Image description

দুর্নীতিবাজদের হাতেনাতে ধরার একটি বিশেষ কৌশল ‘ফাঁদ’ অভিযান। একসময় খুবই জনপ্রিয়তা পেয়েছিল দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) এ বিশেষ অভিযান। তবে ধীরে ধীরে ঝিমিয়ে পড়েছে দুদকের ফাঁদ।
 
গত কয়েক বছরে ফাঁদ পেতে দুর্নীতিবাজদের পাকড়াও করার ঘটনা ঘটেছে হাতেগোনা কয়েকটি। সংস্থাটি ২০২০ সালে ১৮টি ফাঁদ মামলা হলেও ২০২২ সালে করেছে মাত্র একটি। আবার এ বছরের গত ছয় মাস পার হয়ে গেলেও মামলা করেছে মাত্র দুটি। দুদকের ফাঁদ অভিযান ঝিমিয়ে পড়লেও সম্প্রতি সংস্থাটির এক কর্মকর্তাকে ঘুষ নেওয়ার সময় ‘ফাঁদ’ পেতে হাতেনাতে গ্রেফতার করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)।
 
দুদকের ভাষ্য, আগের মতো অভিযোগ না থাকায় ফাঁদ পেতে দুর্নীতিবাজদের পাকড়াওয়ের ঘটনা কিছুটা কমলেও বিশেষ এ কার্যক্রম বন্ধ হয়নি। পরিস্থিতি বিবেচনায় এ অভিযান ও মামলা চলমান রয়েছে। এ ধরনের অভিযান আরও জোরদারে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এদিকে ফাঁদ কার্যক্রম পরিচালনার জন্য নতুন গাইডলাইন তৈরি করেছে সংস্থাটি। নতুন গাইডলাইনে কাউকে হয়রানি করতে অভিযোগ করলে অভিযোগকারীকে শাস্তির আওতায় আনাসহ বেশ কিছু বিধান যোগ করা হয়েছে। পুরোনো আইনের সঙ্গে নতুন গাইডলাইন অভিযান সংশ্লিষ্টদের আবশ্যিকভাবে অনুসরণ করতে বলা হয়েছে।
 
পাঁচ বছরে ৫৯ ফাঁদ অভিযান : দুদক সূত্রে জানা গেছে, ২০১৮ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত গত পাঁচ বছরে দুদক ফাঁদ অভিযান পরিচালনা করেছে ৫৯টি। গত বছর ফাঁদ মামলা হয়েছে মাত্র একটি। এ সময়ে চারটি ফাঁদ মামলার তদন্ত হয়। 
 
এর আগে ২০২১ সালে ৬টি ফাঁদ মামলা করে সংস্থাটি। অথচ ২০২০ সালে ফাঁদ মামলার সংখ্যা ছিল ১৮টি। এর আগে ২০১৯ সালে এ সংখ্যা ছিল ১৬টি এবং ২০১৮ সালে ছিল ১৫টি। দুদকের তথ্যে আরও দেখা যায়, ২০১৭ সালে ২৪টি, ২০১৬ সালে ১৩টি, ২০১৫ সালে ৪টি ও ২০১৪ সালে ৫টি ফাঁদ মামলা করে সংস্থাটি। তথ্যে দেখা গেছে, ২০২০ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর ১৫-২০টি ফাঁদ মামলা হলেও গত তিন বছরে মামলার সংখ্যা একেবারে কমে এসেছে। গত বছর মামলা হয়েছে মাত্র একটি। আবার এ বছর গত ৬ মাসে মামলা হয়েছে দুটি।
 
জনবলেও বাড়েনি ফাঁদ অভিযান : দুদকের তথ্য বলছে, সারা দেশে দুদকের জেলা কার্যালয় ২২টি থেকে বাড়িয়ে বর্তমানে ৩৬টি করা হয়েছে। সেই সঙ্গে জনবলও আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। তবে কার্যালয় ও জনবল বাড়লেও সেই অনুপাতে অভিযোগ তদন্ত ও নিষ্পত্তিসহ অন্যান্য কার্যক্রম বাড়েনি। দুদকের ফাঁদ অভিযান কমে যাওয়াকে নেতিবাচকভাবে দেখা হচ্ছে।
 
সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এবং মানবাধিকার ও পরিবেশবাদী সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের সভাপতি মনজিল মোরসেদ সময়ের আলোকে বলেন, সাধারণত ফাঁদ মামলায় সরকারি কর্মকর্তাদের ধরা হয়ে থাকে। এ ধরনের আটকের ঘটনায় দেশে নেতিবাচক আলোচনা তৈরি হয়। দুদক হয়তো এ কারণে ফাঁদ কার্যক্রম কমিয়ে রাখতে পারে। অন্যদিকে ফাঁদ পেতে কাউকে ধরার জন্য যথেষ্ট তথ্যের দরকার হয়। যথাযথ তথ্য না পাওয়ায় ফাঁদ অভিযান ও মামলা কমতে পারে। তবে দুদকের ফাঁদ কার্যক্রম আরও বাড়ানো দরকার বলে মনে করেন এ আইনজীবী।
 
এ বিষয়ে গত সোমবার দুদক সচিব মো. মাহবুব হোসেন সময়ের আলোকে বলেন, ফাঁদ অভিযান বন্ধ হয়নি। পরিস্থিতি বিবেচনায় অভিযান চলমান রয়েছে। এ বছর ট্যাক্স অফিসারসহ বেশ কয়েকজনকে ফাঁদ পেতে গ্রেফতার করা হয়েছে, যা আগামীতে আরও বাড়বে। গত ৬ এপ্রিলও দুদক সচিব ফাঁদ পেতে দুর্নীতিবাজ ধরা অভিযান জোরদার করার কথা বলেছিলেন।
 
দুদকের তথ্যে দেখা গেছে, চলতি বছর ৬ এপ্রিল শরীয়তপুরের ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক) কার্যালয়ে অভিযান চালিয়ে ঘুষের ৫০ হাজার টাকাসহ উপ-ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ মনির হোসেনকে গ্রেফতার করা হয়। এর আগে ৪ এপ্রিল রাজশাহীতে উপ-কর কমিশনার মহিবুল ইসলাম ভূঁইয়াকে ১০ লাখ টাকা ঘুষ গ্রহণের সময় আটক করা হয়।
 
ফাঁদ মামলা পরিচালনায় নতুন গাইডলাইন : দুদক সূত্রে জানা গেছে, ২০০৭ সালে এক-এগারোর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে ফাঁদ পদ্ধতি চালু হয়। ওই বছরই দুদকের ১৬ নম্বর বিধিতে ‘ফাঁদ’ পদ্ধতি সংযুক্ত করা হয়েছিল। সময়ের পরিক্রমায় ফাঁদ কার্যক্রম চালাতে এবার কিছু নতুন গাইডলাইন তৈরি করেছে দুদক। গত ৮ মে দুদক সচিব মো. মাহবুব হোসেনের স্বাক্ষর করা আদেশে ফাঁদ-মামলা জোরদারে নতুন করে গাইডলাইন তৈরি করার কথা বলা হয়। নতুন এ গাইডলাইনে ক্ষতিগ্রস্ত বা হয়রানির শিকার হওয়া ব্যক্তিকে যথাযথ আইনি প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণে সম্মত থাকাসহ অবশ্যই তাকে নাম প্রকাশে ইচ্ছুক হওয়ার কথা বলা হয়েছে।
 
দুদক সূত্র জানায়, ফাঁদ কার্যক্রম বা ট্র্যাপ পরিচালনাকারী কর্মকর্তাকে দুর্নীতি দমন কমিশনের বিধিমালা ২০০৭-এর বিধি-১৬ ও বর্তমান গাইডলাইনে বর্ণিত নির্দেশনা আবশ্যিকভাবে পালনের কথা বলা হয়। নতুন গাইডলাইন অনুযায়ী, তিনটি ধাপে ফাঁদ কার্যক্রম পরিচালনা করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এতে বলা হয়-ফাঁদ পূর্ব, ফাঁদ পরিচালনা ও ফাঁদ পরবর্তী-এই তিন ধাপে ভাগ করে ফাঁদ অভিযান সংক্রান্ত কার্যক্রম করতে হবে।
 
নতুন গাইডলাইনে আরও বলা হয়, ফাঁদ পরিচালনাকারীদের অভিযুক্ত ব্যক্তির সঙ্গে সম্পূর্ণ পেশাদারি আচরণ করতে হবে। এ কাজে কমিশন বা প্রধান কার্যালয়ের এনফোর্সমেন্ট ইউনিটের সঙ্গে সমন্বয় সাধন করবে। এর আগে কমিশন থেকে অনুমোদন নিয়ে ফাঁদ পরিচালনাকারী দল ও তল্লাশি দল গঠন করতে হবে। ফাঁদ কার্যক্রম চালানোর সময় নিরপেক্ষ সাক্ষী আগেই ঠিক করে নিতে হবে। সাক্ষীর ক্ষেত্রে পাবলিক সার্ভেন্টকে অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা বলা হয়। অভিযোগ গ্রহণ থেকে শুরু করে জব্দ তালিকা তৈরি ও সেগুলো জিম্মায় দেওয়া এবং এজাহার দায়েরসহ সব আইনগত পদক্ষেপ যথাযথভাবে শেষ করতে বলা হয়। এ ছাড়াও ফাঁদ কার্যক্রম সংক্রান্ত চেক লিস্ট প্রতিপালন ও আসামিকে দ্রুত আদালতে পাঠানোর নির্দেশনা রয়েছে।
 
নতুন গাইডলাইনে বলা হয়, কোনো সরকারি চাকরিজীবীকে ক্ষতিগ্রস্ত করার জন্য ইচ্ছাকৃতভাবে ও সজ্ঞানে মিথ্যা তথ্য দিয়ে ফাঁদ কার্যক্রম পরিচালনা করা যাবে না। এ বিষয়ে যিনি মিথ্যা তথ্য দেবেন, তাকেসহ সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে আইনানুগ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেবে দুদক। কমিশনের অনুমোদনে প্রধান কার্যালয় বা বিভিন্ন অফিসের কর্মকর্তাদের নিয়ে গঠিত টিম দেশের যেকোনো জায়গায় ফাঁদ পরিচালনা করতে পারবে।
 
গাইডলাইনে আরও বলা হয়, ফাঁদ পরিচালনার সময় অভিযোগকারী ও ফাঁদ দলের গুরুত্বপূর্ণ সদস্যদের সম্ভব হলে শরীরে স্পাই ক্যামেরা বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক্স ডিভাইস সংযোজন করতে হবে। ফাঁদ কার্যক্রম শেষে জব্দ তালিকা তৈরি করাসহ প্রয়োজনে পুলিশ, র‌্যাব বা অন্য কোনো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহযোগিতা নিতে হবে।
 
অভিযান সংশ্লিষ্ট স্থানে কোনো সিসি ক্যামেরা থাকলে, ফুটেজসহ অন্যান্য আলামত সংগ্রহ করতে বলা হয়। নতুন নিয়মানুযায়ী, উদ্ধার করা আলামত অর্থাৎ টাকা ও মূল্যবান সামগ্রী যথাযথভাবে নিজস্ব দফতর, আদালতের মালখানা কিংবা আদালতের আদেশসাপেক্ষে যথাযথ স্থানে সংরক্ষণ করতে হবে। ফাঁদ কার্যক্রম শেষে মামলাসহ এ সম্পর্কিত কাজের জন্য প্রয়োজনীয় লজিস্টিকস ও কাগজপত্র প্রস্তুত রাখার কথাও নতুন গাইডলাইনে উল্লেখ করা হয়।
 
সময়ের আলো/আরএস