
একদিকে কোভিডের নতুন ভ্যারিয়েন্টের ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা, অন্যদিকে উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, এই দুটি পরিস্থিতি জনস্বাস্থ্যে নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে। বিশেষ করে, বর্ষা ও গ্রীষ্মকালে প্রতিবছরই বাংলাদেশে ডেঙ্গুর প্রকোপ দেখা যায়, যা এডিস ইজিপ্টি নামক মশার কামড়ে মানুষের দেহে সংক্রমিত হয়। এই ভাইরাসজনিত রোগটি প্রতিবছর অসংখ্য মানুষের জীবনকে হুমকির মুখে ফেলে দেয়। তাই ডেঙ্গুর ভয়াবহতা, স্বাস্থ্যঝুঁকি এবং এর প্রতিরোধের উপায় সম্পর্কে ব্যাপক সচেতনতা গড়ে তোলা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
আসুন, জেনে নেওয়া যাক ডেঙ্গুর লক্ষণ, এর ভয়াবহ পরিণতি এবং মশার বিস্তার রোধে আমাদের করণীয়।
ডেঙ্গু আক্রান্ত হলে সাধারণত ৫-৭ দিনের মধ্যে লক্ষণগুলো প্রকাশ পায়। প্রাথমিক পর্যায়ে ফ্লুর মতো মনে হলেও, কিছু নির্দিষ্ট লক্ষণ দেখে ডেঙ্গু সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়:
১. তীব্র জ্বর: ১০৪ ডিগ্রি ফারেনহাইট পর্যন্ত উচ্চ তাপমাত্রা দেখা যেতে পারে।
২. প্রচণ্ড মাথাব্যথা: বিশেষ করে চোখের পিছনে তীব্র ব্যথা অনুভব হতে পারে।
৩. পেশি ও হাড়ে ব্যথা: এই ব্যথার তীব্রতার কারণে ডেঙ্গুকে 'ব্রেকবোন ফিভার' বা 'হাড় ভাঙা জ্বর' বলা হয়।
৪. ত্বকে র্যাশ: শরীরে লালচে দাগ বা ফুসকুড়ি দেখা দিতে পারে।
৫. বমি বমি ভাব বা বমি: হজমজনিত সমস্যা দেখা দিতে পারে।
৬. রক্তক্ষরণ: মাড়ি বা নাক থেকে রক্ত পড়া, প্রস্রাব বা মলের সঙ্গে রক্ত যাওয়া—এগুলো ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভারের লক্ষণ, যা অত্যন্ত মারাত্মক হতে পারে।
এই লক্ষণগুলো দেখা দিলে দ্রুততম সময়ে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া অত্যাবশ্যক। প্রয়োজনে চিকিৎসক রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার নির্দেশ দিতে পারেন। যদি বাসায় থেকে চিকিৎসা সম্ভব হয়, তবে ডাক্তারের পরামর্শ কঠোরভাবে মেনে চলতে হবে।
ডেঙ্গু সাধারণত ৫-৭ দিন স্থায়ী হয়, তবে কিছু ক্ষেত্রে এটি মারাত্মক রূপ নিতে পারে। মারাত্মক অবস্থায় ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভারে রক্তনালি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, যার ফলে অনিয়ন্ত্রিত রক্তপাত হয় এবং রক্তে প্লাটিলেট বা অণুচক্রিকার সংখ্যা দ্রুত কমে যায়। এই অবস্থা জীবনঘাতী হতে পারে।
এছাড়াও, ডেঙ্গু শক সিন্ড্রোম একটি অত্যন্ত বিপজ্জনক অবস্থা, যেখানে রক্তচাপ হঠাৎ করে কমে যায় এবং মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। মারাত্মক ডেঙ্গুর ক্ষেত্রে লিভার, কিডনি এবং হৃদপিণ্ডের মতো গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গগুলোও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, যা দীর্ঘমেয়াদী জটিলতা সৃষ্টি করে।
ডেঙ্গু প্রতিরোধের যা করতে পারেন..
ডেঙ্গুর এমন সব ভয়াবহ পরিণতি থেকে বাঁচতে হলে এর প্রতিরোধের কোনো বিকল্প নেই। ডেঙ্গু প্রতিরোধের মূলমন্ত্র হলো মশার বিস্তার রোধ এবং ব্যক্তিগত সুরক্ষা নিশ্চিত করা। এডিস মশা সাধারণত পরিষ্কার, জমে থাকা পানিতে ডিম পাড়ে। তাই মশার প্রজননস্থল ধ্বংস করা অপরিহার্য।
মশার বিস্তার রোধে করণীয়:
জমে থাকা পানি পরিষ্কার: বাড়ির আশেপাশে, ফুলের টব, পরিত্যক্ত টায়ার, প্লাস্টিকের পাত্র, নির্মাণাধীন ভবনের পানির স্তূপ—এসব স্থানে যেন পানি জমে না থাকে, সেদিকে খেয়াল রাখুন। জমে থাকা পানি নিয়মিত পরিষ্কার করুন বা ফেলে দিন।
পাত্রে ঢাকনা: পানির ট্যাংক, ড্রাম ও বালতি অবশ্যই ঢাকনা দিয়ে রাখুন।
পরিচ্ছন্ন পরিবেশ: বাড়ির ছাদ, বারান্দা ও বাগান নিয়মিত পরিষ্কার রাখুন।
বাড়ির আশেপাশে পরিষ্কার থাকলেও অন্যত্র থেকে আক্রান্ত হয়ে আসা অস্বাভাবিক নয়। তাই মশার কামড় থেকে নিজেকে সুরক্ষিত রাখতে হবে। এজন্য যা করতে পারেন..
মশারির ব্যবহার: দিনে ও রাতে ঘুমানোর সময় অবশ্যই মশারি ব্যবহার করুন।
জানালায় নেট: বাসার জানালায় মশার নেট লাগান যাতে মশা প্রবেশ করতে না পারে।
পোশাক: বাসার বাইরে বের হলে ফুলহাতা জামা ও প্যান্ট পরুন, বিশেষ করে সকাল ও সন্ধ্যায় যখন মশার উপদ্রব বেশি থাকে।
মসকুইটো রিপেলেন্ট: মশা তাড়ানোর ক্রিম, স্প্রে বা লোশন ব্যবহার করুন।
ডেঙ্গু সন্দেহ হলে করণীয়:
যেহেতু ডেঙ্গু একটি ভাইরাসজনিত রোগ, তাই প্রাথমিক অবস্থায় লক্ষণের সঙ্গে মোকাবেলা করাই এর চিকিৎসা। তবে রক্তে প্লেটিলেট কমে যাচ্ছে কি না, সেদিকে সতর্ক নজর রাখা জরুরি।
পর্যাপ্ত তরল গ্রহণ: প্রচুর পরিমাণে পানি ও তরল খাবার গ্রহণ করুন। মুখে খাবার স্যালাইন, ডাবের পানি, ফলের রস ইত্যাদি পান করা যেতে পারে।
ব্যথানাশক পরিহার: জ্বর কমানোর জন্য প্যারাসিটামল ছাড়া অন্য কোনো ব্যথানাশক ওষুধ সেবন করবেন না। অ্যাসপিরিন বা আইবুপ্রোফেন জাতীয় ওষুধ রক্তপাত বাড়াতে পারে।
চিকিৎসকের পরামর্শ: জ্বর অস্বাভাবিক মনে হলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। যদি প্লাটিলেট দ্রুত কমে যায় বা অন্যান্য জটিলতা দেখা দেয়, তবে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া লাগতে পারে।
সচেতনতাই ডেঙ্গু প্রতিরোধের সবচেয়ে বড় হাতিয়ার। ডেঙ্গু কোনো সাধারণ জ্বর নয়, এটি প্রাণঘাতী হতে পারে। তাই সচেতনতা ও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে আমরা নিজেদের এবং পরিবারকে ডেঙ্গুর প্রকোপ থেকে রক্ষা করতে পারি।
Comments