যকে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে বিচার-বিবেচনা করা দরকার, একেবারে অবহেলার ধুলোয় ফেলে রাখা ঠিক নয়। পুরোনো সাহিত্য বিচারে তার গদ্যকে মূল্যায়ন করলে হয়তো অনেক দিকই আবিষ্কার হবে না। নজরুলের মতো প্রতিভাপূর্ণ লেখকের গদ্যকে আবিষ্কার করতে হলে নতুন শিল্প-বিবেচনার শর্ত আরোপ করতে হবে আর তা হলে নজরুলের গদ্যকে আমরা নতুনভাবে অনেকাংশে আবিষ্কার করতে পারব। আর এভাবেই নজরুলের গদ্য সাহিত্যের অনেক বন্ধ দরজা খুলে যাবে, চোখের সামনে। 
নজরুলের একটি গান 
এবং একটি অসংগতি
অসীম সাহা
মোরা ঝঞ্ঝার মতো উদ্দাম, মোরা ঝর্নার মতো চঞ্চল
মোরা আকাশের মতো বাধাহীন
মোরা মরু-সঞ্চর বেদুঈন
মোরা বন্ধনহীন জন্মস্বাধীন, চিত্ত মুক্ত শতদল ॥
মোরা সিন্ধু জোয়ার কল-কল
মোরা পাগলা ঝোরার ঝরা জল
কল-কল কল্, ছল-ছল ছল্, ছল-ছল ছল্ ॥
মোরা দিল খোলা খোলা প্রান্তর
মোরা শক্তিঅটল মহীধর
মোরা হাসিগানসম উচ্ছল
মোরা মুক্ত-পক্ষ নভোচর
মোরা বৃষ্টির জল বনফল খাই শয্যাশ্যামল বনতল ॥
নজরুলের এই বিখ্যাত গানটির রচনাকাল বাংলা আষাঢ় ১৩৩১ সাল, যখন তিনি বাংলা কবিতায় দুর্দমনীয় প্রতাপে তার কাব্যিক আণবিকতা দিয়ে প্রবল বিস্ফোরণ ঘটিয়ে চলেছেন। কবিতা, গদ্য, নাটক, গানের প্রতিটি ক্ষেত্রেই তিনি এক মহিমান্বিত মহানায়ক।

কবিতা যেমন, গানের জগতেও তিনি রবীন্দ্রনাথসহ অন্যান্য সংগীতশিল্পী এবং গীতিকারের সঙ্গে প্রায় সমানতালে পাল্লা দিয়ে এগিয়ে চলেছেন। সেই রচনাগুলোয় যেমন অবারিতভাবে ফুটে উঠেছে তার আবেগের অভাবনীয় ঘনত্ব, তেমনি ছন্দে, তালে তিনি হয়ে উঠেছেন বাংলা কবিতা ও সংগীতের এক অমোঘ কা-ারি। অন্তর্গত তাগিদে তিনি একের পর এক গান রচনা করে চলেছেন। সংখ্যার বিচারে তা নেহাত অকিঞ্চিৎকর নয়। কিন্তু ওপরে উল্লিখিত গানটিতে এসে আমি অবাক বিস্ময়ে একটু হোঁচট খাই। কারণ নজরুল তার গানে অন্ত্যমিলের ক্ষেত্রে যেমন সতর্ক প্রহরী, তেমনি অন্ত্যমিলের ক্ষেত্রেও অভাবনীয় দ্যোতনার বিস্ময়কর কারিগর। অথচ এই গানের প্রথম অন্তরার শেষ পঙ্ক্তির সঙ্গে দ্বিতীয় অন্তরার শেষ পঙ্ক্তির একটি বৈসাদৃশ্য কেন এতদিন নজরুল-গবেষকদের দৃষ্টি এড়িয়ে গেছে, তা আমার বোধগম্য নয়। প্রথম অন্তরার তিনটি পঙ্ক্তির সঙ্গে দ্বিতীয় অন্তরার তিনটি পঙ্ক্তি মিলিয়ে দেখলেই এই কথার সত্যতা মিলবে। প্রথম অন্তরায় লেখা হয়েছে :
মোরা আকাশের মত বাধাহীন
মোরা মরু-সঞ্চর বেদুঈন
মোরা বন্ধনহীন জন্মস্বাধীন, চিত্ত মুক্ত শতদল ॥
এখানে তৃতীয় পঙ্্ক্তির প্রথম পর্বে তিনি ‘বন্ধনহীন’-এর সঙ্গে ‘জন্মস্বাধীন’-এই ছয় ছয় মাত্রার অন্ত্যমিল দিয়ে পরে স্বাধীনভাবে ‘চিত্ত মুক্ত’ শব্দবন্ধে ছয় মাত্রা ব্যবহার করে ‘শতদল’ অসম পর্বটি দিয়ে প্রথম অন্তরা শেষ করেছেন। এতে তিনটি পর্ব থাকলেও তিনটিতে অন্ত্যমিল নেই, আছে দুটি পর্বে। তবে তৃতীয় পর্বে অন্ত্যমিল না থাকলেও ‘চিত্তমুক্ত’-এর মতো ছয়মাত্রার শব্দশক্তির কারণে এর গতিতে কোনো বাধা সৃষ্টি হয়নি। বলা চলে, দুটি পর্বের অন্ত্যমিল এবং তৃতীয় পর্বের শব্দশক্তির কারণে গানটিতে যে ব্যঞ্জনা সৃষ্টি হয়েছে, তা অত্যন্ত স্বতঃস্ফূর্ত। অথচ দ্বিতীয় অন্তরার তিন পঙ্ক্তির শেষ পঙ্ক্তিটি লক্ষ করলে দেখা যাবে, সেখানে নজরুল সেই সংগতিটি রক্ষা না করে দ্বিতীয় পর্ব (যেখানে ‘বনফুল খাই’-এর মতো দুটি অত্যন্ত সাধারণ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে) বাদ দিয়ে প্রথম পর্বের সঙ্গে তৃতীয় পর্বে ছয়মাত্রার ‘শয্যাশ্যামল’ শব্দটি ব্যবহার করে এই সংগতিটি রক্ষার চেষ্টা করেছেন। এর ফলে তার গানের প্রথম অন্তরার শেষ পঙ্ক্তিতে যে দোলা তা দ্বিতীয় অন্তরার দ্বিতীয় পর্বে এসে প্রচ-ভাবে হোঁচট খেয়েছে। তিনি দ্বিতীয় অন্তরার তৃতীয় পঙ্ক্তির দ্বিতীয় পর্বে লিখেছেন :


মোরা হাসিগানসম উচ্ছল
মোরা মুক্ত-পক্ষ নভোচর
মোরা বৃষ্টির জল বনফল খাই শয্যাশ্যামল বনতল ॥
এখানে ‘বৃষ্টির জল’-এর সঙ্গে ‘বনফল খাই’ এই শব্দবন্ধ ব্যবহারের ফলে ছয় মাত্রার ধ্বনি ঠিক থাকলেও এর গতি যেমন বাধাগ্রস্ত হয়েছে, তেমনি এই গানের যে ব্যঞ্জনা তাও ভয়ানকভাবে ক্ষুণ্ণ হয়েছে। অথচ এক্ষত্রে স্বাভাবিকভাবেই
অন্ত্যমিলের ক্ষেত্রে তৃতীয় পঙ্ক্তিটির প্রথম ও দ্বিতীয় পর্ব এমন অন্ত্যমিলই দাবি করে :
মোরা বৃষ্টির জল খাই বনফল শয্যাশ্যামল বনতল ॥
এখানে তিনটি পর্বই ছয় মাত্রার অন্ত্যমিলযুক্ত এবং ‘বনফুল’ শব্দটি প্রথম অন্তরার ‘শতদল’ শব্দের চারমাত্রার অসমপর্বের মতোই ব্যবহৃত। নজরুলের রচনার ক্ষেত্রে এটাকেই স্বাভাবিক বলে মনে হয়। সে কারণেই গানটি গাইবার ক্ষেত্রে দ্বিতীয় বা সর্বশেষ অন্তরার গতি যেমন বৃদ্ধি পায়, গানের মধ্যে একটি বহির্গত এবং অন্তর্গত দোলা শ্রোতাদের শ্রুতিকেও মোহমুগ্ধ আবিষ্টতায় দোদুল্যমান করে তোলে।

অথচ এ ক্ষেত্রে যে অসংগতিটি নজরুলের এই গানে আমরা লক্ষ করি, সেটিকে নজরুলের ইচ্ছাকৃত বলে মেনে নিতে আমার মন কিছুতেই সায় দেয় না। এ ধরনের একটি অসংগতিপূর্ণ শব্দবন্ধ ব্যবহার করে গানের গতিকে রুদ্ধ করার মতো সংগীত-রচয়িতা নজরুল নন। তা হলে এই অসংগতিটি ঘটল কেমন করে? এটি কি কোনো লিপিকর-প্রমাদ? 


নজরুল কি এই গানটি মুখে মুখে রচনা করেছিলেন এবং অন্য কেউ তা লিপিবদ্ধ করেছিলেন? আর সেই লিপিকরের ভুলের কারণেই এমনটি ঘটে গেছে? অস্বাভাবিক কিছু নয়। কারণ ওই সময়টাতে নজরুল সংগীত-রচনায় এতটাই মগ্ন ছিলেন যে, সবসময় তার পক্ষে চেতনার সংগতি রক্ষা করা সম্ভব না-ও হতে পারে। কিন্তু নজরুল তো তখন পর্যন্ত সম্পূর্ণভাবে সুস্থ এবং কর্মচঞ্চলতায় দীপ্ত একজন প্রাণোচ্ছল মানুষ। যদি লিপিকরের কারণে এ ধরনের ভুল হয়ে থাকে, তা হলে পরবর্তী সময়ে তা তো নিশ্চয়ই তার নজরে পড়ার কথা। এটা সম্পূর্ণরূপে নজরুলের দৃষ্টির বাইরে থেকে গেছে, এ কথা বিশ্বাস করা অত্যন্ত কঠিন। তা হলে কি নজরুল ইচ্ছাকৃতভাবেই এ ধরনের একটি অসংগতিকে তার গানে প্রশ্রয় দিয়েছিলেন? আমার পক্ষে বিশ্বাস করা কঠিন। আসলে আমার মনে হয়, কোথাও না কোথাও একটা বিভ্রান্তি রয়ে গেছে। সেটা কী, তা গবেষকদের অবশ্যই খুঁজে বের করতে হবে। বাংলা গানের এক দিকপাল সংগীত-রচয়িতার গানে এ-ধরনের অসংগতি কিছুতেই মেনে নেওয়া যায় না। এ ব্যাপারে যারা নজরুলগীতি পরিবেশন করেন, তাদেরও দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই আমি। তারা যদি এই গানের শেষ অন্তরার শেষ পঙ্ক্তিটি প্রচলিতভাবে না গেয়ে ‘মোরা বৃষ্টির জল খাই বনফল শয্যাশ্যামল বনতল’-কে গ্রহণ করে গানটি করেন, তাতে নজরুলের এই গানের অন্তর্গত সৌন্দর্য যেমন বাড়বে, তেমনি শ্রুতির ক্ষেত্রেও এটি একটি মাধুর্যময় সংগীত হিসেবে বিভ্রান্তিহীনভাবে গৃহীত হবে।

মনে রাখতে হবে, নজরুল ছিলেন প্রবল আবেগে সিক্ত আপনভোলা একজন মানুষ। তার সেই আবেগ ও উচ্ছ্বাসের ফাঁক গলে এ রকম একটি অসংগতির ঘটনা ঘটে যাওয়া অসম্ভব কিছু নয়। তবে এখন সময় হয়েছে এ ধরনের একটি অসংগতির ত্রুটি দূর করে নজরুলের গানের মহিমাকে সুপ্রতিষ্ঠিত করা। আমাদের নিজেদের স্বার্থেই এই ধরনের একটি কাজে নজরুল-বিশেষজ্ঞগণ এবং তার গানের শিল্পীরা এগিয়ে আসবেনÑএটাই আমার প্রত্যাশা।