Image description

গত মঙ্গলবার ঢাকার এক আদালতে বিচার চলাকালে আওয়ামী লীগ ও বিএনপিপন্থি আইনজীবীদের মধ্যে হাতাহাতির ঘটনা ঘটে। ওই ঘটনার রেশ ছিল বুধবারও। শুধু তাই নয়, সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্টেও দুই শিবিরের আইনজীবীরা প্রায় প্রতিদিনই মিছিল-পাল্টা মিছিল করছেন। কখনো কখনো মিছিলগুলো প্রায় মুখোমুখি অবস্থায়ও পড়ে যায়। এর মধ্যে ঢাকার আদালতে বিচার চলাকালেই আইনজীবীদের মধ্যে হাতাহাতির ঘটনা ঘটে।

এই অসহিষ্ণুতার পরিপ্রেক্ষিতে জানতে চাইলে এর জন্য রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তিকে দায়ী করেন সাবেক বিচারক ও মানবাধিকারকর্মীরা। তবে আওয়ামী লীগ ও বিএনপিপন্থি আইনজীবীরা যথারীতি একে অন্যের ওপর দায় চাপাচ্ছেন
সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির গত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সমর্থিত সাদা প্যানেল থেকে টানা দ্বিতীয়বারের মতো সভাপতি হন মো. মোমতাজউদ্দিন ফকির। মানবাধিকার সংগঠন থেকে রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তির কথা বলার বিষয়ে মনোযোগ আকর্ষণ করা হলে এ জ্যেষ্ঠ আইনজীবী সময়ের আলোকে বলেন, এটা আগেও ছিল, এখনও আছে। কিন্তু সেখানে (জজ কোর্টে) তারেক জিয়ার (বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান) মামলা নিয়ে বিএনপিপন্থি আইনজীবীরা যা করেছেন সেটি তো সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড। কালো কোটের মর্যাদা রাখতে হবে। আর সাংবাদিকদেরও কালোকে কালো, সাদাকে সাদা এবং অন্যায়কে অন্যায় বলতে হাবে। তা হলে সমস্যা সমাধানে ভূমিকা রাখা হবে।

সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির গত নির্বাচনে বিএনপি সমর্থিত নীল প্যানেল থেকে সভাপতি প্রার্থী ছিলেন টানা সাতবারের সম্পাদক এএম মাহবুব উদ্দিন খোকন। তিনি বলেন, তারেক জিয়া দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান। আদালতে তার মামলা চলছিল। দলীয় আইনজীবীরা গিয়েছিলেন সেখানে মামলার কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করতে। তাদের পর্যবেক্ষণ করতে দিলেই এমন পরিস্থিতি হতো না।

এ জ্যেষ্ঠ আইনজীবী বলেন, ঘটনা যা ঘটে গেল তা তো কলঙ্কজনক। এই কলঙ্ক সবাইকে বহন করতে হবে। এ ছাড়া বারের গত নির্বাচনে সরকারদলীয় প্রার্থীরা পুলিশ দিয়ে সাংবাদিক ও আইনজীবীদের মারধর করে নির্বাচনের ফল নিজেদের পক্ষে নিয়েছে। বারে পুনরায় নির্বাচন দিতে হবে। এ সময় ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস সাবেক প্রধান বিচারপতি ও সুশীল সমাজের ব্যক্তিদের কটাক্ষ করে বক্তব্য দিয়েছেন অভিযোগ করে তিনি বলেন, এর কারণেও পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে।

সাবেক বিচারক ও বর্তমানে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী আজিজুর রহমান দুলু সময়ের আলোকে বলেন, বিচারাঙ্গনের অনাকাক্সিক্ষত এসব ঘটনার কারণে দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় ব্যাঘাত ঘটবে। তাই দলীয় লেজুড়বৃত্তি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। এ থেকে বের হওয়ার উপায় দেখিয়ে তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেন, যেমন-বিচারপতি নিয়োগ দেওয়ার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত নন তেমন আইনজীবীদের দিতে হবে। তাতে রাজনৈতিক দলে আইনজীবীদের ঝুঁকে পড়া কমবে। কিন্তু যখন দেখা যায়, রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকলে ডিএজি, এএজি বা বিচারপতি হওয়ার পথ সহজ হয়, তখন তো আইনজীবীরা গবেষণাধর্মী কাজ এড়িয়ে দলীয় কাজেই সম্পৃক্ত হবেন। এ ছাড়া বিচারপতিদেরও দলীয় মনোভাব দূর করার ওপর গুরুত্ব দেন তিনি।

এসব সমস্যা বছরের পর বছর ধরেই চলছে, কিন্তু সম্প্রতি এমন অবস্থা হয়ে গেল কেন, যে বিচারকাজ চলাকালে আদালতের ভেতরেই আইনজীবীরা হাতাহাতিতে জড়িয়ে পড়লেন? জাতীয় নির্বাচন ঘনিয়ে আসাও এর কারণ কি না-প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, হলেও হতে পারে।
জানতে চাইলে বেসরকারি সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) নির্বাহী পরিচালক নূর খান সময়ের আলোকে বলেন, আমার ব্যক্তিগত মত হচ্ছে, রাজনীতিতে যখন নীতির অভাব হয়, কেউ যেন ভীত হয়ে যায় তখন অন্য কাউকে সহ্য করতে পারে না। পেশাজীবী সংগঠনগুলো হয়ে গেছে রাজনৈতিক সংগঠনের অংশ। পেশাজীবী সংগঠনগুলোকে রাজনৈতিক দলের লেজুড়বৃত্তি থেকে বেরিয়ে পেশাজীবী সংগঠন হতে হবে। পেশাজীবী সংগঠনের কাজ হলো নিজেদের পেশার মান উন্নয়নে বিভিন্ন সুবিধা-অসুবিধা নিয়ে আলোচনা করা, এগুলো মোকাবিলা করা। সাম্প্রতিক সমস্যার অবনতির পরিপ্রেক্ষিতে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সামনে জাতীয় নির্বাচন, তাই এ অবনতি।

প্রসঙ্গত, জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে করা মামলায় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও তার স্ত্রী ডা. জুবাইদা রহমানের বিরুদ্ধে বুধবার আরও একজন সাক্ষ্য দিয়েছেন। বুধবার এ মামলায় সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য দিন ধার্য ছিল। এদিন শাহ আলম নামে একজন হাজির হয়ে সাক্ষ্য দেন। এ সময় ঢাকার সিনিয়র মহানগর স্পেশাল জজ মো. আছাদুজ্জামান সাক্ষীর জবানবন্দি গ্রহণ করেন। পরবর্তী সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য ১ জুন তারিখ ধার্য করে আদালত। এ নিয়ে এই মামলায় আটজনের সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়েছে।

এদিন দুপুর ২টার পর আদালতের এজলাসের বাইরে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করেন বিএনপিপন্থি আইনজীবীরা। অন্যদিকে তাদের দাবি মিথ্যা উল্লেখ করে মুখোমুখি অবস্থান নেন আওয়ামীপন্থি আইনজীবীরা। এ সময় উভয় পক্ষের আইনজীবীরা বিভিন্ন স্লোগান দেন। এর মধ্যেই বিচারক এজলাসে বসলে মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়। এদিকে অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা এড়াতে আদালতপাড়ায় অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়।
মামলার অভিযোগ থেকে জানা যায়, ঘোষিত আয়ের বাইরে ৪ কোটি ৮১ লাখ ৫৩ হাজার ৫৬১ টাকার মালিক হওয়া এবং সম্পদের তথ্য গোপন ও জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে ২০০৭ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর রাজধানীর কাফরুল থানায় এ মামলা করে দুদক। মামলায় তারেক রহমান, জুবাইদা রহমান ও তার মা অর্থাৎ তারেক রহমানের শাশুড়ি ইকবাল মান্দ বানুকে আসামি করা হয়। ২০০৮ সালে দুজনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়। তারেকের শাশুড়ি ইকবাল মান্দ বানু মারা যাওয়ায় তাকে এ মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।

এদিকে তারেক রহমান ও তার স্ত্রী ডা. জুবাইদা রহমানেরর বিরুদ্ধে করা মামলায় সাক্ষ্যগ্রহণের সময় আদালতে হট্টগোলের ঘটনায় বিএনপিপন্থি ২৮ জন আইনজীবীর নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতপরিচয় অন্যদেরসহ সাধারণ ডায়েরি করা হয়েছে। বুধবার কোতোয়ালি থানার ওসি মো. শাহীনুর রহমান বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, মঙ্গলবার মহানগর দায়রা জজ আদালতের নাজির শাহ মো. মামুন বাদী হয়ে এ জিডি করেন।

এ গত মামলায় মঙ্গলবার ঢাকার মহানগর সিনিয়র স্পেশাল জজ মো. আসাদুজ্জামান বেলা ৩টার দিকে আবদুল মতিন নামে একজন সাক্ষীর জবানবন্দি নেওয়া শুরু করেন। জবানবন্দি নেওয়ার সময় বিএনপিপন্থি একদল আইনজীবী আদালত কক্ষে প্রবেশ করে মামলা প্রত্যাহারের দাবি জানান। তারা আদালত কক্ষে বিশৃঙ্খলা শুরু করেন এবং বাদীপক্ষের আইনজীবীদের সঙ্গে বাগবিতণ্ডা ও হাতাহাতিতে জড়ান। এ সময় সাক্ষী আবদুল মতিনকে লক্ষ্য করে ফাইলপত্র ছুড়ে মারা হয়। তিনি নাকে আঘাত পেয়ে সামান্য আহত হন। এক পর্যায়ে বিচারক জবানবন্দি রেকর্ড করা বন্ধ করে এজলাস থেকে নেমে খাস কামরায় চলে যান। এ সময় বিএনপিপন্থি আইনজীবীরা আদালত চত্বরে স্লোগান দিতে থাকেন। অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে আদালত চত্বরে মোতায়েন করা হয় অতিরিক্ত পুলিশ। এরপর সন্ধ্যা পৌনে ৬টার দিকে আওয়ামীপন্থি আইনজীবীরা ধাওয়া দিয়ে বিএনপিপন্থি আইনজীবীদের এজলাস থেকে বের করে দেন। এ সময় কয়েকজন আইনজীবী আহত হন। পরে সন্ধ্যা ৬টার পর পুনরায় সাক্ষী আবদুল মতিনের অসমাপ্ত জবানবন্দি ও অন্য সাক্ষী মো. মুছার জবানবন্দি গ্রহণ করেন বিচারক। পরবর্তী সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য ৩১ মে তারিখ ধার্য করেন আদালত। এ নিয়ে এ মামলায় আটজনের সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হলো। এদিন আদালতের কার্যক্রম প্রায় তিন ঘণ্টা বন্ধ ছিল।