
গাজাবাসীর ওপর শুরু হওয়া প্রলয় যেন কোনোভাবেই থামছে না। গাজাবাসীর সবাই যেন স্বাভাবিক মৃত্যুর অধিকার হারিয়েছে, হারিয়েছে রাতের ঘুম। দীর্ঘ ইতিহাসে ফিলিস্তিন বহু আগেই হয়ে উঠেছে বিশ্ব মানবতার শ্মশানভূমি। যুদ্ধের অভিঘাত কতটা মারাত্মক হতে পারে; গাজায় প্রাণঘাতী ভয়াবহ হামলা চালাচ্ছে ইসরায়েল। অবরুদ্ধ উপত্যকাটিতে নির্বিচারে হত্যা করা হচ্ছে নিরীহ ফিলিস্তিনিদের।
ইসরায়েলি বাহিনী আবাসিক বাড়ি ও অস্থায়ী তাঁবুতেও হামলা চালিয়েছে। কেবল খান ইউনিসেই নয়, গাজা শহরের জেইতুন পাড়াতেও হামলা চালানো হয়েছে। পরিস্থিতি প্রতিদিনই আরও খারাপ হচ্ছে। পরিবারকে খাওয়ানোর জন্য যে কোনো ধরনের খাবার খুঁজছে ফিলিস্তিনিরা। খাবার নেই, জ্বালানি নেই, রান্নার গ্যাস নেই। প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ও চিকিৎসা সরবরাহ না থাকায় মানুষের চিকিৎসা করা খুবই কঠিন।
এমনকি ওষুধও নেই, আশ্রয় বা তাঁবুও নেই। গাজার পরিস্থিতি শ্বাসরুদ্ধকর। সংঘাত-সংঘর্ষ পৃথিবীর মানচিত্রকে কীভাবে বদলে দিতে পারে এবং সর্বোপরি ‘সৃষ্টির সেরা জীব’ মানুষের জীবনের মূল্যকে কোন পর্যায়ে নেমে আনতে পারে, তা আমরা প্রত্যক্ষ করছি ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায়।
মৃত্যুপুরীতে পরিণত হওয়া এই ভূখণ্ড আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে, আধুনিক প্রতিযোগিতামূলক রাষ্ট্রব্যবস্থায় ‘প্রতি বর্গমাইল ভূমি রক্ষার জন্য’ ঠিক কতসংখ্যক জীবন বলিদান করার প্রয়োজন পড়ে! গত মার্চ থেকে ইসরায়েল গাজার দক্ষিণ-পূর্ব অংশে একের পর এক আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে। তারা যে ‘নিরাপত্তা বাফার জোন’ তৈরি করছে, তার পেছনে আসলে লুকিয়ে আছে এক নির্মম কৌশল, মানুষহীন করে ফেলা, জমি দখল করা, বসবাস অযোগ্য করে তোলা।
ইতোমধ্যে গাজার প্রায় অর্ধেক ভূমি ইসরায়েলের নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে। জাতিসংঘ জানিয়েছে, ইসরাইলি বাহিনীর হামলায় গাজায় প্রতিদিন ১০০ শিশু হতাহতের শিকার হয়েছে। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, এই যুদ্ধে এখন পর্যন্ত কমপক্ষে ৫০ হাজার ৬০৯ ফিলিস্তিনি নিহত ও ১ লাখ ১৫ হাজার ৬৩ জন আহত হয়েছে। প্রকৃত সংখ্যা আরো অধিক হবে, সন্দেহ নেই। তবে অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, নিহত বা আহতদের অধিকাংশই নারী ও শিশু।
ধ্বংসস্তূপের নিচে এখনো হাজার হাজার নারী-শিশু নিখোঁজ রয়েছে বলে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের খবরে জানা যায়। গাজার শিশুদের সঙ্গে যা ঘটছে, তা যেন সৃষ্টিকর্তার সঙ্গেই প্রবঞ্চনা করার শামিল। নিষ্পাপ, কোমলমতি শিশুদের ব্যাপারে নমনীয় ও যত্নশীল হওয়া এবং তাদের সঙ্গে মানবিক আচরণ করার ব্যাপারে বিশ্বের ধর্মগ্রন্থগুলোতে কঠোর নির্দেশনা দেয়া হয়েছে; কিন্তু কে শোনে কার কথা!
সমগ্র বিশ্বে শিশুদের সম্বোধন করা হয়, অ্যাঞ্জেল বলে, অর্থাৎ, তারা ফেরেশতাতুল্য; কিন্তু সেই খোদা-প্রেরিত ফেরেশতার সঙ্গে আমরা কী ধরনের আচরণ করছি? আমরা কি স্মরণে রাখছি যে, ‘আল্লাহর খলিফা’ নামে অভিহিত শিশুদের সঙ্গে যেই অমানবিক আচরণ করা হচ্ছে, তার সকলই তিনি দেখছেন।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মানবজাতির উদ্দেশে সতর্কতা উচ্চারণ করে বলেছেন- ‘প্রতিটি শিশু এই বার্তা লইয়া জন্মগ্রহণ করে যে, স্রষ্টা এখনও মানুষের প্রতি আস্থা হারান নাই’; কিন্তু গাজার শিশুদের সঙ্গে যে রূপ আচরণ করা হচ্ছে, সৃষ্টিকর্তা আমাদের উপর আর কতক্ষণ আস্থাশীল থাকবেন- এমন প্রশ্ন আসছে বিবেকের গভীর থেকে? পরিস্থিতি এমন হয়েছে- গাজার হাজার হাজার শিশু স্বজন, পরিবারহীন হয়ে পড়েছে।
আহত শিশুরা যে মুক্তি পেয়েছে, সেই আশাও নেই। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস বুলেট-বোমা, মিসাইলের শব্দে তাদের মানসিক অবস্থা কোন পর্যায়ে উপনীত হয়েছে, তা পর্যবেক্ষণ করে মনশ্চিকিৎসকরা সতর্ক করে বলেছেন, ট্রমাটাইজডের শিকার এই সকল শিশুর উজ্জ্বল ভবিষ্যতের কোনোই সম্ভাবনা নেই! এটি বিশ্বের জন্য সত্যিই বড় দুঃসংবাদ।
একটি সত্য আমাদের মনে রাখতে হবে- যুদ্ধ-সংঘাত কখনোই কল্যাণ বয়ে আনে না। যুদ্ধ প্রকৃতপক্ষেই মানুষের ঘুম কেড়ে নেয়। অতএব, আমরা শান্তির ঘুম ঘুমাতে চাই কি না, তা আমাদের ভেবে দেখতে হবে। মার্কিন কবি কার্ল স্যান্ডবার্গ একদম স্পষ্ট করে বলেছেন- ‘একটি শিশু হলো স্রষ্টা-প্রেরিত সেই বার্তা যে, বিশ্বকে এখনো এগিয়ে যেতে হবে।’
সত্যিই এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে দেখতে হবে যে, স্রষ্টা-প্রেরিত গাজার শিশুদের প্রতি এহেন অমানবিকতার পর বিশ্ব আর ঠিক কতটা পথ এগোতে পারবে? একদিকে ইসরায়েলের ভয়াবহ আগ্রাসন, অপরদিকে পর্যাপ্ত খাদ্য ও চিকিৎসার অভাবে দিনে দিনে গাজা পরিণত হচ্ছে ভয়াল মৃত্যুপুরীতে।
গগণস্পর্শী লাশের স্তূপ, মুহূর্তের মধ্যে পরিবার-পরিজন হারিয়ে সহায়-সম্বলহীন হয়ে পড়ার বেদনা, ধুলোমাখা ক্ষুধার্ত শিশুর করুণ আর্তনাদ কোটি মানুষের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ ঘটালেও তা এখনো ছুঁতে পারেনি বিশ্বনেতাদের অন্তর। মানবতা জাগ্রত হোক, বিশ্বনেতারা সম্মিলিতভাবে থামিয়ে দিক গাজাবাসীদের মৃত্যুর প্রহর গণনা- এটাই এখন বিশ্ববাসীর প্রাণের দাবি।
Comments