Image description

সবাই স্বীকার করবেন বর্তমান সময়ে ফেসবুক সামাজিক যোগাযোগের প্রয়োজনীয় একটি মাধ্যম। এটাও স্বীকার করবেন অপ্রয়োজনে আমরা সময় নষ্ট করে এই প্রয়োজনীয় মাধ্যমটি ব্যবহার করি। আলফ্রেড নোবেল ডিনামাইট আবিষ্কার করেছিলেন জনস্বার্থের বিবেচনায়। কিন্তু এই বস্তুটি যখন মানুষকে হত্যা করার জন্য যুদ্ধে ব্যবহৃত হতে শুরু করল তিনি তখন দুঃখ পেয়েছিলেন। দুঃখবোধ থেকেই নোবেল পুরস্কারের শুরু। অপারেশন করার আগে অজ্ঞান করার জন্য মরফিন ইনজেকশন কিংবা সর্দির ওষুধ হিসেবে ফেনডিল এ দুটো বহুদিন থেকে নেশাদ্রব্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
 
ফেসবুক এক প্রকার নেশাদ্রব্যই হয়ে গেছে। এই মাধ্যমটির উপকারিতা-অপকারিতা নিয়ে অবশ্য এই গদ্য নয়। অনেকেই নানা বিষয়সহ ফেসবুকে কবিতা পোস্ট করেন। মুহূর্তেই সেই কবিতা সম্পর্কে এক শব্দ দুই শব্দের মন্তব্য এসে যায়। অনেক দিন থেকেই আমার মনে সন্দেহ জেগেছে কবিতা না পড়ে অধিকাংশই জানিয়ে দেন তাদের বার্তাটি। চমৎকার, অসাধারণ, সুন্দর, দারুণ, দুর্দান্ত, অনবদ্য, অপূর্ব, ভালো লাগল-এ রকম মন্তব্যে সয়লাব হয়ে যায় পোস্টের কবিতা। কবিও আপ্লুত হন এসব মন্তব্যে। মন্তব্য পড়ে মনে হয় সব কবিতাই শ্রেষ্ঠ কবিতা হয়ে উঠেছে। আবার কেউ যদি ‘ভালো লাগল না’-এ রকম মন্তব্য করেন তিনি বন্ধু থেকে খারিজ হয়ে যান। ভালো না লাগা মন্তব্য হাতে গোনা। ফেসবুকের সব কবিতাই ‘দারুণ।’ এ ধরনের মন্তব্যে সন্দেহ জাগে আসলেই তারা পুরো কবিতা পড়েছেন কি না। কবিতা না পড়েই যে এ রকম প্রশংসা বাক্য ‘বর্ষিত’ হচ্ছে তা এখানে প্রমাণ করার চেষ্টা করব। এ ক্ষেত্রে আমিই বাদী আমিই বিবাদী। 
 
ধান ভানতে একটু শিবের গীত গাই। আমার এক বন্ধু সতর্ক করে বলেছেন, ‘ফেসবুকে কখনো কবিতা পোস্ট করবে না। কারণ সেই কবিতা চুরি হওয়ার আশঙ্কা আছে।’ আরেক বন্ধু সাহস দিয়ে বলেন, ‘দিতে পারো যদি সেটি কোনো কাগজে ছাপা হয়। আনকোরা কবিতা চুরি হয় বেশি। ছাপানোটা তো প্রমাণ।’ হ্যাঁ, এ রকম কিছু ঘটেছে যার তর্ক-বিতর্ক ফেসবুকেই দেখেছি। কিন্তু ফেসবুক তো দূরের কথা আমার ‘পরকীয়া’ কাব্যের একটি অংশ আমার জেলারই এক আইন ব্যবসায়ীর নামে উকিলবারের স্মরণিকায় ছাপা হয়ে যায়। 
 
একটি শব্দেরও পরিবর্তন নেই, কবিতার শিরোনামেরও পরিবর্তন নেই, পরিবর্তন শুধু আমার নামটি। আইনের লোকটির বেআইনি কাজে আমি যথারীতি ক্ষুব্ধ। ছেলেটি আমার পরিচিতও। কিছুদিন পর দেখা হলে আমার ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়ায় সে স্মিত হেসে অবলীলাক্রমে বলল, ‘ভালো লাগল তো তাই দিয়ে দিলাম-বলেই পাশ কেটে চলে যায়। এ ঘটনা ফেসবুক আগমনের বেশ আগে। এ রকম চুরি-চামারি বিখ্যাতরাও করেন। কেউ করেন আত্মস্থ।
 
এবার আসল কথায় আসা যাক। কবি মাকিদ হায়দার আমাকে খুবই স্নেহ করেন। বিভিন্ন কাগজে লেখা ছাপা হলে ফোন করে কেন কবিতাটি তার ভালো লেগেছে অনেক সময় নিয়ে তার ব্যাখ্যা করেন। আবার কোনো শব্দ বা পঙ্্ক্তি তার পছন্দ না হলে সেই বিষয়েও নির্দ্বিধায় মন্তব্য করেন। তিনি ফেসবুকে কবিতা পোস্ট করেন না এবং আমাকেও এক প্রকার নির্দেশের মতোই তা পালন করতে বলেন। তার যুক্তি, বই যতই কম বিক্রি হোক, পাঠক যতই কম পড়ুক, ফেববুক কবি বা কবিতা প্রচারের যতই সহায়ক হোক, প্রকৃত কবিকে প্রকৃত পাঠক বইয়ের মাধ্যমেই খুঁজে নেবে।’ মাকিদ ভাইয়ের কথা একদিক থেকে ঠিক। কিন্তু আমি আবার প্রকৃত কবি কি না এ বিষয়ে কে সিদ্ধান্ত দেবে? তিনি যেদিন এ কথা বললেন তার আগেই ২-৩টি কবিতা পোস্ট করে ফেলেছি। তার নির্দেশ অমান্য করে ২০২১ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর ‘কালি ও কলম’-এ প্রকাশিত, ‘ফিরে পেতে চাইলে’ কবিতাটি পোস্ট করি। এ পর্যন্ত মন্তব্যের সংখ্যা দুই হাজারের মতো। লাইকও প্রায় ওই পরিমাণ। মন্তব্যের মধ্যে এক শব্দ দুই শব্দই বেশি। তারপরও আমি পুলকিত এত এত মন্তব্য পড়েছে দেখে। এই সেদিন এক প্রিয়জনের মন্তব্য দেখে মনে হলো তিনি তো এর আগেও কবিতাটির প্রশংসা করেছেন। তাহলে কবিতাটি কি তার এতই ভালো লেগেছে যে আবার পড়ে দ্বিতীয়বার মন্তব্য করলেন? নাকি তিনি আদৌ কবিতাটি না পড়ে আমাকে খুশি করেছেন। এরপর আরও কয়েকজন একাধিকবার মন্তব্য করলেন। 
 
সন্দেহ সেদিন থেকেই শুরু। শুমারি করে দেখি তো ঘটনাটা কী। মন্তব্যের ঝাঁকা খুলে ফেলি একেবারে শুরু থেকে। চোখ উঠে যায় কপালে। আমার ভারতীয় দুই কবিবন্ধু বিভিন্ন সময়ে মন্তব্য করেছেন দশবার। তিরিশ জনের কেউ আট, সাত, ছয়, পাঁচ, চারবার করে মন্তব্য করেছেন। এরা কেউ শ্রদ্ধেয়, কেউ বন্ধু কেউবা শুভানুধ্যায়ী। তাহলে ব্যাপারটা কী দাঁড়াল? একটি কবিতায় একই ব্যক্তি এতবার মন্তব্য করবেন কেন? এ থেকেই সন্দেহ জাগে সবাই নয়, ফেসবুকের কবিতা না পড়েই অনেকে মন্তব্য করেন।