Image description

উপজেলা পরিষদের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে ইউএনওর দায়িত্ব পালনের বিধান সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ও বাতিল ঘোষণা করে রায় দিয়েছিলেন হাইকোর্ট। গত মার্চ মাসে দেওয়া ওই রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশের জন্য প্রস্তুত হয়েছে।
 
এরই মধ্যে পূর্ণাঙ্গ রায়ে স্বাক্ষর করেছেন হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট দ্বৈত বেঞ্চের উভয় বিচারপতি। ওই বেঞ্চে রাষ্ট্র পক্ষের আইনজীবী ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল (ডিএজি) সমরেন্দ্র নাথ বিশ্বাস এ তথ্য নিশ্চিত করেন।
 
বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ও বিচারপতি আহমেদ সোহেলের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এ রায় দেন। রায়ে চারটি পর্যবেক্ষণ দেওয়া হয়। পর্যবেক্ষণগুলো হলো-১. উপজেলা পরিষদ আইন-১৯৯৮-এর ২৪ ধারার অধীনে গঠিত/প্রতিষ্ঠিত, সংবিধানের ১৫২(১) অনুচ্ছেদসহ ৫৯ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী গঠিত একটি স্থানীয় সরকার হচ্ছে উপজেলা পরিষদ। ২. উপজেলা পরিষদ আইন, ১৯৮৮-এর ৩৩ ধারা জাতীয় সংসদে সংশোধনীর মাধ্যমে উপজেলা পরিষদের সব প্রশাসনিক ও আর্থিক ক্ষমতাসংশ্লিষ্ট উপজেলা পরিষদের কাছে দায়বদ্ধ না করে প্রশাসনকে (ইউএনওদের) দিয়েছে সংসদ, যা নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গঠিত পরিষদ এবং সংবিধানের ৫৯ ও ৬০ অনুচ্ছেদের সঙ্গে সরাসরি সাংঘর্ষিক। এ ছাড়া উপজেলা পরিষদ আইন-১৯৯৮-এর সঙ্গেও তা সাংঘর্ষিক। অতএব, উপজেলা পরিষদ আইনের ৩৩ ধারা (যা ২০১১ সালের আইন নং ২১ অনুযায়ী (সংশোধিত) সংবিধানের ৭(২) অনুচ্ছেদ অনুসারে বাতিলযোগ্য।
 
উপজেলা পরিষদ আইন ১৯৯৮-এর [৩৩ ধারা (১) বলা হয়েছে, উপজেলা নির্বাহী অফিসার পরিষদের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা হইবেন এবং তিনি পরিষদকে সাচিবিক সহায়তা প্রদান করিবেন। (২) পরিষদের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন, আর্থিক শৃঙ্খলা প্রতিপালন এবং বিধি দ্বারা অন্যান্য কার্যাবলি পরিষদের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা সম্পাদন করিবেন।] ৩. সরকারি তহবিল দিয়ে অর্থায়ন করা উন্নয়ন উদ্যোগ ইউএনওদের নেতৃত্বে এবং তাদের সভাপতিত্বে গঠিত সংশ্লিষ্ট কমিটি বাস্তবায়ন করে। এ ছাড়া উপজেলা পরিষদ আইন, ১৯৯৮-এর ২৯ ধারা অনুযায়ী উপজেলায় সংশ্লিষ্ট কমিটি গঠিত হয় না। তাই এসব কারণে রিটকারীদের দাবি এখানে ব্যর্থ হয়। ৪. উপজেলা পরিষদ আইন, ১৯৯৮-এর ২৬ ধারা লঙ্ঘন করে ‘উপজেলা পরিষদ’-এর জায়গায় ইউএনও কর্তৃক তাদের চিঠিপত্রে ‘উপজেলা প্রশাসন’ পরিভাষাটির ব্যবহার করা হয়েছে। এতদ্বারা বৈধ কর্তৃত্ব ছাড়াই তা ঘোষণা করা হয়েছে। তাই এর কোনো আইনি প্রভাব নেই।
 
২০২০ সালের ৭ ডিসেম্বর উপজেলা পরিষদ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ও দুমকি উপজেলা চেয়ারম্যান হারুন-অর-রশিদ হাওলাদারসহ কয়েকজন জনপ্রতিনিধি একটি রিট করেন। শনিবার সময়ের আলোকে তিনি বলেন, পূর্ণাঙ্গ রায়টি এখনও হাতে পাইনি। তবে হাইকোর্টের দেওয়া ওই রায় আগামী ৫ জুন পর্যন্ত স্থগিত রেখেছেন আপিল বিভাগ। ওই দিন এ সংক্রান্ত একটি আবেদন আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে শুনানির জন্য দিন ধার্য রেখেছেন চেম্বার আদালত। গত ৫ এপ্রিল ওই আদেশ দেন চেম্বার বিচারপতি। ওই দিন রাষ্ট্র পক্ষের করা আবেদনের শুনানি নিয়ে চেম্বার বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ওই স্থগিতাদেশ দেন।
 
প্রসঙ্গত, ১৯৯৮ সালের উপজেলা পরিষদ আইনের ৩৩ ধারায় ২০১১ সালে সংশোধনী আনা হয়। উপজেলা পরিষদ আইনের সংশোধিত ৩৩ (১) উপধারা অনুসারে উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) পরিষদের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা হবেন এবং তিনি পরিষদে সাচিবিক সহায়তা প্রদান করবেন। ৩৩ (২) উপধারায় পরিষদের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন, আর্থিক শৃঙ্খলা প্রতিপালন এবং বিধি দ্বারা নির্ধারিত অন্যান্য কার্যাবলি পরিষদের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা সম্পাদন করবেন বলা আছে। সংশোধিত ৩৩ ধারা সংবিধানের কয়েকটি অনুচ্ছেদের সঙ্গে সাংঘর্ষিক উল্লেখ করে ২০২০ সালে কয়েকজন জনপ্রতিনিধি পৃথক রিট করেন। পৃথক রিটের ওপর চূড়ান্ত শুনানি নিয়ে রায় দেন উচ্চ আদালত।
 
রায়ের প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশ উপজেলা পরিষদ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি হারুন-অর-রশীদ হাওলাদার বলেছিলেন, সংবিধান দেশের সর্বোচ্চ আইন, প্রশাসনের প্রতিটি স্তর হবে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের সমন্বয়ে। উপজেলা পরিষদ আইনানুগ প্রশাসন। উপজেলা প্রশাসন লেখা ও ১৭ দফতরের কাজ ৩৩ ধারা বলে অনুমোদনবিহীন করা অবৈধ ঘোষণা করেছে। আমরা রায় বাস্তবায়ন চাই। আমরা আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল।
আর সাবেক জ্যেষ্ঠ সচিব আবু আলম মো. শহীদ খান সময়ের আলোকে বলেছিলেন, এই রায় কার্যকর হলে সমস্যার সমাধান হবে কি না তা নিশ্চিত করে বলতে পারব না। সে ক্ষেত্রে কাকে কী নামে ডাকা হবে তা সরকার ঠিক করবে বা রায়ে ঠিক করে দেবেন। কিন্তু আমি মনে করি না যে, পদের নাম পরিবর্তনে সমস্যার সমাধান হবে। কারণ মূল সমস্যা হচ্ছে, আইন অনুসারে স্থানীয় সংসদ সদস্য হচ্ছেন উপজেলা পরিষদের উপদেষ্টা। এটি সংবিধান পরিপন্থি একটি আইন। এটি বাতিল করলেই সমস্যার সমাধান হয়ে যায়।
 
তিনি বলেন, উপজেলা পরিষদের ২৫ ধারা অনুযায়ী নির্বাচিত সংসদ সদস্যরা সংশ্লিষ্ট উপজেলা পরিষদের উপদেষ্টা হবেন এবং পরিষদ উপদেষ্টার পরামর্শ গ্রহণ করবে। আইনের ৪২ ধারার একটি অংশে বলা হয়েছে, পরিষদ তার প্রতিটি উন্নয়ন পরিকল্পনার বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সংসদ সদস্যের সুপারিশ গ্রহণ করে এর অনুলিপি সরকারের কাছে পাঠাবে। সংবিধানের ৫৯ (১) আইন অনুযায়ী নির্বাচিত ব্যক্তিদের সমন্বয়ে গঠিত প্রতিষ্ঠানসমূহের ওপর প্রজাতন্ত্রের প্রত্যেক প্রশাসনিক একাংশের স্থানীয় শাসনের ভার প্রদান করা হইবে।
 
সাবেক স্থানীয় সরকার সচিব আবু আলম মো. শহীদ খানের এ বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে জানতে চাইলে উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান হারুন-অর-রশীদ হাওলাদার বলেন, সংসদ সদস্যরা খুব একটা উপদেশই দেন না। ইউএনও সংসদ সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন, এতে দোষ নেই, কিন্তু পরিষদের বিষয়ে উপদেশ দেবেন চেয়ারম্যানকে। অর্থাৎ এ রায় কার্যকর হলে পরিষদের চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে সব সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে বা কার্যক্রম চলবে। স্থানীয় সংসদ সদস্য কোনো উপদেশ দিলে উপজেলা চেয়ারম্যানকে দেবেন।
 
অবশ্য স্থানীয় সরকার সংশ্লিষ্টদের অনেকে মনে করেন সমস্যাটি কেবল উপজেলা চেয়ারম্যান ও ইউএনওর মধ্যকার নয়। সমস্যাটি বরং ত্রিমুখী। কারণ স্থানীয় পর্যায়ে সংসদ সদস্য ও উপজেলা চেয়ারম্যানের মধ্যেও একটা দ্বন্দ্ব থাকে। উন্নয়নমূলক কোনো কাজ হলে উভয়ে ভোটারদের কাছে দেখাতে চান যে, কাজটি তিনি করেছেন। পরবর্তী সংসদ নির্বাচনের সময় তাদের দুজনই সাধারণত (একই দলের হলে) দল থেকে মনোনয়ন চান। তাই উচ্চ আদালতের এ রায় কার্যকর হলেও সংসদ সদস্য ও উপজেলা চেয়ারম্যানের দ্বন্দ্বের অবসান না হলে এ সমস্যা থেকেই যাবে।