
রোহিঙ্গা সংকট এখন দেশের জন্য গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সমাধানের পরিবর্তনে সংকট আরো বাড়ছে। আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে- একদিকে আশ্রয়শিবিরে উচ্চ জন্মহার, অন্য দিকে এখনো দলে দলে আসছে সীমান্ত পেরিয়ে। ২০১৭ সালের আগস্টে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নৃশংস অভিযান এবং জাতিগত নিধনের পর বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের সংখ্যা ব্যাপক হারে বাড়ছে।
রোহিঙ্গা সংকটের আট বছর পেরিয়েছে- দিন যতই যাচ্ছে সংকট ক্রমেই বাড়ছে। সংকট এখন আর কেবল মানবিক নয়, বরং বহুমাত্রিক এক নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জে রূপ নিয়েছে। মিয়ানমার থেকে বাস্তুচ্যুত লাখ লাখ রোহিঙ্গার বাংলাদেশে দীর্ঘস্থায়ী অবস্থান বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে।
কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফে ৩৩ আশ্রয়শিবিরে প্রায় ১৩ লাখ রোহিঙ্গা নিয়ে বাংলাদেশ সরকার এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছে। রোহিঙ্গাদের উচ্চমাত্রায় সন্তান জন্মদান সেখানকার পরিবেশও মারাত্মক হুমকির মুখে পড়েছে। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, প্রতিদিন গড়ে জন্ম নিচ্ছে ৮৭ জন শিশু। অর্থাৎ বছরে এ সংখ্যা দাঁড়াচ্ছে প্রায় ৩২ হাজার। ফলে দ্রুত বাড়ছে ক্যাম্পের অভ্যন্তরীণ জনসংখ্যা।
রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী বৃদ্ধির এ হার রোহিঙ্গা সংকটকে আরও জটিল করে তুলছে। প্রায় প্রতিদিনই সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে রোহিঙ্গা ঢুকছে। শুধু গেল এক সপ্তাহে দুই থেকে আড়াই শ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করে বিভিন্ন ক্যাম্পে অবস্থান নিয়েছে। গত এক বছরে প্রায় দেড় লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছে।
রোহিঙ্গাবিষয়ক একটি আন্তর্জাতিক সংলাপে নোবেলজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস জানিয়েছেন, প্রতি বছর প্রায় ৩২ হাজার রোহিঙ্গা শিশু জন্ম নিচ্ছে। বর্তমানে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ১৩ লাখে পৌঁছেছে। স্থানীয় ও প্রশাসনিক সূত্রগুলো বলছে, অনেকে আশ্রয়শিবিরের বাইরেও বসতি গড়েছে। উখিয়া ও টেকনাফ উপজেলায় ৮ হাজার একরের বনভূমির মধ্যে রয়েছে ৩৩টি রোহিঙ্গা ক্যাম্প। এ বিপুলসংখ্যক মানুষের বসবাস এসব ক্যাম্পের পরিস্থিতি দিন দিন কঠিন করে তুলছে। একদিকে মিয়ানমার থেকে অনুপ্রবেশ থেমে নেই, অন্যদিকে প্রতিটি ঘরে বেড়ে চলেছে নতুন শিশু। সংকট ক্রমেই ভয়াবহ হচ্ছে।
এ সমস্যা দীর্ঘস্থায়ী হলে পুরো অঞ্চলের নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার ওপর প্রভাব ফেলতে পারে। উন্নয়নমূলক উদ্যোগগুলোও হুমকির মুখে পড়তে পারে। কিন্তু বিশ্বের নানা প্রান্তের বিভিন্ন সমস্যার জেরে রোহিঙ্গা সংকট থেকে আন্তর্জাতিক মনোযোগ ক্রমেই সরে যাচ্ছে। এটা উদ্বেগের বিষয়। দীর্ঘ সময় ধরে প্রত্যাবাসনের উদ্যোগ থমকে ছিল। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পরে সমাধানের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে- যা অবশ্যই ইতিবাচক। কিন্তু নতুন করে অনুপ্রবেশের সংবাদ আতঙ্কের। এদের জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সাহায্য-সহযোগিতা কমে গেছে। অসহায় আশ্রিত জীবন, নিরন্তর নিরাপত্তাহীনতার বোধ এবং সামনে কোনো উজ্জ্বল ভবিষ্যতের সম্ভাবনা দেখতে না পাওয়ার হতাশা থেকে এরা খুনখারাবি, মাদক কারবারসহ হাজারটা দুষ্কর্মে জড়াচ্ছে।
অপরাধের আখড়ায় পরিণত হচ্ছে রোহিঙ্গাশিবিরগুলো। এরা নানা অপকৌশলে অবৈধভাবে নাগরিকত্ব ও পাসপোর্ট সংগ্রহ করে বাংলাদেশি হিসেবে বিদেশে যাচ্ছে। সেখানে অপরাধে যুক্ত হয়ে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করছে। এ সমস্যার স্থায়ী সমাধান হচ্ছে নিরাপদ ও টেকসই প্রত্যাবাসন। তবে অন্তর্বর্তী সরকারের তৎপরতা বহুদিন পর প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ার একটি আশাব্যঞ্জক অগ্রগতি হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
বিশ্ব সম্প্রদায়ের সমন্বিত উদ্যোগে-প্রচেষ্টা-হস্তক্ষেপে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের নিরাপদ প্রত্যাবাসনের ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে হবে। আন্তর্জাতিক ও ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের তাদের মাতৃভূমিতে ফিরিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে মুসলিম দেশগুলোর সংগঠন ওআইসি সক্রিয় হয়ে ভূমিকা নিতে পারে। মিয়ানমারের উচিত হবে রোহিঙ্গাদের দ্রুত ফিরিয়ে নেয়া। বাংলাদেশের জন্য রোহিঙ্গা সংকট আজ শুধু একটি মানবিক দায় নয়, এটি জাতীয় নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক চাপের দীর্ঘমেয়াদি উৎস। এর সঙ্গে রয়েছে আন্তর্জাতিক সহায়তার ক্রমাগত হ্রাস এবং বৈশ্বিক আগ্রহের অবসান।
তাই রাষ্ট্রীয় স্বার্থেই প্রত্যাবাসন বাস্তবায়ন জরুরি হয়ে উঠেছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের জন্য মিয়ানমারের ওপর যথাযথ চাপ প্রয়োগ করা। বাংলাদেশ শুরু থেকেই টেকসই প্রত্যাবাসনের মাধ্যমে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক অংশীজনদের সঙ্গে কাজ করছে। দ্রুত এর দৃশ্যমান সুফল চাক্ষুষ করতে চায় দেশের মানুষ। অনুপ্রবেশ বন্ধসহ আন্তর্জাতিক পদক্ষেপের মাধ্যমেই রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে এবং তাদের নিরাপত্তা দিতে মিয়ানমারকে বাধ্য করাতে হবে।
Comments