Image description

তারা পুলিশ সদস্য। ছিলেন চট্টগ্রাম মহানগর ও জেলার বিভিন্ন থানায়। ইন্সপেক্টর থেকে সহকারী কমিশনার পদে দায়িত্বে ছিলেন অনেকেই। এ সময় জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জন করেছেন তারা। দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত সেই সম্পদের বড় অংশ কাগজে-কলমে দেখিয়েছেন স্ত্রীর নামেও। তাতেও থেকে যায় নানা ফাঁকফোকর। এর মধ্যে তাদের দেখানো হয়েছে ব্যবসায়ী বা খামারি বলে। কিন্তু দুদকের অনুসন্ধানে তার কোনো প্রমাণ মেলেনি। এমন অন্তত এক ডজন কোটিপতি পুলিশ দম্পতির জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদের তথ্য বের করে এনেছে দুদক। এদের কারও কারও বিরুদ্ধে ইয়াবাসহ নানা মাদক কারবারে পরোক্ষ সম্পৃক্ততার অভিযোগও রয়েছে।

প্রাথমিক অনুসন্ধানে তথ্য-প্রমাণ পাওয়ার পর কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তা ও তাদের স্ত্রীর বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন। আরও বেশ কয়েকজনের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শেষে মামলার সুপারিশসহ সাক্ষ্য-স্মারক কমিশনে জমা দেওয়া হয়েছে। কমিশনের অনুমোদন সাপেক্ষে তাদের বিরুদ্ধে ধারাবাহিকভাবে মামলা হতে পারে বলে জানিয়েছেন দুদক চট্টগ্রামের উপ-পরিচালক মো. নাজমুছ সাদাত। তিনি বলেন, পুলিশ কর্মকর্তাদের সম্পদের অনুসন্ধান কার্যক্রম শুরু হয়েছে অনেক আগে থেকেই। সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে এরই মধ্যে কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তা ও তাদের স্ত্রীর বিরুদ্ধে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে মামলা হয়েছে। আরও কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে প্রাথমিক অনুসন্ধান শেষে প্রতিবেদন কমিশনে দাখিল করা হয়েছে। যাদের অনুমোদন মিলবে তাদের বিরুদ্ধে মামলা করা হবে।


দুদক সূত্র জানায়, জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের দায়ে সবশেষ গত ৭ ও ৮ মে দুর্নীতি দমন কমিশনের জেলা সমন্বিত কার্যালয়ে দুই পুলিশ দম্পতির বিরুদ্ধে পৃথক তিনটি মামলা করা হয়। এর মধ্যে ১ কোটি ৮৮ লাখ টাকার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জন এবং সম্পদ বিবরণীতে তথ্য গোপনের অভিযোগে চট্টগ্রাম জেলা পুলিশ সুপার কার্যালয়ের এএসপি এবিএম শাহাদাত হোসেন মজুমদার ও তার স্ত্রী রাজিয়া সুলতানার বিরুদ্ধে দুটি। এ ছাড়া ১ কোটি ৯৪ লাখ টাকার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জন এবং সম্পদ বিবরণীতে তথ্য গোপনের অভিযোগে চট্টগ্রাম মহানগর ট্রাফিক পুলিশের পরিদর্শক (টিআই) আবুল কাশেম চৌধুরী ও তার স্ত্রী ফাতেমা বেগমের বিরুদ্ধে একটি মামলা হয়েছে। দুদক চট্টগ্রাম সমন্বিত কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক এনামুল হক বাদী হয়ে দুই পুলিশ দম্পতির বিরুদ্ধে ওই তিনটি মামলা করেন।

এর আগে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জন ও সম্পদের তথ্য গোপন করার অভিযোগে চট্টগ্রাম মহানগর ট্রাফিক পুলিশের আরেক ইন্সপেক্টর মীর নজরুল ইসলাম ও তার স্ত্রী শাহানা সুলতানার বিরুদ্ধেও পৃথক দুটি মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। দুদক চট্টগ্রাম সমন্বিত জেলা কার্যালয়-১-এ মামলা দুটি করেন কার্যালয়ের উপ-পরিচালক মোহাম্মদ লুৎফুল কবির চন্দন।


মামলায় মীর নজরুল ইসলামের বিরুদ্ধে ৩০ লাখ ৬৭ হাজার ৩৪৩ টাকার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জন এবং ৩৮ লাখ ৪ হাজার ৩৭৬ টাকার সম্পদের তথ্য গোপন করার অভিযোগ আনা হয়। পৃথক মামলায় তার স্ত্রী শাহানা সুলতানা ও টিআই নজরুলের বিরুদ্ধে ৮৭ লাখ ২৮ হাজার ৬৭৫ টাকার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জন এবং ৬১ লাখ ৮০ হাজার ৭৭৩ টাকার সম্পদের তথ্য গোপন করার অভিযোগ আনা হয়। এসব মামলা এখনও দুদকের তদন্তাধীন রয়েছে।

এর আগে ২০২০ সালের ২৩ আগস্ট সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা রাশেদ খান হত্যার ঘটনায় বিতর্কিত ও বরখাস্ত হওয়া টেকনাফ থানার সাবেক ওসি প্রদীপ কুমার দাশ ও তার স্ত্রী চুমকি কারণের বিরুদ্ধে ৩ কোটি ৯৫ লাখ টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের দুদকের সহকারী পরিচালক রিয়াজ উদ্দিন মামলা করেন। বিচার শেষে গত বছরের ২৭ জুলাই বিশেষ জজ আদালতের বিচারক মুন্সি আবদুল মজিদ ওই মামলার রায় ঘোষণা করেন। রায়ে প্রদীপ কুমার দাশকে ২০ বছর ও তার স্ত্রী চুমকি কারণকে ২১ বছরের কারাদণ্ডের পাশাপাশি ওই দম্পতিকে ৪ কোটি ১ লাখ ১০ হাজার টাকা জরিমানা এবং তাদের সব সম্পদ বাজেয়াপ্ত করার নির্দেশ দেন। ওই দম্পতি বর্তমানে কারাবন্দি রয়েছে। এ দম্পতির সম্পদ অনুসন্ধানে বিশ্বের সাতটি দেশে চিঠি পাঠানো হয়েছে বলে দুদক সূত্র জানায়।

দুদকের নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছে, বিগত ২০১৯ সাল থেকে সুনির্দিষ্ট অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগে এক ডজনেরও বেশি পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগের ব্যাপারে দুদক প্রাথমিক অনুসন্ধান কার্যক্রম শুরু করে। ধারাবাহিক প্রক্রিয়ায় তাদের কাছে সম্পদের হিসাব চাওয়া হয়। নোটিস পাওয়ার পর তারা সম্পদের হিসাব বিবরণী দাখিল করেন। এরপর দুদক সেই বিবরণী ধরে অনুসন্ধানে নেমে তথ্য গোপন ও জ্ঞাত আয়বহির্ভূত অঢেল সম্পদ অর্জনের তথ্য-প্রমাণ পায়। তাদের স্ত্রীদের নামেও কোটি কোটি টাকার সম্পদের তথ্য-উপাত্ত সংস্থাটির হাতে রয়েছে।

নগরীর কোতোয়ালি, বন্দর, পাহাড়তলী ও পাঁচলাইশ এবং জেলার বোয়ালখালী থানায় ওসির দায়িত্ব পালন করে যাওয়া এ রকম অন্তত আরও ছয়জন পুলিশ ইন্সপেক্টর ও তাদের স্ত্রীর বিরুদ্ধে সম্পদের তথ্য গোপন ও জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের তথ্য-উপাত্ত সংবলিত প্রতিবেদন কমিশনে জমা দেওয়া হয়েছে। অনুমোদন পাওয়া সাপেক্ষে সেসব কর্মকর্তা ও তাদের স্ত্রীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলা হতে পারে। 


এ বিষয়ে সুজন চট্টগ্রামের সম্পাদক অ্যাডভোকেট আখতার কবির চৌধুরী বলেন, দুর্নীতিবাজ চিহ্নিত পুলিশ কর্মকর্তারা একসময় চট্টগ্রামে ছিল। এ সময় তারা দাপট দেখিয়ে অবৈধ সম্পদের মালিক হয়েছেন। এদের বিরুদ্ধে দুদকের কঠোর অবস্থান নিতে হবে। কারণ এদের মতো আরও অনেক পুলিশ কর্মকর্তা চট্টগ্রামের বিভিন্ন থানায় ও কার্যালয়ে রয়েছেন। তারা যেন বুঝতে পারেন দুর্নীতি করে পার পাওয়া যাবে না। এর হিসাব দিতেই হবে। গুনতে হবে মাসুল। তা হলে অবৈধ সম্পদের মালিক হওয়া থেকে এরা দূরে থাকবে। আর এর মাধ্যমে সুন্দর সমাজ প্রতিষ্ঠা হবে।